রাসূল সাঃ হাদীসে মুসলমান এর পরিচয় দিয়েছেন।
عن أنس بن مالك قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( من صلى صلاتنا واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم
অনুবাদ-হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি আমাদের মত নামায পড়ে, আমাদের কিবলাকেই কিবলা নির্ধারণ করে, এবং আমাদের জবাইকৃত পশু খায়, সে মুসলমান। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৮৪}
অন্য হাদীসে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন।
صلوا على كل ميت من أهل القبلة
অর্থাৎ তোমরা আহলে কিবলার উপর জানাযা নামায পড়বে। {সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-৯}
প্রথম হাদীসটিতে তিনটি বিষয়কে যদিও মৌলিকভাবে মুসলমানিত্বের প্রমাণবাহী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় হাদীসে আহলে কিবলা তথা আমাদের কিবলা নির্ধারণ করলেই তাকে মুসলমান ধর্তব্য করে জানাযা পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হল আমাদের কিবলাকে কিবলা নির্ধারণ করা তথা আহলে কিবলা হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য কি? শুধু কিবলাকে নিজের কিবলা মনে করে সকল প্রকার গুমরাহী আক্বিদা রাখলেও ব্যক্তি মুসলমান থাকবে? বিষয়টি আসলে এমন নয়। একথার ব্যাখ্যা আছে। আহলে কিবলা বলতে কি অর্থ? ফুক্বাহায়ে কেরাম এর ব্যাখ্যা করেছেন।
মোল্লা আলী কারী রহঃ শরহুর ফিক্বহুল আকবারে “আহলে কিবলা” এর ব্যাখ্যায় লিখেন-
اعلم ان المراد باهل القبلة الذين اتفقوا على ما هو من ضروريات الدين كحدوث العالم وحشر الاجاد وعلم الله تعالى بالكليات والجزئيات وما اشبه ذلك من المسائل المهمات، فمن واذب طول عمره على الطاعات والعبادات مع اعتقاد قدم العالم ونفى الحشر او نفى علمه سبحانه وتعالى بالجزئيات لا يكون من اهل القبلة، وان المراد بعدم تكفير احد من اهل القبلة عند اهل السنة انه لا يكفر احد ما لم يوجد شيئ من امارات الكفر وعلاماته، ولم يصدر عنه شيئ من موجباته، (شرح الفقه الاكبر-189
ভাল করে জেনে রাখ যে, আহলে কিবলা দ্বারা উদ্দেশ্য হল ঐ ব্যক্তি, যে ঐ সকল আক্বিদাকে মান্য করে, যা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়। যেমন পৃথিবী সৃজিত বস্তু, কিয়ামত, হাশর-নশর, আল্লাহ তাআলার ইলম সমস্ত দেখা অদেখা বস্তুর উপর বিস্তৃত। এমন ধরণের অন্যান্য আক্বিদা। যে ব্যক্তি সারা জীবন ইবাদত বন্দেগীতে কাটায়, কিন্তু এর সাথে পৃথিবী সৃজিত নয় বরং প্রাকৃতিক বলে বিশ্বাস করে, কিংবা কিয়ামতে মানুষের জীবিত হওয়াকে বা অথবা আল্লাহ তাআলার ইলম বিস্তৃত হওয়াকে অস্বিকার করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি আহলে কেবলার অন্তুভূক্ত নয়। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে আহলে কেবলাকে কাফের না বলার দ্বারা উদ্দেশ্য এটাই যে, এসব ব্যক্তিদের মাঝে কাউকে ততক্ষণ পর্যন্ত কাফের বলা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের থেকে এমন কোন কাজ সংঘটিত হয় যা কুফরীর আলামত বা কুফরকে আবশ্যক করে। (শরহুল ফিক্বহিল আকবার-১৮৯}
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহঃ তার বিখ্যাত ফাতওয়া গ্রন্থ ফাতওয়া শামীতে উল্লেখ করেন-
لا خلاف في كفر المخالف في ضروريات الإسلام من حدوث العالم وحشر الأجساد ونفي العلم بالجزئيات وإن كان من أهل القبلة المواظب طول عمره على الطاعات كما في شرح التحرير (رد المحمتار، كتاب الصلاة، باب الإمامة، مطلب البدعة خمسة أقسام -2/300)
আহলে কিবলার মধ্য থেকে যে ব্যক্তি দীর্ঘ জীবন পর্যন্ত ইবাদত বন্দেগীর করার পরও যদি পৃথিবী সৃজিত, সশরীরে হাশরের ময়দানে উঠতে হবে, বা আল্লাহ তাআলার জ্ঞান সর্বত্র বিস্তৃত এরকম আবশ্যকীয় দ্বীনী বিষয়কে অস্বিকার করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যে, কাফের এতে কোন মতভেদ নেই। {ফাতওয়া শামী-২/৩০০} শরহে আকাইদে নাসাফিয়্যাহ এর ব্যখ্যাগ্রন্থ নিবরাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
