শরীয়তের বিধান হলো কেউ যদি গায়রুল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য সেজদা করে, গায়রুল্লাহর নামে কোরবানী করে, গায়রুল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার নাম জপতপ করে, মানবীয় ক্ষমতার উর্ধ্বের কোনো বিষয় গায়রুল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, মাযার-দরগাহর তওয়াফ করে, মোটকথা, যেসব কাজ আল্লাহ তাআলা তাঁর উপাসনার জন্য নির্ধারণ করেছেন তা গায়রুল্লাহর জন্য করে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ শিরক।
এবং যে ব্যাক্তি মাযার বা মাযারে শায়িত ব্যক্তি সম্পর্কে অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে,সে শিরক করলো।
সুতরাং কেহ যদি সত্যিকারঅর্থেই এহেন আকিদা, বিশ্বাস মনে প্রানে পোষন করে মাজারে সেজদাহ ইত্যাদি করে,তাহলে সে কুফরী করলো।
রব একমাত্র আল্লাহ আল্লাহ তাআলা কুল মাখলুকের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সৃষ্টির অস্তিত্ব ও বিলুপ্তি তাঁরই হাতে।
মানুষের জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা-অসুস্থতা, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, উন্নতি-অবনতি, এককথায় সকল কল্যাণ ও অকল্যাণ একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। তাঁর ইচ্ছায় সব কিছু হয়, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। তাঁর কোনো সহযোগী নেই এবং তিনি কোনো উপায়-উপকরণের মুখাপেক্ষী নন।
কারণ পৃথিবীর সকল বস্তু ও বস্তুগুণ তাঁর সৃষ্টি, জীবন ও জীবনোপকরণ তাঁর সৃষ্টি, প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিয়ম তাঁরই সৃষ্টি। গোটা জাহান তাঁর মাখলুক এবং কুল মাখলুক তাঁরই আদেশের অধীন।
এই সর্বময় ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। কোনো মাখলুকের তাতে বিন্দুমাত্র অংশীদারিত্ব নেই। তদ্রূপ উপায়-উপকরণ ছাড়া কাজ করার ক্ষমতা আল্লাহ তাআলা অন্য কাউকে দান করেননি।
ইরশাদ হয়েছে-
آلا له الخلق والامر
‘সাবধান! সবকিছু তাঁরই সৃষ্টি এবং আদেশও একমাত্র তাঁর।-আ’রাফ : ৫৪
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
ذلك الله ربكم له المك والذين تدعون من دونه ما يملكون من قطمير
‘তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব, রাজত্ব একমাত্র তাঁর। আর তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর বিচির তুচ্ছ আবরণেরও মালিক নয়।-সূরা ফাতির : ১৩
অতএব কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখে যে, তিনি কোনো উপায়-উপকরণ ছাড়া অলৌকিকভাবে হাজত পূরণ করতে পারেন, মুসীবত থেকে রক্ষা করতে পারেন, পরিসি'তিকে অনুকূল বা প্রতিকূল করতে পারেন তাহলে তা হবে পরিষ্কার শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
قل ادعوا الذين زعمتم من دون الله لا يملكون مثقال ذرة فى السموت ولا فى الارض وما لهم فيهما من شرك وما له منهم من ظهير
‘বলুন, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে উপাস্য মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা তো অণু পরিমাণ কোনো কিছুরও মালিক নয়, না আসমানের, না যমীনের। আর না (আসমান-যমীনে) তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে, আর না তাদের মাঝে রয়েছে আল্লাহর কোনো সহযোগী!’-সূরা সাবা : ২২
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
الله الذى خلقكم ثم رزقكم ثم يميتكم ثم يحييكم هل من شركائكم من يفعل من ذلكم من شيء سباحنه وتعالى عما يشركون
‘আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর রিযিক দিয়েছেন। এরপর তোমাদের মৃত্যু দিবেন, এরপর তোমাদের জীবিত করবেন। তোমাদের শরীকদের এমন কেউ কি আছে, যে এসব কাজের কোনো একটিও করতে পারে? তারা (যাদের) শরীক করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মহান।-সূরা রুম : ৪০
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন-
لله ملك السموت والارض يخلق ما يشاء يهب لمن يشاء اناسثا ويهب لمن يشاء الذكور او يزوجهم ذكرانا واناثا ويجعل من يشاء عقيما انه عليم قدير
