হাদীস শরীফে এসেছেঃ
وَعَنِ النَّوَّاسِ بْنِ سَمْعَانَ قَالَ: سَأَلَتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْبِرِّ وَالْإِثْمِ فَقَالَ:الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِىْ صَدْرِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
নাও্ওয়াস ইবনু সাম্‘আন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ পুণ্য হলো উত্তম স্বভাব, আর পাপ হলো যা তোমার অন্তরে যাতনা সৃষ্টি করে এবং তুমি ঐ কাজ জনসমাজে প্রকাশ হওয়াকে খারাপ মনে করো।
সহীহ : মুসলিম ১৪-(২৫৫৩), তিরমিযী ২৩৮৯, সহীহুল জামি‘ ২৮৮০, সহীহ আত্ তারগীব ১৭৩৩, সহীহ আল আদাবুল মুফরাদ ২২৬, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শায়বাহ্ ২৫৩৩৫, আহমাদ ১৭৬৩১, শু‘আবুল ঈমান ৭২৭৩, দারিমী ২৭৮৯, আল মুসতাদরাক ২১৭২, আস্ সুনানুল কুবরা ২১৩০৫।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ-
(الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ) এখানে الْبِرُّ শব্দের বিভিন্ন তাফসীর করা হয়েছে। এক স্থানে তাফসীর করা হয়েছে যে, যেখানে আত্মা ও অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। অন্যস্থানে ঈমানের স্থানে তাফসীর করা হয়েছে। অন্যস্থানে যেটা আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয় আর এই দু’টিই হলো (حُسْنُ الْخُلُقِ) বা উত্তম চরিত্র। উত্তম চরিত্রের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে তা হলো কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা, রাগ কমিয়ে ফেলা, হাসি-খুশি থাকা, ভালো কথা বলা, আর এ সবগুলো চরিত্রের মধ্যে শামিল।
ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ এখানে الْبِرُّ হলো সদাচরণ, দান করা, আনুগত্য করা যার সমষ্টি হয় (حُسْنُ الْخُلُقِ) বা উত্তম চরিত্র। কোন কোন মুহাক্কিক ‘আলিম বলেছেন, الْبِرُّ বলা হয়, এমন সমষ্টিগত নামকে যা সকল প্রকার আনুগত্য ও সকল প্রকার নৈকট্যমূলক কর্মকাণ্ডকে শামিল করে নেয়। আর এখান থেকেই বলা হয় بِرُّ الْوَالِدَيْنِ বা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(حَاكَ فِي صَدْرِكَ) অর্থাৎ বুকে নাড়া দেয় ও সন্দিহান হয়। আর তার বক্ষ তাকে কাজটি করার অনুমোদন দেয় না, বরং তার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, সে মনে মনে ভয় পায় যে, এ কাজটি করলে হয়ত তার পাপ হবে। (শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ১৪/২৫৫৩)
(وَكَرِهْتَ أَن يطلع عَلَيْهِ النَّاس) অর্থাৎ তারা নিজেদের চোখ দিয়ে দেখুক বা অন্য কোন কিছু দিয়ে দেখুক (হয়ত বা সিসি ক্যামেরা)। এখানে النَّاس এর ‘আলিফ’ ‘লাম’ جنس (জিনস্) এর জন্য এসেছে। আর জিনস্ বা জাতি পরিপূর্ণতার দিকেই ফিরে। এর কারণ, মানুষের স্বভাব হলো তার মন চায় মানুষ তার ভালোটা লক্ষ্য করুক। আর যখন সে তার কোন কোন কাজ অন্য কেউ দেখুক এটা অপছন্দ করে তখন বুঝতে হবে এ কাজটি তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করাবে না। অথবা এ কাজটি করার জন্য শারী‘আত তাকে অনুমোদন দেয়নি। বুঝতে হবে যে, এ কাজে তার কোন কল্যাণ নেই। এটা ভালো কাজ নয়। সুতরাং এ কাজটি পাপ ও অকল্যাণকর। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩৮৯)
