জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আকীদা-শাস্ত্রের আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম ‘ইলমুল কালাম’। ইলমুল কালাম বলতে মূলত ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক আলোচনা বুঝানো হয়। ‘আল-কালাম’ (الكلام) শব্দের অর্থ কথা, বাক্য, বক্তব্য, বিতর্ক ইত্যাদি।
,
ইলমুল কালাম বলতে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা বা গবেষণা (speculative theology, scholastic theology) বুঝানো হয়।
,
★দর্শনশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, কালাম শাস্ত্র অধ্যায়ন ও চর্চা করার বিধান সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের মাঝে কয়েক রকমের মতামত পাওয়া যায়।
এক, হারাম।
দুই, শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
وَعَنِ الحَسَنِ بنِ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا، قَالَ: حَفِظتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيبُكَ »
হযরত আলী রাঃ এর পুত্র হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে (এ হাদীস) স্মরণ রেখেছি, ‘‘তা বর্জন কর, যা তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা গ্রহণ কর, যাতে তোমার সন্দেহ নেই।’’
(তিরমিযী ২৫১৮, নাসায়ী ৫৭১১, আবূ দাউদ ২৭৮১৯, দারেমী ২৫৩২)
قال ابن عابدين: هو منطق الإسلاميين الذي مقدماته قواعد إسلامية فلا وجه للقول بحرمته.
সারমর্মঃ এই বিদ্যা শিক্ষা অর্জন হারাম হওয়া নিয়ে কোনো কথার দরকার নেই।
.
وقال صاحب منح الجليل: ومما يتوقف العلم الشرعي عليه
এই ইলমের উপর শরয়ী ইলম মওকুফ থাকে।
قال ابن عابدين في رد المحتار: روي عن الإمام الشافعي رحمه الله أنه قال: (لأن يلقى الله عبد بأكبر الكبائر خير من أن يلقاه بعلم الكلام)
,
এই বিষয়ে কিছু ইসলামী স্কলার বলেছেনঃ
প্রাচীন যুগ থেকে দার্শনিকগণ মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শনের মাধ্যমে মানবীয় ইন্দ্রিয়ের অজ্ঞাত বিষয় সমূহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্রষ্টা, সৃষ্টি, সৃষ্টির প্রকৃতি, স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তি তর্ক দিয়ে তাঁরা অনেক কথা বলেছেন। এ সকল বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্ক মানুষকে অত্যন্ত আকর্ষিত করলেও তা কোনো সত্যে পৌঁছাতে পারে না। কারণ মানুষ যুক্তি বা জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে বা নিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে পারে না। এজন্য কখনোই দার্শনিকগণ এ সকল বিষয়ে একমত হতে পারেন নি। তাদের গবেষণা ও বিতর্ক অন্ধের হাতি দেখার মতই হয়েছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিক দর্শন প্রচার লাভ করে। মূলধারার তাবিয়ীগণ ও তাঁদের অনুসারীগণ বিশ্বাস বা গাইবী বিষয়ে দার্শনিক বিতর্ক কঠিনভাবে অপছন্দ করতেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, গাইবী বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করা এবং ওহীর নির্দেশনাকে মেনে নেওয়াই মুমিনের মুক্তির পথ।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সহচরগণ ‘ইলমুল কালামৎ শিক্ষা করতে ঘোর আপত্তি করেছেন। ইলমুল কালামের প্রসার ঘটে মূলত দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথমাংশে, বিশেষত ১৩২ হিজরী (৭৫০ খৃ) সালে আববাসী খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পর। ইমাম আবূ হানীফা শিক্ষা জীবনে বা তাঁর জীবনের প্রথম ৩০ বৎসরে (৮০-১১০ হি) দর্শনভিত্তিক ইলমুল কালাম সমাজে তেমন পরিচয় লাভ করে নি। তবে দর্শনভিত্তিক বিভ্রান্ত মতবাদগুলো তখন কুফা, বসরা ইত্যাদি এলাকায় প্রচার হতে শুরু করেছে। গ্রীক-পারসিক দর্শন নির্ভর কাদারিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া ইত্যাদি মতবাদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকেই জন্ম লাভ করে। এ সকল মতবাদ খন্ডন করতে মূলধারার কোনো কোনো আলিম দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর যুক্তি-তর্কের আশ্রয় নিতে থাকেন।
কোনো কোনো জীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথম জীবনে এরূপ দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর বিতর্ক বা ইলমুল কালামের চর্চা করেন। পরবর্তীতে তিনি তা বর্জন করেন এবং তা বর্জন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। ইলমুল কালামের প্রাথমিক অবস্থাতেই তিনি এর ক্ষতি ও ভয়াবহতা অনুধাবন করতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
