জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
হালখাতায় যদি গান-বাজনা বা কোন শরী‘আত বিরোধী কাজ না করা হয়, কোন প্রকার প্রতারণা বা যুলুম না থাকে একমাত্র পাওনা টাকা আদায়ের লক্ষ্যে হয়, তাহ’লে তা বৈধ হবে।
সেই সঙ্গে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কোনো রীতি গ্রহণ ও পালন করা যাবে না। এসব প্রথা-পদ্ধতি থেকে বিরত থাকা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একান্ত ধর্মীয় দায়িত্ব।
উলামায়ে কেরামগন বলেন, শুধুমাত্র পাওনা টাকা আদায়ের লক্ষ্যে হালখাতা বৈধ। কারণ, ইসলাম মনে করে হাজার টাকা দান করার চেয়ে সামান্য পরিমাণ ঋণ পরিশোধের বেশি ফজিলত। ঋণ একটি অভিশাপ। ঋণে যতকম জড়ানো যায়, ততই মঙ্গল।
যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করে, অন্যের অর্থকে নিজের অর্থ হিসেবে মনে করে, তার যথেচ্ছ ব্যবহার করে, অন্যের টাকায় বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, নিজের জীবনধারাকে উন্নত করার জন্য অন্যের কষ্টের কারণ হয়, এরূপ উচ্চাভিলাষী ও অন্যের অধিকার হরণকারীদের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এদের অত্যাচারীরূপে এবং ঋণ পরিশোধে এদের টালবাহানাকে জুলুম বলে আখ্যায়িত করেছে। এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ঋণ পরিশোধে সচ্ছল ব্যক্তির টালবাহানা জুলুম। ’
ঋন এটি বান্দার হক,এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
যতক্ষন পর্যন্ত সেটা আদায় না করা হবে বা ঐ বান্দা তাকে মাফ না করবে,কোনো আমলেই তাহা মাফ হবেনা।
,
হাদীস শরীফে এসেছেঃ
عن أبي ہریرۃ رضي اللّٰہ عنہ أن رسول اللّٰہ صلی اللّٰہ علیہ وسلم قال: العمرۃ إلی العمرۃ کفارۃ لما بینہما الخ۔ (صحیح البخاري رقم: ۱۷۷۳، صحیح مسلم رقم: ۴۳۷)
সারমর্মঃ এক ওমরা থেকে আরেক ওমরাহ মাঝের সমস্ত গুনাহ মোচন কারী,,,
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে
(ہذا الحدیث) تدل علی محو جمیع السیئات الصغائر والکبائر غیر حقوق العباد في أرجح الأقوال عند العلماء … أما حقوق العباد ومظالمہم لابد من ردہا إلی أصحابہا۔ (التصویر النبوي للقیم الخلقیۃ والتشریعیۃ / العمرۃ إلی العمرۃ والحج المبرور ۱؍۱۱۹ الشاملۃ)
সারমর্মঃ এই হাদীস সমস্ত ছগীরা কবিরা গুনাহ মাফের ঈঙ্গিত বহন করে,কিন্তু হুকুকুল ইবাদ তথা বান্দার হক ব্যাতিত।
এটা উলামায়ে কেরামদের প্রাধান্য পাওয়া মত।
ঋণ একটা বোঝা। ঋণগ্রস্ততা অনেক সময় দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও অনৈতিকতার কারণ হয়। এজন্য বান্দার কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং দুআ করা, তিনি যেন ঋণ ছাড়াই সব প্রয়োজন পূরণ করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাইতেন।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এ দুআ করতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ المَسِيحِ الدَّجَّالِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِالمَحْيَا وَفِتْنَةِ المَمَاتِ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ المَأْثَمِ وَالمَغْرَمِ .
অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। মাছীহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। জীবনের ফেতনা ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে গোনাহ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই।
কেউ (অন্য বর্ণনায় আছে বর্ণনাকারী নিজেই) জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ঋণ থেকে এত বেশি আশ্রয় চান! তিনি বললেন, মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয় তখন কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩২
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ করতেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالجُبْنِ وَالبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ.
অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য (-এর শিকার হওয়া) থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৯
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোকের কাছ থেকে একটি উটনী ঋণ নিয়েছিলেন। সে তা চাইতে এসে কঠোর ব্যবহার করল। তখন উপস্থিত সাহাবীগণ তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করতে চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তাকে বলতে দাও। পাওনাদারের কিছু বলার আছে।’ এরপর তাঁদেরকে তাকে একটি উটনী কিনে দিতে বললেন। তাঁরা খুঁজে এসে বললেন, আমরা (এর সমকক্ষ উটনী পাইনি) এর চেয়ে উৎকৃষ্টই শুধু পেয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই কিনে দাও। (জেনে রেখ) তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে পরিশোধে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৯০
হাদীসে এসেছে, ঋণ ছাড়া শহীদের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৮৬
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মায়্যিত উপস্থিত করা হলে জিজ্ঞাসা করতেন ঋণ আছে কি না, থাকলে পরিশোধের মত কিছু রেখে গিয়েছে কি না। রেখে না গেলে তিনি নামায পড়তেন না।
সালামা ইবনুল আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিশে ছিলাম। তখন একজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? লোকেরা বলল, জ্বী না। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। তখন তিনি নামায পড়ালেন। তারপর আরেকজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, জ্বী হাঁ। জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার রেখে গিয়েছে। তখন তিনি নামায পড়ালেন। এরপর আরেকজন মায়্যিত আনা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, তিন দিনার আছে। তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর নামায তোমরাই পড়। এ কথা শুনে আবু কাতাদা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নামায পড়িয়ে দিন, তার ঋণ আমার জিম্মায়। তখন তিনি নামায পড়ালেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৮৯
ইসলামী স্কলারগন বলেনঃ
হালখাতা ফারসিজাত শব্দ। হালখাতার অনুষ্ঠানটি ধর্ম প্রভাবান্বিত কোনো অনুষ্ঠান নয়। এটা নিতান্তই ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা কৌশলমাত্র।
‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’ আল্লাহর রাসূল ﷺ নিজে ব্যবসায়ী ছিলেন। এ জন্যে মুসলমান মাত্রই ব্যবসাকে হালাল রুজির একটি অন্যতম পবিত্র মাধ্যম বলে মনে করেন। আর ব্যবসা চালাতে গিয়ে অনেক সময় বাকীতে মালামাল বিক্রি করতে হয়। তবে যে পরিমাণ বাকীই থাকুক না কেন, এটা পরিশোধ করতে হবে পহেলা বৈশাখের আগে। কেননা কোনো ব্যবসায়ী পুরনো খাতার বকেয়ার হিসাব নতুন খাতায় তুলতে চান না।
এভাবে বছরের প্রথম দিন থেকে খোলা হয় নতুন খাতা, যাকে বলা হয়- হালখাতা। আর এ খাতা খোলার দিন আয়োজন করা হয়- হালখাতা নামক অনুষ্ঠানের। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত লোকজন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। যাদের বকেয়া আছে তারা বকেয়া পরিশোধ করেন আর যাদের বকেয়া নাই তারাও কুশল বিনিময় করতে আসেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আগতদের মিষ্টি মুখ করানো হয়। সুতরাং হালখাতায় যদি গান-বাজনা বা কোন শরী‘আত বিরোধী কাজ না করা হয়, কোন প্রকার প্রতারণা বা যুলুম না থাকে একমাত্র পাওনা টাকা আদায়ের লক্ষ্যে হয়, তাহলে তা বৈধ হবে।
পরিশোধের লক্ষ্যে কর্য বা বাকী নিলে আল্লাহ তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কর্য পরিশোধের আশায় কর্য গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে কর্য পরিশোধ করার সুযোগ দান করেন। আর যে ব্যক্তি এই আশায় কর্য গ্রহণ করে না, আল্লাহ তার কর্য পরিশোধের সুযোগ করে দেন না’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪০০, মিশকাত হা/২৯১০)।