‘আসমান ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশালী।-সূরা শূরা : ৪৯-৫০
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
قل افرأيتم ما تدعون من دون الله ان ارادنى الله بضر هل هن كاشفت ضره او ارادنى برحمة هل هن ممسكات رحمته قل حسبى الله عليه يتوكل المتوكلون
‘বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ যদি আমার সম্পর্কে কোনো মুসীবতের ইচ্ছা করেন তাহলে আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ডাক তারা কি সে মুসীবত দূর করতে পারবে? কিংবা তিনি যদি আমার প্রতি মেহেরবানীর ইচ্ছা করেন তাহলে তারা কি সে মেহেরবানী রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীগণ তাঁরই উপর ভরসা করে। -সূরা যুমার : ৩৮
এজন্য মাযারপন্থীরা মাযার বা মাযারে শায়িত ব্যক্তি সম্পর্কে যে অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে তা সম্পূর্ণ শিরক। ফিকহের কিতাবে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘কোনো মৃত ব্যক্তিকে তাসাররুফ ক্ষমতার অধিকারী (অর্থাৎ গায়বী ক্ষমতা-বলে কার্যসম্পাদনে সক্ষম) মনে করা কুফরী।-আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৮
বুযুর্গানে দ্বীন সর্বদা তাদের অনুসারীদেরকে এই গর্হিত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহ. বলেন, ‘সর্বদা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর হুকুম মেনে চল। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করো না এবং অন্য কারো নিকট আশাও রেখো না। সকল প্রয়োজন আল্লাহরই হাওয়ালা কর এবং তাঁর নিকটই প্রার্থনা কর। আর আল্লাহ ছাড়া কারো উপর ভরসা করো না। তাওহীদকে অবলম্বন কর। তাওহীদকে অবলম্বন কর। তাওহীদকে অবলম্বন কর।-মালফুযাত-ফাতাওয়া রহীমিয়া ৩/৫
★ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর যেহেতু আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা তাই ইবাদতও একমাত্র তাঁর। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ইবাদত ও উপাসনা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য হতে পারে না। রুকু, সেজদা, দোয়া, যিকির, হজ্ব, কোরবানী ইত্যাদি খালিস ইবাদত। অতএব আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য তা করা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
قل ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العلمين لا شريك له وبذلك امرت وانا اول المسلمين
‘বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমাকে এরই আদেশ করা হয়েছে এবং আমি প্রথম আনুগত্যকারী।-সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩
অতএব কেউ যদি গায়রুল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য সেজদা করে, গায়রুল্লাহর নামে কোরবানী করে, গায়রুল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার নাম জপতপ করে, মানবীয় ক্ষমতার উর্ধ্বের কোনো বিষয় গায়রুল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, কোনো মাযার বা দরগাহ্র উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর মতো তীর্থযাত্রা করে, হারাম শরীফের মতো দরগাহ ও তার চারপাশের অঞ্চলকে তীর্থস্থান মনে করে, মাযার-দরগাহর তওয়াফ করে এবং দরগাহর দেয়ালে ভক্তিভরে চুম্বন করে, মোটকথা, যেসব কাজ আল্লাহ তাআলা তাঁর উপাসনার জন্য নির্ধারণ করেছেন তা গায়রুল্লাহর জন্য করে তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ শিরক। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : তাসাওউফ : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা : ২১২-২২৯
আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সেজদা করার নিষিদ্ধতা সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস দেখা যেতে পারে-
