সুরা ইউসুফের ১০৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ مِّنۡ اَهۡلِ الۡقُرٰی ؕ اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ؕ وَ لَدَارُ الۡاٰخِرَۃِ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۰۹﴾
আর আমি তোমার পূর্বে জনপদবাসী থেকে পুরুষদেরকেই কেবল রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের উপর আমি ওহী নাযিল করতাম। তারা কি যমীনে বিচরণ করে না। তাহলে দেখত, তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের পরিণতি কিরূপ হয়েছে? আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাসনই উত্তম, তবুও কি তোমরা বুঝ না?
এই আয়াতের ব্যখ্যায় বলা হয়েছেঃ
এ আয়াতেই (أَهْلِ الْقُرَىٰ) শব্দ দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহ্ তা'আলা সাধারণতঃ শহর ও নগরবাসীদের মধ্য থেকে পুরুষদেরকেই রাসূল প্রেরণ করেছেন; কোন গ্রাম কিংবা বনাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্য থেকে রাসূল প্রেরিত হননি। কারণ, সাধারণতঃ গ্রাম বা বনাঞ্চলের অধিবাসীরা স্বভাব-প্রকৃতি ও জ্ঞান-বুদ্ধিতে নগরবাসীদের তুলনায় পশ্চাতপদ হয়ে থাকেন। [ইবন কাসীর] ইয়াকুব আলাইহিস সালামও শহরবাসী ছিলেন, কিন্তু কোন কারণে তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। তাই কুরআনের সূরা ইউসুফেরই ১০০ নং আয়াতে তাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতে কাফেরদের একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে, যেখানে তারা ফিরিশতার উপর এ কুরআন নাযিল হলো না কেন তা জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর দেয়া হচ্ছে যে, আমি তো কেবল নগরবাসী পুরুষদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি। [কুরতুবী]
এ আয়াতে নবীগণের সম্পর্কে رِجَالًا শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে, নবী সবসময় পুরুষই হন। নারীদের মধ্যে কেউ নবী বা রাসূল হতে পারে না। মূলত: এটাই বিশুদ্ধ মত যে, আল্লাহ তা'আলা কোন নারীকে নবী কিংবা রাসূল হিসেবে পাঠাননি। কোন কোন আলেম কয়েকজন মহিলা সম্পর্কে নবী হওয়ার দাবী করেছেন; উদাহরণতঃ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বিবি সারা, মূসা আলাইহিস সালাম এর জননী এবং ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জননী মরিয়ম। এ তিন জন মহিলা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে এমন ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে, যা দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে ফিরিশতারা তাদের সাথে বাক্যালাপ করেছে, সুসংবাদ দিয়েছে কিংবা ওহীর মাধ্যমে স্বয়ং তারা কোন বিষয় জানতে পেরেছেন। কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক আলেমের মতে এসব আয়াত দ্বারা উপরোক্ত তিন জন মহিলার মাহাত্ম্য এবং আল্লাহর কাছে তাদের উচ্চ মর্যাদাশালিনী হওয়া বোঝা যায় মাত্র। এই ভাষা নবুওয়াত ও রেসালাত প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। [ইবন কাসীর]
সুরা মায়েদার ৭৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
مَا الۡمَسِیۡحُ ابۡنُ مَرۡیَمَ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِهِ الرُّسُلُ ؕ وَ اُمُّهٗ صِدِّیۡقَۃٌ ؕ کَانَا یَاۡکُلٰنِ الطَّعَامَ ؕ اُنۡظُرۡ کَیۡفَ نُبَیِّنُ لَهُمُ الۡاٰیٰتِ ثُمَّ انۡظُرۡ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ ﴿۷۵﴾
মাসীহ ইবনে মারইয়াম একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তার পূর্বে আরও বহু রাসূল গত হয়েছে, আর তার মা একজন পরম সত্যবাদিনী, তারা উভয়ে খাদ্য আহার করত। লক্ষ্য কর! আমি কিরূপে তাদের নিকট প্রমাণসমূহ বর্ণনা করছি। আবার লক্ষ্য কর! তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে?
