আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ,
মুহতারাম, কোনো পরিবার যাতে দ্বীনের চর্চা নেই, উপার্জনের উৎস হারাম এমন পরিবারে জন্মানো এক সন্তানের অন্তরের চাপা আর্তনাদ এবং মনের মাঝে উঁকি দেওয়া নানা প্রশ্ন (এ বিষয়গুলোতে শরীয়ত কি নির্দেশনা ও বিধান আরোপ করে অনুগ্রহ করে বিস্তারিতভাবে ব্যক্ত করবেন) :
১)কুপ্রভাব
জানামতে, পিতা-মাতার মিলনের প্রথম মুহূর্ত থেকে শুরু করে তাদের পারস্পরিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ, কাজকর্ম এবং মানসিকতা সকল কিছুই সন্তানের উপর সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। তাহলে কি একারণেই (পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্যানুসারে) আমার মধ্যে হারাম কাজসমূহের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, দ্বীন পালনে অবহেলা বা মনযোগের অভাব, বারবার চেষ্টা-তওবা করার পরেও গুনাহের দিকে ফিরে আসা, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি নিন্দনীয় স্বভাবগুলি বিরাজমান? যদি তাই হয় তাহলে আমার করনীয় কি?
২) অজ্ঞতা
শৈশবে দ্বীন শেখার কোন সঠিক ব্যবস্থাই পাইনি। সঠিকভাবে কুরআন পড়া শেখানো হয়নি, নামাজের হুকুম-আহকাম মাসআলা-মাসায়েল কিছুই শেখানো হয়নি, নামাজ যে পড়তে হবে তাও শেখানো হয়নি, এমনকি পবিত্রতা, ফরজ গোসল ইত্যাদিও শেখানো হয়নি। এমন অবস্থাতেই বালেগ হলাম, সতর-ওযু-ফরজ গোসল-পবিত্রতা সম্পর্কে কিছুই জানিনা, নামাজ পড়িনা, কখনো পড়লেও তা হয় আগাগোড়া ভুলে ভরা (আহকামে ভুল, কেরাতেও ভুল) নামাজ। আহ্, কতগুলো বৎসর এমন বেদ্বীন অবস্থায় আমি গুনাহের মহাসাগরে ডুবে ছিলাম। উপরন্তু বালেগ হওয়ার পরে যিনা-ব্যভিচার সম্পর্কে, যৌনশিক্ষা সম্পর্কে কোন ধারণাই দেওয়া হয়নি, ফলশ্রুতিতে নিজেকে আবিস্কার করি এক জঘন্য, নির্লজ্জ, গোপন গুনাহের জগতে ; যার নির্মম করালগ্রাসের প্রভাব আমাকে আজও টেনে ধরে আছে।
৩) হারামের হামলা
আরো পরে ১৯-২০ বছরে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার পরিবারের উপার্জনের উৎস হারাম। অর্থাৎ আমার ভ্রুণ অবস্থা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা কিছু খেয়েছি, যা কিছু পরেছি, যত কিছুই করেছি তা সবই হারাম উপার্জনের টাকায়। জানামতে, যে শরীর হারাম দ্বারা গঠিত তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, তার দুআ কবুল হয় না, তার কোনো ইবাদত কবুল হয় না, তার মধ্যে গুনাহের স্পৃহা প্রবল থাকে ইত্যাদি আরো কত কঠোর নির্দেশনা আছে। আহ্, আর আমার শরীরের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর প্রতিটি অংশই হারাম দ্বারা গঠিত। আল্লাহ তায়ালার অসীম দয়ায় অভাবনীয়-অলৌকিক উপায়ে দ্বীনের পথে চলার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু এরপর যত ইবাদত করেছি,করছি সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সবই যে হারাম দ্বারা গঠিত শরীরে ও হারাম উপার্জনের টাকায় করা।
৪) হালাল উপার্জনে প্রতিবন্ধকতা
এই হারামের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার জন্য যে নিজে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করব সেখানেও বিপত্তি, আমি যে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার শৃংখলে আবদ্ধ। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে একটি সরকারি মেডিকেলে কলেজে এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা করছি। আর পড়ালেখা তো যত সময় যায় তত আরো কঠিনই হয়। এখান থেকে উপার্জন করাও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। অন্য কোন উপার্জনের কাজ বা চেষ্টার কথা চিন্তা করতে গেলে মনে আসে যে এর পেছনে যে সময় ও শ্রম ব্যয় হবে তা দ্বারা এই পড়ালেখার আমানতদারিতার সাথে গাফিলতি হবে না তো? স্বল্প সময় কাজের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ পরিমাণ উপার্জন পেতে পারি এমন কাজই বা পাই কই? ছাত্রজীবনে পড়াশোনার মধ্যেও ছিল গাফিলতি তাই টিউশনির কথা চিন্তা করলে মনে হয় আমার দ্বারা অন্যের সাথে প্রতারণা-অন্যের হক নষ্ট হবে না তো? তাছাড়া নিজের শারীরিক অক্ষমতা (তোতলামো ও অ্যাজমা রোগ) তো 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে রয়েছেই। মোটকথা, নিজের ভরণপোষণ ও পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য হালাল অর্থ কিভাবে পাব?