হযরত মুআজ বিন জাবাল রাঃ থেতে বর্ণিত। তিনি সিরিয়া গেলে সেখানকার খৃষ্টান অধিবাসী কর্তৃক পোপ ও পাদ্রীদেরকে সেজদা করতে দেখলেন। হযরত মুআজ রাঃ বলেন, আমি তাদেরকে বললামঃ তোমরা কেন এমন কর? তারা উত্তরে বলল, এটাতো আমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অভিবাদন [ভক্তি ও সম্মান প্রকাশের মাধ্যম] ছিল। আমি [মুআজ] বললাম, তাহলে আমরা স্বীয় নবীকে এর প্রকারের ভক্তি প্রকাশের অধিক অধিকার রাখি। [সিরিয়া হতে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত মুআজ রাঃ রাসূল সাঃ এর নিকট তাঁকে সেজদা করার অনুমতি চাইলে] তিনি ইরশাদ করেন, এরা [খৃষ্টানরা] স্বীয় নবীদের উপর মিথ্যারোপ করছে [যে তাদের অভিবাদন সেজদা ছিল।]। যেমন ওরা নিজেদের আসমানী কিতাবে বিকৃতি সাধন করেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের মনগড়া অভিবাদনের চাইতে অতি উত্তম অভিবাদন সালাম আমাদের দান করেছেন। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৪০৪, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৭২৯৪, মুস্তাদরাক আলাস সাহিহাইন, হাদীস নং-৭৩২৫}
دَّثَنِي جُنْدَبٌ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْلَ أَنْ يَمُوتَ بِخَمْسٍ، وَهُوَ يَقُولُ: ……أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ، أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ، إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ
হযরত জুনদুব রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ মৃত্যুর পূর্বে পাচটি বিষয় বলেছিলেন, [এর মাঝে]…… বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী কত উম্মত স্বীয় নবী ও বুজুর্গদের কবরকে সেজদার স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সেজদার স্থান বানিও না। আমি তোমাদের তা হতে বারণ করছি। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৩২}
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ؛ أَنَّ [ص:241] رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يُعْبَدُ. اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
হযরত আতা বিন ইয়াসার রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ! আমার কবরকে প্রতিমার ন্যায় ইবাদতের বস্তু বানিও না। আল্লাহর গজব সেসব লোকের উপর কঠোর আকার ধারণ করেছে, যারা তাদের নবীদের কবরকে সেজদার স্থল বানিয়েছে। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৫৭০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৭৩৫৮}
এসব হাদীসসহ আরো অনেক হাদীস প্রমাণ করে আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে বা কারো কবরের সামনে সেজদা দেয়া সুষ্পষ্ট কুফরী ও শিরকী কাজ। তাই এসব থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলমানের জন্য আবশ্যক।
★ হারামকে হালাল মনে করা কুফরী গান-বাদ্য, মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা যে সম্পূর্ণ হারাম তা বলাই বাহুল্য। এটি জরুরিয়্যাতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ দ্বীনের একটি সর্বজনবিদিত বিধান। অথচ এই অকাট্য হারামগুলিই হচ্ছে মাযার-ওরসের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ‘‘তাফসীরে আহমদিয়া’’ কিতাবে (পৃষ্ঠা : ৬০৪-৬০৫) বলা হয়েছে, ‘বর্তমান যুগে লোকেরা ‘সামা’র ব্যাপারে খুব তৎপর। তারা মদ পান করে মাতাল হয় এবং অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়। দুশ্চরিত্র লোকেরা শ্মশ্রুবিহীন সুশ্রী বালকদের একত্র করে এবং গানবাজনা করে। এগুলো যে কবীরা গুনাহ তা বলাই বাহুল্য। আর এগুলোকে হালাল মনে করা সুস্পষ্ট কুফরী।’
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এইসব হারাম কাজকে ওরস ও মাযারপন্থীরা শুধু যে হালাল মনে করে তা-ই নয়; বরং আধ্যাত্মিকতার নামে একে আল্লাহর নৈকট্যের উপায় বলেও প্রচার করে থাকে! নাউযুবিল্লাহ! শরীয়তের দৃষ্টিতে যেখানে হারামকে হালাল মনে করাই কুফরী সেখানে একে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উপায় মনে করা যে কত জঘন্য কুফরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
★ওরস বা মাযারের হজ্ব,তওয়াফ।
এ পর্যন্ত যে সকল শিরকী বিশ্বাস ও কর্মের কথা বলা হয়েছে তার যে কোনো একটিও কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
,