صديقة শব্দের অর্থ; মু’মিন ও অলী। অর্থাৎ, তিনিও ঈসা (আঃ)-এর উপর ঈমান আনয়নকারী এবং তাঁকে সত্যজ্ঞানকারীদের একজন ছিলেন। আর তার অর্থ এই যে, তিনি নবী ছিলেন না। যেমনটি কিছু লোকের ধারণা, যাঁরা মারয়্যাম (‘আলাইহাস্ সালাম) সহ (ইসহাক (আঃ)-এর জননী) সারাহ এবং মূসা (আঃ)-এর জননীকে নবী ছিলেন বলে মনে করেন।
আর এর প্রমাণে তাঁরা বলেন যে, প্রথমোক্ত দুই জনের সাথে ফিরিশতাগণের কথোপকথন হয়। আর মূসা (আঃ)-এর জননীর সাথে স্বয়ং আল্লাহ অহী করেন। আর এই কথোপকথন ও অহী উভয়ই নবী হওয়ারই প্রমাণ। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এ প্রমাণ বা দলীল এমন নয়, যা কুরআনের স্পষ্ট উক্তির মোকাবেলা করতে পারে। মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, ‘‘আমি যত রসূল পাঠিয়েছি সকলেই পুরুষ ছিল। (সূরা ইউসুফ ১০৯)
কিছু কুরআনের কপিতে কিছু ওয়াকফের জায়গাকে আয়াত ধরা হয়েছে,কিছু কপিতে সেগুলো শুধু মাত্র ওয়াকফের জায়গা হিসেবেই রাখা হয়েছে।
কুরআনুল মাজীদের আয়াতসংখ্যা গণনার জন্য একটি বিশেষ শাস্ত্র আছে যার মাধ্যমে কুরআন কারীমের প্রত্যেক সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ও পুরো কুরআন মাজীদের মোট আয়াত সংখ্যা জানা যায় যাকে ইলমুল কিরা’আত(علم القراءت) ও ইলমুল তাজওয়ীদের(علم التجويد) ইমামগণ ইলমু আদাদি আয়াতিল কুরআন ) (علم عد د الآيات القرآنবলে জানে। যার অন্যতম বিষয় হলো ফাওয়াসিলুল আয়াত (فواصل الآيات) বা আয়াতের সূচনা-পরিসমাপ্তি জানা। বলে রাখা ভালো যে, এই শাস্ত্র উলুমূল কুরআনের অন্যতম একটি পৃথক শাখা শাস্ত্র।
ইলমে আদাদ এটি রাসুলুল্লাহর(ﷺ) শিক্ষার ফসল। তিনি(ﷺ) সাহাবাদের (রাদিয়াল্লাহু আযমাঈন) যে শিক্ষা দিয়েছেন তারই ফসল হলো এই ইলমে আদাদ। কুরআনুল কারীম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহর(ﷺ) উপর দীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনার ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিলো। বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন অংশ এভাবে বিভিন্ন সময় নাযিল হতে থাকে। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ও তার সাহাবীরা সেই আয়াত হিফজ (মুখস্ত) করে নিতেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহুম আজমাঈন) আয়াত মূখস্থ করার পাশাপাশি তা কোন সূরার অংশ, কোন আয়াতের শুরু কোথা থেকে শুরু হয়েছে বা কোন আয়াত কোথায় শেষ হয়েছে তা ও হিফজ করে নিতেন। পরবর্তীতে প্রজন্ম পরম্পরায় তাদের কাছ থেকে তাবিঈ ও তাবিঈদের থেকে তাবি-তাবিঈনরা কুরআন এভাবেই শিখে নিয়েছেন, এবং পরবর্তীতে তাঁদের থেকে ইলমুল কিরাআতের ইমামগণ এভাবেই শিখেছেন আর সেভাবেই এই সংক্রান্ত কিতাবসমূহে ব্যাপকভাবে ও অসংখ্য হাদীছ ও আছার দ্বারা বর্ণিত হয়ে এসেছে।
সাধাণত কয়েক ধরনের বা এলাকার গণনা পদ্ধতি প্রসিদ্ধ।
(১) মাদানী গণনাঃ
মাদানী গণনা দুই ধরনের
(ক) প্রথম মাদানী গণনা (المدني الأول):
এই গণনা পদ্ধতি ইমাম নাফি ইবনে আবি নুয়াইম মাদানী(মৃ ১৬৯হি) আবু ইয়াযীদ ইবনে কা’কা(মৃ ১৩২হি) এবং শাইবা ইবনে নিসাহ(মৃ ১৩০হি) থেকে বর্ণনা করেন। এই গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী কুরআনের আয়াত সংখ্যা ৬২১৭।
(খ) দ্বিতীয় মাদানী গণনা(المدني الثاني):
এই গণনা পদ্ধতি ইমাম ইসমাঈল ইবনে জাফর মাদানী (মৃ ১৮০হি) সুলায়মান ইবনে মুসলিম ইবনে জামমায থেকে বর্ণনা করেন এবং তিনি(সুলাইমান) আবু জাফর (মৃ ১৩২হি) ও শাইবা ইবনে নিসাহ (মৃ ১৩০হি) থেকে বর্ণনা করেন। এই গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী আয়াত সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২১৪ বা ৬২১০টি।
