বিতির নামায সম্পর্কে পাকিস্তানের বিশিষ্ট গবেষক আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ.
'হাদীস ও আছারের আলোকে বিতর নামায'
শীর্ষক একটি ফেকহী মাক্বালা লিখেছেন- যা মাসিক আল-কাউছারে প্রকাশ করা হয়েছে।উনি এ সম্পর্কিয় যাবতীয় বিষয়বস্তুকে একজায়গায় একত্র করেছেন।তাই এ বিষয়ে নতুন করে লিখার কোনো প্রয়োজন নাই।
নিম্নে উনার মাক্বালাকে উপস্থাপন করছি-
'হাদীস ও আছারের আলোকে বিতর নামায'
মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ.
বিতরের নামাযে দুই রাকাতের পর আত্তাহিয়্যাতুর জন্য বসা এবং তৃতীয় রাকাতে ফাতিহা-কিরাতের পর আল্লাহু আকবার বলে দুই হাত কান পর্যন্ত ওঠানো অতঃপর হাত বেঁধে কুনূত পাঠ করা সহীহ হাদীস ও আসারে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত। বিস্তারিত দলিল নিম্নে আলোচিত হল
বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক–প্রসঙ্গ
বিতরের দ্বিতীয় রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর জন্য বসা জরুরি। শরীয়তের যেসব উসূল ও আদিল্লা তথামূলনীতি ও দলীল-প্রমাণ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
এক. সকল নামাযে দুই রাকাতের পর বৈঠক অপরিহার্য। এই মূলনীতি বহু হাদীসে পাওয়া যায়। কিছুহাদীস হাওয়ালাসহ উল্লেখ করা হল।
১.
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছে“আত্তাহিয়্যাতু।’”
وكان يقول في كل ركعتين التحية সহীহ মুসলিম ১/১৯৪
২.
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেন,-“আমরা জানতাম না প্রতি দু’ রাকাতে কী বলা হবে? তবে আমরা আমাদের রবের তাসবীহ, তাকবীর ও হামদ করতাম। হযরত মুহাম্মদ সাঃ আমাদেরকে দান করেছেন সকল কল্যাণের শিক্ষা। তিনি বলছেন-‘যখন তোমরা দুই রাকাতে বসবে তখন বলবে “আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহ”।
كنا لا ندري ما نقول في كل ركعتين، غير أن نسبح ونكبر ونحمد ربنا وأن محمدا صلى الله عليه وسلم علم فواتح الخير وخواتمه فقال : إذا قعدتم في كل ركعتين فقولوا التحيات لله.
মুসনাদে আহমদ ১/৪৩৭; সুনানে নাসায়ী ২/২৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫/২৮১; সুনানে কুবরা,বায়হাকী ২/১৪৮
৩.
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান ও আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান বলেন, আবু হুরায়রা রা.রমযানের ও রমযানের বাইরের, ফরয ও অন্য সকল নামাযে (যেভাবে) তাকবীর দিতেন, “তিনি (নামাযে) দাঁড়ানোর পর তাকবীর দিতেন, রুকুর সময় তাকবীর দিতেন,সিজদার আগে,সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ ও রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ বলতেন, সিজদায় যাওয়ার সময় আল্লাহুআকবার বলতেন,সেজদা থেকে মাথা ওঠানোর সময় তাকবীর দিতেন, (দ্বিতীয়) সেজদায় যাওয়ারসময় তাকবীর দিতেন, সেজদা থেকে মাথা ওঠানোর সময় তাকবীর দিতেন। অতপর দ্বিতীয় রাকাতেরবৈঠক থেকে ওঠার সময় তাকবীর দিতেন। নামায সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাকাতে এভাবেই তিনিতাকবীর দিতেন। নামায শেষে বলতেন, ঐ সত্ত্বার কসম,যাঁর হাতে আমার প্রাণ। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামাযের সাথে তোমাদের মাঝে আমার সর্বাধিক নিকটসাদৃশ্যরয়েছে। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত (জীবনভর) এভাবেই নামায আদায় করেছেন।’’
أن أبا هريرة كان يكبر في كل صلاة من المكتوبة وغيرها في رمضان وغيره فيكبر حين يقوم ثم يكبر حين يركع ثم يقول سمع الله لمن حمده ثم يقول ربنا ولك الحمد قبل ان يسجد ثم يقول الله اكبر حين يهوي ساجدا ثم يكبر حين يرفع رأسه من السجود ثم يكبر حين يقوم من الجلوس في الإثنتين ويفعل ذلك في كل ركعة حتى يفرغ من الصلاة ثم يقول حين ينصرف والذي يفسي بيده إني لأقربكم شبها بصلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم إن كانت هذه لصلاته حتى فارق الدنيا
মুসনাদে আহমদ ২/৪৫৪; মুসান্নাফ, আবদুর রাযযাক ২/৬২; বুখারী ১/৩১৮; মুসলিম ২/২৬৬; আবুদাউদ ১/২২১; নাসায়ী ২/২৩৩)
৪.