وَعَنْ وَابِصَةَ بْنِ مَعْبَدٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ : «يَا وَابِصَةُ جِئْتَ تَسْأَلُ عَنِ الْبِرِّ وَالْإِثْمِ؟» قُلْتُ : نَعَمْ قَالَ : فَجَمَعَ أَصَابِعَه فَضَرَبَ صَدْرَه وَقَالَ : «اسْتَفْتِ نَفْسَكَ اسْتَفْتِ قَلْبَكَ» ثَلَاثًا «الْبِرُّ مَا اطْمَأَنَّتْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَاطْمَأَنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِى النَّفْسِ وَتَرَدَّدَ فِى الصَّدْرِ وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالدَّارِمِىُّ
ওয়াবিসাহ্ ইবনু মা‘বাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উদ্দেশে বললেন, হে ওয়াবিসাহ্! তুমি তো আমাকে ভালো ও মন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছো। আমি উত্তরে বললাম, জি হ্যাঁ (হে আল্লাহর রসূল!)। বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিজ আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে আমার সিনার উপর রেখে বললেন, তুমি তোমার অন্তরকে জিজ্ঞেস কর- এ কথাগুলো তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনবার বললেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যে কাজে অন্তর স্থির থাকবে, যে কাজে অন্তর খুশী ও দ্বিধামুক্ত হয়, তাই ভালো কাজ। আর যে কাজে অন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লাগবে, অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হবে, তাই মন্দ বা পাপ কাজ। যদিও জনগণ তাতে তোমাকে সমর্থন করে।
(আহমাদ ১৮০০৬, দারিমী ২৫৭৫,মিশকাতুল মাসাবিহ ২৭৭৪)
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
ব্যাখ্যা: (الْبِرُّ مَا اطْمَأَنَّتْ إِلَيْهِ النَّفْسُ وَاطْمَأَنَّ إِلَيْهِ الْقَلْبُ) ‘‘সৎকাজ যাতে মনে ও অন্তরে প্রশান্তি আসে’’। ‘আল্লামা কাযী (রহঃ) বলেনঃ কোনো ব্যক্তির নিকট যখন কোনো বিষয় অস্পষ্ট হয় ও মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে এবং সে বুঝতে পারে না কোনটি ঠিক আর কোনটি বেঠিক তাহলে সে নিজেই যদি মুজতাহিদ হয় তাহলে সে বিষয়ে গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা-ভাবনা করবে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য। আর যদি নিজে মুজতাহিদ না হয়, তাহলে মুজতাহিদ ব্যক্তির নিকট থেকে জেনে নিবে। অতঃপর তার হৃদয় মন যা নিশ্চিন্তে গ্রহণ করতে চায় তা গ্রহণ করবে। আর যদি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে না পারে তাহলে তা পরিত্যাগ করবে। আর যাতে কোনো সন্দেহ নেই সে বিষয়ের উপর ‘আমল করবে।
(وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِى النَّفْسِ) ‘‘আর তাই গুনাহ যা তোমার মন গুনাহ বলে সন্দেহ করে।’’ ‘আল্লামা জামাখশারী বলেনঃ যা তোমার মনে গুনাহ বলে দাগ কাটে বা তোমার চিন্তায় আসে যে, তা গুনাহের কাজ তবে তা গুনাহ।
(تَرَدَّدَ فِى الصَّدْرِ) ‘‘তোমার হৃদয় দ্বিধায় পড়ে।’’ অর্থাৎ হৃদয় খুশী মনে তা গ্রহণ না করে। আর এ অবস্থা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আল্লাহ তা‘আলা যার হৃদয়কে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
(وَإِنْ أَفْتَاكَ النَّاسُ) ‘‘যদিও লোকেরা তা হালাল বলে ফতোয়া দেয়।’’ অর্থাৎ লোকেরা বলে যে, তা হক বা সঠিক, তবুও তুমি তাদের কথা গ্রহণ করবে না। কেননা তাদের কথা তোমাকে ভুলের মধ্যে ফেলতে পারে। কোনো ব্যক্তির হারাম মালও আছে এবং হালাল মালও আছে বলে তোমার জানা আছে আর কোনো মুফতী যদি ফতোয়া দেয় তার মাল নেয়া বা খাওয়া বৈধ, তবুও তুমি তা থেকে বিরত থাকবে। কেননা তুমি নিশ্চিন্ত নও যে, সে তোমাকে যে মাল দিয়েছে তা হালাল না হারাম। (মিরকাতুল মাফাতীহ)