(২) মক্কী গণনাঃ
এই গণনা পদ্ধতির ভিত্তি হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে কাছীর (মৃ ১২০হি)।
(৩) শামী গণনাঃ
এই গণনা পদ্ধতির ভিত্তি হলেন ইয়াহইয়াহ ইবনে হারিছ আযযিমারী (মৃ ১৪৫হি) এই গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী মোট আয়াত সংখ্যা ৬২২৬টি।
(৪) বসরী গণনাঃ
এই গণনার ভিত্তি হলেন আইয়ুব ইবনে মুতাওয়াক্কিল ও আসেম আলজাহদারী, তারা দুজনেই ইলমের কিরায়াতের ইমাম ছিলেন। এই গণনায় আয়াত সংখ্যা ৬২০৪টি।
(৫) কুফী গণনাঃ
এই গণনার মূল বর্ণণাকারী হলেন তাবিঈ আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী (মৃ ৭৪হি)। এই গণনা পূর্বে এবং বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলো এবং এখনও আছে। এর গণনা পদ্ধতিতে আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬টি, এই গণনা অনুযায়ীই সাধারণত বর্তমানে মুসহাফগুলোতে [পূর্ণ কুরআনের কপি] চিহ্ন দেওয়া হয়ে থাকে।
ইলমুল আদাদ বা কুরআনের আয়াতসংখ্যার শাস্ত্রের উপর ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই প্রচুর বই-পত্র রচিত হয়ে আসছে। প্রায় শতাধিক বিখ্যাত বই এই শাস্ত্র নিয়ে রচিত হয়েছে। নিম্নে অঞ্চলভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ভিত্তিক কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করা হলোঃ
মদীনাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী (أهل المدنية):
১। কিতাবু আদাদিল মাদানিয়্যিল আওয়াল লিন নাফি (كتاب عدد المدني الأول لنافع)
২। কিতাবুল আদাদিছ ছানি আন নাফি (كتاب العدد الثاني عن نافع)
৩। কিতাবুল আদাদ লি ঈসা (كتاب العدد لعيسى)
৪। কিতাবু ইসমাঈল বিন আবি কাছির ফি মাদানীয়্যিল আখির (كتاب إسماعيل بن أبي كثير في مدني الأخر)
মক্কাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী (أهل مكه):
১। কিতাবুল আদাদ লি আতা বিন ইয়াসার (كتاب العدد لعطاء بن يسار)
২। খলফ বাজ্জার (خلف البزار)
কুফাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী (أهل الكوفة)
১। কিতাবুল আদাদ লি খলফ (كتاب العدد لخلف)
২। কিতাবুল আদাদ লি মুহাম্মাদ বিন ঈসা (كتاب العدد لمحمد بن عيسى)
বসরাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী (أهل البصرة):
১। কিতাবুল হাসান বিন হাসান ফিল আদাদ (كتاب الحسن بن أبي حسن في العد د)
শামবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী (أهل الشام):
১। কিতাবু খালিদ বিন মাদান (كتاب خالد بن مدان)
২। কিতাবু ইয়াহইয়াহ ইবনুল হারিছ আযযামারী (كتاب يحيي بن الحارث الذماري)
অভিযোগকারীরা বলেন কুরআন সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় নি সেই কারণেই কুরআনের আয়াত গণনায় পার্থক্য হয়েছে (আস্তাগফিরুল্লাহ)। বিভিন্ন গণনা পদ্ধতির মধ্যে মতপার্থক্যের কিছু উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক এতে করে তাদের অভিযোগের অন্তসারশূন্যতার ও পরিচয় অধিক পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই আয়াত সংখ্যায় কিভাবে মতপার্থক্য হয়ে থাকে বা এই মতপার্থক্যের স্বরুপ কি তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
আয়াত সংখ্যায় সাধারনত নিম্নবর্ণিত উপায়ে মতপার্থক্য হয়ে থাকেঃ---