হযরত আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিবসের নামাযেরবিবরণ সম্বলিত একটি হাদীসে আছে-তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি দু’রাকাতেরমাঝে ব্যবধান করতেন আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতা এবং নবীরাসূল ও তাঁদের অনুসারীমুমিন্তমুসলমানদের জন্য তাসলীম (রহমত ও সালামতের দোয়ার) দ্বারা।’
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا كانت الشمس من ههنا كهيئتها من ههنا عند العصر صلى ركعتين وإذا كانت الشمس من ههنا كهيئتها عند الظهر صلى أربعا وصلى أربعا قبل الظهر وبعدها ركعتين وقبل العصر أربعا يفصل بين كل ركعتين بالتسليم على الملائكة المقربين والنبيين والمرسلين ومن تبعهم من المؤمنين والمسلمين.
(মুসনাদে আহমদ ১/৮৫; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৮০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৬৩;তিরমিযী ২/২৯৪, ৪৯৪; নাসায়ী ২/১২০; ইবনে মাজাহ ১/৩৬৭)
উপরোক্ত হাদীসে ‘তাসলীম’ দ্বারা তাশাহহুদ পাঠ বোঝানো হয়েছে। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ বলেন,দুই রাকাতের মাঝে তাসলীম দ্বারা তাশাহহুদ পাঠ বোঝানো হয়েছে ।
ومعنى أنه يفصل بينهن بالتسليم يعني التشهد
জামে তিরমিযী ২/২৯৪
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটিহাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছে আত্তাহিয়্যাতু।’ তদ্রূপ উম্মুল মুমিনীনউম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রতি দু’রাকাতে আছে (তাওহীদ ও রিসালাতের) সাক্ষ্যদান এবং (সকল) নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী আল্লাহরবান্দাদের জন্য সালাম।’
إن النبي صلى الله عليه وسلم قال : في كل ركعتين تشهد وتسليم على المرسلين وعلى من تبعهم من عباد الله الصالحين. وفيه : علي بن زيد، واختلف في الاحتجاج به، وقد وثق.
মুজামে কাবীর তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৩২
৫.
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নামাযেরমাঝে ও নামাযের শেষে তাশাহহুদ পাঠ করতে শিখিয়েছেন। তিনি বলতেন, যখন (নামাযী) নামাযেরমাঝে ও নামাযের শেষে নিতম্বের উপর বসবে তখন …।’’
علمني رسول الله صلى الله عليه وسلم التشهد في وسط الصلاة وفي آخرها فكان يقول إذا جلس في وسط الصلاة وفي آخرها على وركه.
মুসনাদে আহমদ ১/৪৫৯
৬.
উম্মে সালামা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতি দু’ রাকাতে রয়েছেতাশাহহুদ এবং রাসূল-নবী ও তাঁদের অনুসারী আল্লাহর নেকবান্দাদের প্রতি সালাম।’’
في كل ركعتين تشهد وتسليم على المرسلين وعلى من تبعهم من عباد الله الصالحين.
(মুজামে কাবীর, তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৩২)
৭.
আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অযু নামাযের চাবি,তাকবীর তার সূচনা ও সালাম তার সমাপ্তি। আর প্রতি দু’ রাকাতে সালাম পাঠ কর। অর্থাৎ তাশাহহুদপড়। আর নামায হয় না ফাতিহাতুল কিতাব ও কিছু অংশ ছাড়া।
والضوء مفتاح الصلاة والتكبير تحريمها والتسليم تحليلها وفي كل ركعتين فسل يعني فتشهد ولا تجزئ صلاة إلا بفاتحة الكتاب ومعها غيرها.
(কিতাবুল আছার, পৃ. ১৫৭) সুনানে দারাকুতনী ১/৩৬৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/৩৮০
৮.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, সকল নামাযে কিরাত আছে। আর আছে দু’ রাকাতে বসা এবংতাশাহহুদ ও তাসলীম। তুমি যদি তা আদায় না কর তাহলে তোমাকে সালাম ফিরিয়ে দু’টি সিজদা করতেহবে।’’
ليس من صلاة إلا وفيها قراءة وجلوس في الركعتين وتشهد وتسليم فإن لم تفعل سجدت سجدتين بعدما تسلم وأنت جالس.
মুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৭
৯.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, ‘‘দু’ রাকাতের পর ‘বিশ্রাম’ তো তাশাহহুদের জন্যই।’’
ما جعلت الراحة في الركعتين إلا للتشهد
মুসান্নাফ, ইবনে আবী শায়বা ৩/৪৭
এজন্যই নামাযের প্রতি দু’ রাকাতের পর বৈঠক করা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর মতে ফরয,ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মতে ওয়াজিব এবং ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর মতে সুন্নত।মাযহাবসমূহের বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক ওয়াজিব হওয়ার মতটি হলমাঝামাঝি ও ভারসাম্যপূর্ণ।
শরীয়ত যখন সকল নামাযের জন্য একটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছে তখন বিতরের নামাযও যে সেমূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোটকথা, বহু হাদীসে এ বিষয়টি রয়েছে যে, নামাযের প্রতি দু’ রাকাতে তাশাহহুদ পাঠ করতে হবে।সালাতুল লায়ল ও বিতর সংক্রান্ত ইবনে উমর রা.-এর হাদীসেও এই মূলনীতি উল্লেখিত হয়েছে। অতএববিতর নামাযকে তা থেকে খারিজ করার কোনো অবকাশ নেই।
দুই.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত মশহূর হাদীস-
صلاة الليل مثنى مثنى
‘‘রাতের নামায দুই রাকাত, দুই রাকাত’’ সালাতুল লায়ল ও বিতর সম্পর্কেই বলা হয়েছে। এই হাদীসথেকে দু’টি বিষয় বোঝা যায় :
১.
নামায সর্বনিম্ন দুই রাকাত। এর নীচে নামায নেই। এজন্য ফরয থেকেনফল কোনো নামাযই এক রাকাত পড়ার নিয়ম নেই। অতএব বিতর নামাযেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
২.
নামাযের প্রতি দু’ রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর জন্য বসা জরুরি। এটা ছাড়া দুই রাকাত সম্পন্ন হয় না।সহীহ মুসলিমে (১/২৫৭) আছে যে, ইবনে উমর রা.কে জিজ্ঞাসা করা হল, দুই রাকাত, দুই রাকাতকথাটার অর্থ কী? তিনি বললেন, প্রতি দু’ রাকাতের পর সালাম পাঠ করবে।’
قيل لابن عمر : ما مثنى مثنى؟ قال : أن تسلم في كل ركعتين.
এখানে সালাম পাঠ অর্থ আত্তাহিয়্যাতু পড়া। এই ব্যাখ্যা হাদীস শরীফ থেকেই পাওয়া যায়। ইতিপূর্বেতা আলোচনা করা হয়েছে।
তিন.
মুতাওয়াতির’ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতরপড়তেন। সা’দ ইবনে হিশামের বর্ণনায় একথাও আছে যে, দ্বিতীয় রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়তেন। তবেসালাম ফেরাতেন না। হুবহু এটিই হচ্ছে হানাফী মাযহাব।
আর হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. ও আরো যেসব সাহাবীর রেওয়ায়েতে পাঁচ, সাত বা নয় রাকাত বিতরপড়ার কথা আছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, এসব রেওয়ায়েতে বিতর ওতাহাজ্জুদের সমষ্টিকে বিতর শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
চার.
শরীয়তে এমন কোনো নামায নেই, যা শুধু এক রাকাত পড়া যায় কিংবা মাঝে তাশাহহুদ ছাড়া দু’রাকাতের অধিক আদায় করা যায়।
যারা বিতর নামাযে শরীয়তের এই মূলনীতিকে অস্বীকার করেন এবং রাবীদের তাবীর ও উপস্থাপনায়বিভ্রান্ত হয়ে বিতর নামায পাঁচ, সাত বা নয় রাকাত এক সালামে ও এক বৈঠকে আদায় করার ফতোয়াদেন তারা কি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতেরও এমন অর্থই করবেন? ইবনেআব্বাস রা. বলেন,আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আট রাকাত একসাথে ও সাতরাকাত একসাথে আদায় করেছি।’
صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ثمانيا جميعا وسبعا جميعا.
তারা কি বলবেন যে, যোহর-আসরের আট রাকাত এবং মাগরিব-ইশার সাত রাকাত এক বৈঠক ও একসালামে আদায় করা যাবে? তদ্রূপ যারা “বিতর এক রাকাত রাতের শেষে”-এই বর্ণনার ভিত্তিতে ফতোয়াদেন যে, বিতর এক রাকাত পড়াও জায়েয তারা কি হজ্ব হল আরাফা-এই হাদীসের ভিত্তিতে বলবেন যে,শুধু উকুফে আরাফা দ্বারাই হজ্ব সম্পন্ন হয়, অন্যান্য কাজকর্মের কোনো প্রয়োজন নেই?