كنت أعطيت جدلا فى الكلام ... فلما مضى مدة عمري تفكرت وقلت السلف كانوا أعلم بالحقائق ولم ينتصبوا مجادلين بل أمسكوا عنه وخاضوا فى علم الشرائع ورغبوا فيه وتعلموا وعلموا وتناظروا عليه فتركت الكلام واشتغلت بالفقه ورأيت المشتغلين بالكلام ليس سيماهم سيماء الصالحين قاسية قلوبهم غليظة أفئدتهم لا يبالون بمخالفة الكتاب والسنة ولو كان خيرا لاشتغل به السلف الصالحون
‘‘কালাম বা দর্শনভিত্তিক বিতর্কে আমার পারদর্শিতা ছিল ... আমার জীবনের কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমি চিন্তা করলাম যে, পূর্ববর্তীগণ (সাহাবীগণ ও প্রথম যুগের তাবিয়ীগণ) দীন-ঈমানের প্রকৃত সত্য বিষয়ে অধিক অবগত ছিলেন। তাঁরা এ সকল বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন নি। বরং ঈমান-আকীদা বিষয়ক বিতর্ক তাঁরা পরিহার করতেন। তাঁরা শরীয়ত বা আহকাম বিষয়ে আলোচনা ও অধ্যয়নে লিপ্ত হতেন, এগুলোতে উৎসাহ দিতেন, শিক্ষা করতেন, শিক্ষা দিতেন এবং এ বিষয়ে বিতর্ক- আলোচনা করতেন। এজন্য আমি কালাম পরিত্যাগ করে ফিকহ চর্চায় মনোনিবেশ করি। আমি দেখলাম যে, কালাম বা দর্শনভিত্তিক আকীদা চর্চায় লিপ্ত মানুষগুলোর প্রকৃতি ও প্রকাশ নেককার মানুষদের মত নয়। তাদের হৃদয়গুলো কঠিন, মন ও প্রকৃতি কর্কশ এবং তারা কুরআন ও সুন্নাতের বিরোধিতা করার বিষয়ে বেপরোয়া। কালাম চর্চা যদি কল্যাণকর হতো তাহলে অবশ্যই পূর্ববর্তীগণ (সাহাবী-তাবিয়ীগণ) এর চর্চার করতেন।’’
কুরাশী, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা, ৪৬৮।
,
ইমাম আবূ ইউসূফ রাহ. (১৮৯ হি) তাঁর ছাত্র ইলমুল কালামের বিশেষজ্ঞ ও মু’তাযিলী পণ্ডিত বিশ্র আল-মারীসী (২১৮ হি)- কে বলেন:
اَلْعِلْمُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْجَهْلُ وَالْجَهْلُ بِالْكَلاَمِ هُوَ الْعِلْمُ، وَإِذَا صَارَ الرَّجُلُ رَأْساً فِيْ الْكَلاَمِ قِيْلَ: زِنْدِيْقٌ.
‘‘কালামের জ্ঞানই হলো প্রকৃত অজ্ঞতা আর কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত জ্ঞান। ইলমুল কালামে সুখ্যাতির অর্থ তাকে যীনদীক বা অবিশ্বাসী-ধর্মত্যাগী বলা হবে।’’
(ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫)
ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) আরো বলেন:
مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ بِالْكَلاَمِ تَزَنْدَقَ
‘‘যে ব্যক্তি ইলমু কালাম শিক্ষা করবে সে যিনদীকে পরিণত হবে।’’
(ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫)
ইমাম শাফিয়ী রাহ. (২০৪ হি) বলেন,
حُكْمِيْ فِيْ أَهْلِ الْكَلاَمِ أَنْ يُضْرَبُوا بِالْجَرِيْدِ وَالنِّعَالِ وَيُطَافُ بِهِمْ فِيْ الْعَشَائِرِ وَالْقَبَائِلِ وَيُقَالُ: هَذَا جَزَاءُ مَنْ تَرَكَ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ وَأَقْبَلَ عَلَى الْكَلاَمِ.
‘‘যারা ইলমুল কালাম চর্চা করে তার বিষয়ে আমার বিধান এই যে, তাদেরকে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটাতে হবে, এভাবে মহল্লায় মহল্লায় ও কবীলাসমূহের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে এবং বলতে হবে: যারা কিতাব ও সুন্নাত ছেডে ইলমুল কালামে মনোনিবেশ করে তাদের এ শাস্তি।’’
(ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭৫)
এভাবে প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ইমাম এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের সকল প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ইলমুল কালামের নিন্দা করেছেন।
(গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।)
পরবর্তী যুগে ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ইমামের অনুসারী অনেক আলিম আহলুস সুন্নাতের আকীদা ব্যাখ্যার জন্য ইলমুল কালাম চর্চা করেছেন। বিভ্রান্ত ফিরকাসমূহের বিভ্রান্তির উত্তর প্রদানের প্রয়োজনেই তাঁরা ইলমুল কালামের পরিভাষা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন।
( গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবন আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।)
,
★দারুল উলুম দেওবন্দ এর ৪১৫৭৮ নং ফতোয়ায় এসেছে যে দ্বীনের উপর মজবুতির সহিত আমল,উলামায়ে কেরামদের সাহচর্য এ থাকা, আকীদা ঠিক থাকা ইত্যাদির পর হক্কানী উলামায়ে কেরামদের লিখিত এ সংক্রান্ত কিতাব,বই পড়া যাবে।
,
শর্ত হলো কোনোভাবেই যেনো আকীদা নষ্ট না হয়।