· আয়াত গণনা পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য;
· আয়াত গণনা পদ্ধতি এক হলেও আয়াতের সূচনা-শেষ নির্ধারনে(فواصل) মতভেদ হওয়ার কারণে;
কিছু উদাহরণ দেখি।
সূরা ইখলাসঃ
١. قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ، ٢. اللَّهُ الصَّمَدُ، ٣. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، ٤. وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
সূরা ইখলাসে আছে ৪টি আয়াত, কূফী, বাসরী, মাদানী (১ম ও ২য়) গণনা পদ্ধতিতে এই সূরাতে ৪ টি আয়াত আছে। তবে মক্কী ও শামী গণনা পদ্ধতিতে এই সূরার সংখ্যা ৫টি। কিভাবে? আসুন দেখে নিই।
١.قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَد، ٢. اللَّهُ الصَّمَد، ٣. لَمْ يَلِدْ، ٤. وَلَمْ يُولَدْ، ٥. وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَد
এটি মক্কী ও শামী গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী সূরা ইখলাস যেখানে ৫টি আয়াত দেখা যাচ্ছে। এটা কি এই কারণে যে এই গণনাতে একটি অতিরিক্ত আয়াত সংযুক্ত হয়েছে(নাউযুবিল্লাহ), মোটেও নয়। বরং এখানে দেখা যাচ্ছে যে, কূফী, বাসরী ও মাদানী(১ম ও ২য় উভয়) পদ্ধতিতে (لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَد) এই অংশটিকে একটি আয়াত হিসেবে গন্য করা হয়েছে যেখানে মক্কী ও শামী গণনায় (لَمْ يَلِدْ) অংশকে ১টি ও (وَلَمْ يُولَد) অংশকে আরেকটি পৃথক আয়াত হিসেবে গন্য করা হয়েছে। কোনো প্রকার সংযোজন বা বিয়োজনের কারণে এই পার্থক্য ঘটেনি। আরেকটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাকঃ-
সূরা কুরাইশঃ-
١. لِإِيلَـٰفِ قُرَيْشٍ ، ٢. إِۦلَـٰفِهِمْ رِحْلَةَ ٱلشِّتَآءِ وَٱلصَّيْفِ ، ٣. فَلْيَعْبُدُوا۟ رَبَّ هَـٰذَا ٱلْبَيْتِ ، ٤. ٱلَّذِىٓ أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍۢ وَءَامَنَهُم مِّنْ خَوْفٍۭ
কূফী, বাসরী ও শামী এই তিন গণনা পদ্ধতিতে সূরা কুরাইশের আয়াত সংখ্যা ৪ যা আমরা উপরে দেখলাম। আর মক্কী ও মাদানী(১ম ও ২য়) গণনা পদ্ধতিতে এই সূরার আয়াত সংখ্যা ৫টি। কিভাবে??
١. لِإِيلَـٰفِ قُرَيْشٍ ، ٢. إِۦلَـٰفِهِمْ رِحْلَةَ ٱلشِّتَآءِ وَٱلصَّيْفِ ، ٣. فَلْيَعْبُدُوا۟ رَبَّ هَـٰذَا ٱلْبَيْتِ ، ٤. ٱلَّذِىٓ أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍۢ ، ٥.وَءَامَنَهُم مِّنْ خَوْفٍۭ
এই গণনা পদ্ধতিটি মক্কী ও মাদানীর। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, উপরের কূফী, বাসরী ও শামী এই তিন পদ্ধতির গণনা পদ্ধতিতে (الذي أطعمهم من جوع وآمنهم من خوف) এই অংশটিকে পরিপূর্ণ একটি আয়াত হিসেবে গন্য করা হলে ও বাকী দুই পদ্ধতি অর্থাৎ, মক্কী ও মাদানী গণনা পদ্ধতিতে (الذي أطعمهم من جوع) কে একটি ও (وآمنهم من خوف) কে আরেকটি আলাদা আয়াত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে মূল পাঠ সবসময়ই এক ও অভিন্নই রয়েছে। কোনো সংযোজন বা বিয়োজনের কারণে এই পার্থক্য হয়নি।
সূরা আসরঃ-
١. وَٱلْعَصْرِ، ٢. إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَفِى خُسْرٍ، ٣. إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلصَّبْرِ
সূরা আসরের আয়াত সংখ্যা সকল প্রকার গণনা পদ্ধতি অনুসারেই ৩টি। দ্বিতীয় মাদানী গণনা ছাড়া সকল প্রকার গণনা পদ্ধতিতেই এই ভাবেই আয়াতের সূচনা-শেষ বা ফাওয়াসিল(فواصل) নির্ধারন করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় মাদানী পদ্ধতিতে নিম্নরুপ ভাবে ফাওয়াসিল (فواصل) নির্ধারন করা হয়েছে।