যদি তারা এমন না বলেন এবং কোনো বর্ণনার বিশেষ উপস্থাপনার দ্বারা শুধু এই কারণে ভুলবোঝাবুঝির শিকার না হন যে, যোহর-আসর ও মাগরিব-ইশার নিয়ম তো সুবিদিত, তদ্রূপ হজ্বেরআরকান ও আহকাম সম্পর্কেও কোনো অস্পষ্টতা নেই তাহলে বিতরের ক্ষেত্রেও একথা মনে রাখাউচিত। কারণ মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা বিতর তিন রাকাত হওয়া এবং নামায বিষয়ক শরীয়তের উসূলও আদিল্লা দ্বারা প্রতি দু’ রাকাতের পর বৈঠক হওয়া সুপ্রমাণিত। অতএব বর্ণনাসমূহের ভাষাগতবিভিন্নতাকেও এরই আলোকে বুঝতে হবে। বর্ণনাকারীদের ভাষাগত বিভিন্নতাকে স্বতন্ত্র নীতি ও পদ্ধতিসাব্যস্ত করে মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সুবিদিত নিয়মকে অস্বীকার করা মোটেই যুক্তিসংগতচিন্তা নয়।
দুআয়ে কুনূত রুকুর আগে,না পরে?
এ বিষয়ে মতভেদ আছে যে, কুনূত শুধু বিতর নামাযেই পড়া হবে, না ফজরের নামাযেও; তদ্রূপ রুকুর আগে পড়া হবে, না রুকুর পরে। হানাফী মাযহবের আলিমগণ বলেন, বিতরের কুনূত সারা বছর পড়া হবে এবং রুকুর আগে পড়া হবে।
পক্ষান্তরে কুনূতে নাযেলা রুকুর পরে ও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় পড়া হবে। রুকুর আগেও রুকুর পরে কুনূত পড়া সংক্রান্ত রেওয়ায়েতসমূহের মাঝে হানাফী আলিমগণ এভাবেই সমন্বয় করে থাকেন।
সহীহ বুখারী ১/১৩৬, ‘বাবুল কুনূত কাবলার রুকু ওয়া বা’দাহ’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে আছে, ‘আসিম আহওয়াল বলেন, ‘আমি (হযরত) আনাস ইবনে মালিক রা.কে কুনূত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘কুনূত আছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, রুকুর আগে, না পরে? তিনি বললেন, ‘রুকুর আগে।’ আমি বললাম, জনৈক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, আপনি রুকুর পরে কুনূত পড়ার কথা বলেছেন? তিনি বললেন, ‘সে ভুল বলেছে। রুকুর পরে তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু এক মাস কুনূত পড়েছেন।’
حدثنا عاصم قال : سألت أنس بن مالك رضي الله عنه عن القنوت فقال : كانت القنوت، قلت : قبل الركوع أو بعده؟ قال : قبله، قلت : فإن فلانا أخبرني عنك إنك قلت : بعد الركوع، فقال : كذب، إنما قنت رسول الله صلى الله عليه وسلم بعد الركوع شهرا.
হযরত আনাস রা. থেকেই অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত কুনূত পড়েছেন। আবু বকর রা.ও মৃত্যু পর্যন্ত কুনূত পড়েছেন, উমর রা.ও মৃত্যু পর্যন্ত কুনূত পড়েছেন।’
إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قنت حتى مات، وأبو بكر رضي الله عنه حتى مات، وعمر رضي الله عنه حتى مات، رواه البزار، ورجاله موثقون.
(বাযযার-মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৩৯)
এই বর্ণনায় বিতরের কুনূতই উদ্দেশ্য। কারণ ফজরের কুনূত সর্বদা পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না; বরং বিপরীত বিষয়টি সহীহ বুখারীর উপরোক্ত হাদীস ছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এজন্য মুসনাদে আহমদ ও বাযযারের নিম্নোক্ত বর্ণনায় ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত (অর্থাৎ জীবনভর) ফজরের নামাযে কুনূত পড়েছেন।’
ما زال رسول الله صلى الله عليه وسلم يقنت في الفجر حتى فارق الدنيا.
‘ফিল ফজর’ শব্দটি রাবীর ভুল না হয়ে থাকলে কুনূতে নাযিলা উদ্দেশ্য।
মোটকথা, বহু হাদীসের ভিত্তিতে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত এই যে, কুনূতে নাযিলা, যা ফজরের নামাযে এবং (কখনো কখনো অন্য নামাযেও) পড়া হয় তা রুকুর পরে হবে আর তা হল বিশেষ পরিস্থিতির কুনূত। পক্ষান্তরে বিতরের কুনূত সর্বদা রুকুর আগে পড়া হবে। আর এটিই হচ্ছে সারা বছরের কুনূত।