اهل القبلة فى اصطلاح المتكلمين من يصدق بضروريات الدين (الى قوله) فمن انكر شيئا من الضروريات (الى قوله) لم يكن من اهل القبلة، ولو كان مجاهد بالطاعات وكذالك من باشر شيئا من امارات التكذيب كسجدة الصنم ولاإهانة بامر شرعى والإستهزاء عليه فليس من اهل القبلة ان لا يكفر بارتكاب المعاصى ولا بانكار الامور الخفية غير المشهورة هذا ما حققه المحققون،
আহলে কিবলা মুতাকাল্লিমীন তথা আক্বায়িদবীদতের পরিভাষায় ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যিনি দ্বীনের আবশ্যকীয় সকল বিষয়কে বিশ্বাস স্বীকার করেন। জরুরিয়্যাতে দ্বীন তথা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের কোন একটিকেও যদি অস্বিকার করে তাহলে সে আহলে কিবলা নয়। যদিও সে ইবাদত বন্দেগীতে খুবই তৎপর হয়। এমনিভাবে ঐ ব্যক্তি ও আহলে কিবলা নয়, যে কুফরী বা বাতিলের কোন একটি বিষয়ও করে থাকে, যেমন মুর্তিপূজা করা, অথবা শরয়ী কোন বিষয়কে ঠাট্টা করা, মজা করা, তাহলে এ ব্যক্তিও আহলে কিবলা নয়। আর আহলে কিবলাকে কাফির না বলার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, গোনাহ করার কারণে কোন আহলে কিবলাকে কাফের বলা হবে না। সাথে এমন বিষয়কে অস্বিকার করলেও কাউকে কাফের বলা যাবে না যা জরূরিয়্যাতে দ্বীন তথা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। {নিবরাস} উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমানিত হল যে, আহলে কিবলা মানেই হল মুসলমান। আর আহলে কিবলা কাকে বলে? যিনি ইসলাম ধর্মের জরূরী বিষয়কে মান্য করেন। জরূরী বিষয়ের কোন একটিকেও অস্বিকার করেন না। উক্ত ব্যক্তির নাম মুসলমান।
,
প্রাসঙ্গিকভাবে একটি কথা জেনে রাখা উচিত যে, এখানে কালিমার উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়নি,তাহলে কি কালিমা বিশ্বাস না করলেও কি কেউ মুসলমান হতে পারবে? আসলে এ প্রশ্নটি তাদের মনেই জাগবে, যারা উপরোক্ত আলোচনায় জরূরিয়্যাতে দ্বীন তথা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয় মানে বুঝেন নি। দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয়ের মাঝে সর্ব প্রথম আবশ্যকীয় বিষয় হল কালিমা বিশ্বাস করা। তথা একথা বলা যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, হযরত মুহাম্মাদ সাঃ আল্লাহ তাআলার বান্দা ও রাসূল।
কিছু জরূরিয়্যাতে দ্বীনের উদাহরণ খেয়াল করুন-
১-আল্লাহ একক।
২-আল্লাহ তাআলার সকল সিফাত সত্য।
৩-আল্লাহ তাআলা অনাদি, অনন্ত।
৪-সকল কিছুই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি।
৫-সব কিছুই আল্লাহ তাআলা অধীন।
৬-তার জ্ঞান সর্বত্র বিস্তৃত।
৭-তিনি সব জানেন, সব দেখেন। কোন কিছুই তার দেখার বাহিরে নয়।
৮-রাসূল সাঃ আল্লাহর প্রেরিত বান্দা।
৯-রাসূল সাঃ এর উপর নাজিলকৃত কুরআন সত্য।
১০-রাসূল সাঃ এর হাদীস সত্য।
১১-হাশর সত্য।
১২-কবরের আজাব সত্য।
১৩-জান্নাত-জাহান্নাম সত্য।
১৪-রাসূল সাঃ এর আগমনের পূর্বে আরো অনেক নবী রাসূল এসেছিলেন।
১৫-কুরআন ছাড়াও আরো আসমানী কিতাব ইতোপূর্বে নাজিল হয়েছিল, কিন্তু তা বর্তমানে রহিত ও বিকৃত।
১৬-রাসূল সাঃ সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ সৃষ্টি।
১৭-তিনি সর্বশেষ নবী। তারপর কোন প্রকার নবী আর আসবে না।
১৮-রাসূল সাঃ নিষ্পাপ ছিলেন।
১৯-রাসূল সাঃ চরিত্রে সামান্যতম কোন দাগও নেই।
২০-সমস্ত সৃষ্টির মাঝে সবচে’ চরিত্রবান ও মর্যদাবান ব্যক্তিত্বের নাম মুহাম্মদ সাঃ ইত্যাদি। এরকম আরো অনেক বিষয় জরূরিয়্যাতে দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। তাহলে এক কথায় আমরা মুসলমানের সংজ্ঞা বলতে চাইলে বলতে পারি যে, দ্বীনের আবশ্যকীয় সকল বিষয় মানার নাম মুসলমান। আর যেকোন একটিকে অস্বিকার করার দ্বারাই মুসলমানিত্ব থেকে বেরিয়ে যাবে।