١. وَٱلْعَصْرِ إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَفِى خُسْرٍ، ٢. إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ، ٣. وَتَوَاصَوا بِٱلصَّبْرِ
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, দ্বিতীয় মাদানী ছাড়া অন্যান্য সকল গণনায় (وَٱلْعَصْر) ও (إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَفِى خُسْرٍ) কে আলাদা আয়াত গণনা করা হয়েছে তবে মাদানী দ্বিতীয় পদ্ধতিতে দুইটি অংশকে একত্রে একটি আয়াত বলে পরিগনিত করা হয়েছে। আবার মাদানী দ্বিতীয় পদ্ধতিতে (وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ) ও (وَتَوَاصَوا بِٱلصَّبْر) কে আলাদা আয়াত হিসেবে গন্য করা হলেও অন্যান্য সকল পদ্ধতিতে এই অংশটিকে একটি আয়াত হিসেবেই ধরা হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কুরআনের আয়াত সংখ্যার মতপার্থক্য কখনোই কুরআনের মূলপাঠের ভিন্নতা বা আয়াত কম-বেশি হওয়ার কারণে হয়নি বরং তা অন্য কোনো ভিন্ন কারণে হয়েছে যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমাদ ইবনে উমার আলানদারাবী রাহ. লিখেছেন,
“ এই ধরনের পার্থক্য মূলত বাহ্যিক ও নামের পার্থক্য। এই পার্থক্য আসলে ইখতিলাফ নয়। এটা গণনা পদ্ধতির পার্থক্য, কুরআনের আয়াত কমবেশি হওয়ার পার্থক্য নয়। এই বাহ্য ইখতিলাফের কারণেই কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যা এত, আর কেউ বলে মোট আয়াত সংখ্যা এত(উদাহরণত কুফী গণনায় ৬২৩৬ এবং বসরী গণনায় ৬২০৪…..) তো এখানে বিষয় এমন নয় যে, এক পক্ষ কুরআনকে বেশি বলছে আর অপর পক্ষ কম বলছে অথবা এক পক্ষ কুরআনের কোন অংশকে কুরআন মানছে আর অপর পক্ষ (আল্লাহ মাফ করুন) তা কুরআনের অংশ বলে মানছে না। বিষয়টি আদৌ এমন নয়
[আলইযাহ ফিল কিরাআত]
এছাড়া ১৯৮১ সালে ইমাম নাফি (যিনি প্রথম মাদানী গণনা পদ্ধতির ইমাম) থেকে ইমাম ওয়ারশ’ (উছমান ইবন সাঈদ) এর বর্ণনাকৃত কিরাআত মোতাবেক (অর্থাৎ প্রথম মাদানী) একটি মুসহাফ ছাপা হয়েছিলো যাতে আয়াতের চিহ্ন লাগানো হয়েছিলো কূফী গণনা অনুযায়ী। এতে কোনোই সমস্যাই হয়নি দুই আদাদী বা গণনা পদ্ধতিকে সমন্বয় করতে। যদি গণনা পদ্ধতির পার্থক্য কুরআনের আয়াত কম-বেশি হওয়ার (আল্লাহ মাফ করুন) পার্থক্যই হত তবে কিভাবে সম্ভব ছিলো ইমাম নাফীর বর্ণনায় কূফার বর্ণনা অনুযায়ী আয়াতের চিহ্ন লাগানো?? যেখানে ইমাম ওয়ারশ থেকে ইমাম নাফীর(ورش عن نافع) গণনায় মোট আয়াত সংখ্যা ৬২১৭, আর কূফার গণনায় মোট আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬!!!! (এই মুসহাফটিই সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে আমাদের দেশের মুসহাফগুলোতেও সাধারনত এই গণনা পদ্ধতির ব্যবহার হয়ে থাকে)
সুতরাং বলা যায় যে, কুরআনের সংকলনের ভুলের কারণে বা অন্য যে কোনো কারণে ভুল হওয়ার কারণে কুরআনের আয়াত গণনায় মতভেদ হয়ে থাকে এই অভিযোগ পরিপূর্ণ ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা এবং সংকীর্ণ মনোভাবের ফসল। আল্লাহু আ’লাম।
★উক্ত লেখাটি শায়েখ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক লিখিত (আল্লাহ তাঁকে হিফাযাত করুন ও তাঁর ছায়া আমাদের মাঝে দীর্ঘায়িত করুন) মাসিক আল কাওসারের “কুরআনুল কারীম সংখ্যা” [প্রকাশকালঃ ১৪৩৭ হিজরী/২০১৬ ঈসায়ী; পল্লবী, মিরপুর-১২, ঢাকা] অবলম্বনে লেখা হয়েছে (দেখুনঃ- পৃ-৮৯-১০৬)
বিস্তারিত জানতে উক্ত সংখ্যা পড়ুন।