৫) নির্মম একাকীত্ব
এ বিষয়টি যে পরিবারকে জানাবো, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হয় যে তা হবে বধিরের সামনে চিৎকার করা। কারণ এ পর্যন্ত পরিবার থেকে দ্বীন পালনে কেবল বাধাই পেয়ে এসেছি; কোরআন পড়া শেখায় বাধা, দাঁড়ি রাখায় বাধা, মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা, টাখনুর উপর কাপড় পরতে বাধা, ফজর নামাজ পড়তে বাধা, সুন্নতি পোশাক পরতে বাধা, দ্বীন শেখায় সময় ব্যয় করায় বাধা, টেলিভিশন থেকে দূরে থাকায় বাধা, গায়রে মাহরামদের থেকে দূরে থাকায় বাধা…. আর কত বলব; কিন্তু বিপরীতে আমি তাদেরকে কখনো দ্বীনের কোন বিষয় মানাতে পারিনি (পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য বলেও হয়তো কেউ কখনো পাত্তাই দেয়নি)। ""ফাসেক বিষয়ে বিস্তারিত" শিরোনামের 2820 নং ফতোয়ায় ফাসেকের যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে তার অনেকগুলোই তাদের মধ্যে বিদ্যমান এবং এ ফতোয়ায় ফাসেকের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আমার পরিবারের সাথেও এতদিন আমি এমন ধরনের আচরণই করার চেষ্টা করে আসছি। অধিকন্তু আমি যেখানে পড়ালেখা করি সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রের মধ্যেও এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তাই তাদের সাথেও অগত্যা এমন আচরণই করতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসকল কারণে এবং সাথে নিজের শারীরিক অক্ষমতার (তোতলামো ও অ্যাজমা রোগ) কারণে আমিও তাদের সকলের কাছে পছন্দের পাত্র নই। অর্থাৎ সোজা কথায়, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সকলে থাকার পরেও আমি তাদের সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন। সকলের মাঝে থেকেও আমার অনুভূতি হয় যে আমি একা, একদম একা।
৬) মৃত্যুকামনা
(কেবলই মনের আবেগ টুকু প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র, ভুল হলে মাফ করবেন)
যদি কোন হক্কানী-দ্বীনদার পরিবারে জন্ম হতো, তাহলে কতইনা উত্তম হত! তাজবীদের সাথে তারতীলের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারতাম, কোন নামাজ কাযা হতো না, পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তায়ালার দেয়া দ্বীন শিক্ষার সুযোগ পেতাম, দ্বীন নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেতাম, ইবাদতগুজার বান্দা হতাম, আমলি জিন্দেগী হইত, গুনাহের পরিবেশ থেকে মুক্ত থাকতাম…. কতই না ভালো হতো।
এই পরিবারের ও গুনাহের পরিবেশের কুপ্রভাব, অজ্ঞতা, হারাম দ্বারা শরীর গঠন, হারামের মধ্যে ডুবে থাকা, উপার্জনহীনতা, নিজের জীবনের অগণিত জঘন্য গুনাহসমূহের বোঝা ও এদের স্মৃতি, শিক্ষাব্যবস্থার শৃংখল, শারীরিক অক্ষমতা, নির্মম একাকীত্ব ইত্যাদির কারণে সত্যিই অনেক সময় মনে হয় কেন আমার জীবন এত যাতনাময় হল? মৃত্যুকামনা করতে ইচ্ছে করে, হয়তো মরে গেলেই এতসব ব্যর্থতা, যন্ত্রণা, সমস্যা থেকে মুক্ত হব; হ্যাঁ,সত্যিই মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে…..
এ প্রসঙ্গে প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তির মাসায়েল ভিত্তিক কিছু প্রশ্ন: 2866 নং প্রশ্ন