কুরআনুল কারিমে এসেছে-‘তুমি মনে করো না- তারা শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে, যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আনন্দিত হয় এবং না করা বিষয়ের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে। এরূপ কখনও মনে করো না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা আল ইমরান : আয়াত ১৮৮)
হজরত আবু বকর রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা:-এর মজলিসে এক ব্যক্তির প্রশংসা করা হলো। তিনি তা শুনতে পেয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি তো তোমার ভাইয়ের গলা কেটে দিলে!’ এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমাদের কারো যদি একান্তই প্রশংসা করতে হয়, তাহলে এরূপ বলবে- আমার ধারণামতে তিনি এরূপ। অবশ্য যদি সে সত্য সত্য সে রূপ হয়ে থাকে। অথচ তার প্রকৃত অবস্থা তো আল্লাহই ভালো জানেন। আর আল্লাহর সম্মুখে কেউ নির্দোষ নয়।’ [সহিহ বুখারি]।
হজরত আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সা:এক ব্যক্তিকে আরেক ব্যক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তো তাকে হত্যা করে ফেললে, অথবা তার পিঠ কেটে ফেললে।’। [আদাবুল মুফরাদ]।
۔
উপরোল্লিখিত হাদিসগুলোয় রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিদের কাছ থেকে ব্যক্তি প্রশংসা বা তোষামোদ সম্পর্কিত যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, তাতে একজন ব্যক্তিত্ববান মুসলিমের পক্ষে এমন হীন কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। এতে অপরের পাশাপাশি নিজের ব্যাপারেও ভুল বিশ্বাস তৈরি হয় এবং নিজের অজান্তে আত্মোপলব্ধির অনুভূতি হ্রাস পায়।
,
অন্য দিকে অতিশয় প্রশংসিত ব্যক্তি যদি সমাজের ক্ষমতাশালী কেউ হয়, তা হলে সে আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কাজেই সর্বাবস্থায় ব্যক্তি প্রশংসা থেকে বিরত থাকা উত্তম।
ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তির যদি প্রশংসা করতে হয়, তা হলে এতটুকু বলা যায় যে, তিনি একজন ভালো লোক।
,
কাহারো প্রশংসা করা নিন্দিত নয়- যতক্ষণ তা স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। প্রশংসা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন আর তা প্রশংসনীয় থাকে না; বরং নিন্দনীয় স্তাবকতায় পরিণত হয়ে যায়। ইসলাম স্তাবকতাকে অনুমোদন করে না। কেননা তা প্রশংসাকারী ও প্রশংসিত উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর। অতএব প্রশংসায় মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া ও মধ্যপন্থা অবলম্বন জরুরি। অর্থাৎ যে যতটুকু প্রশংসার উপযুক্ত ঠিক ততটুকু প্রশংসা করা, তার বেশি নয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এক ব্যক্তি অন্য একজনের প্রশংসা করলে তিনি তাকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, (অর্থ) তুমি তো লোকটার মেরুদণ্ড ভেংগে দিলে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩০০০)
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إذا كان أحدكم مادحا صاحبه لامحالة، فليقل : احسب فلانا والله حسيبه، ولا ازكى على الله أحدا، احسبه -ان كان يعلم ذاك- كذا وكذا
তোমাদের কেউ যখন তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করবেই তখন তার সম্পর্কে যেন কেবল এতটুকুই বলে যে, ‘আমি অমুককে এমন-এমন মনে করি, তবে বাস্তবে সে কেমন সে হিসাব আল্লাহ তাআলার কাছেই আছে, আমি আল্লাহর জ্ঞানের বিপরীতে কারও সাফাই দিচ্ছি না। এটাও বলবে কেবল তখনই যখন তার সম্পর্কে সেরকম জানা থাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩০০০ )
,
শায়েখ আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম বলেন
এই হাদীস নিয়ে চিন্তা করে দেখুন, কী কঠিন সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। এক তো প্রশংসা করা যাবে কেবল এমন বিষয়ে যা জানা আছে, অজ্ঞাত বা আনুমানিক বিষয়ে কিছুতেই নয়। দ্বিতীয়ত জানা বিষয়েও নিশ্চয়তাবোধক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন, তিনি একজন আমানতদার লোক, ‘অমুক ব্যক্তি পরহেযগার’ ইত্যাদি। বরং বলতে হবে, আমি তাকে পরহেজগার মনে করি বা আমার জানামতে সে একজন আমানতদার ইত্যাদি। তারপরও প্রকৃত অবস্থাকে আল্লাহ তাআলার উপরই ন্যস্ত করতে হবে। যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তাঁরই আছে, আমরা অতি সামান্যই জানি।
,
এ হাদীসে যে والله حسيبه (আল্লাহ তাআলাই তার প্রকৃত অবস্থার হিসাব গ্রহণকারী) বলার তালীম দেওয়া হয়েছে, এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা যেমন সতর্ক করা হয়েছে, সে যেন অসত্য কিছু না বলে, তেমনি প্রশংসা দ্বারা প্রশংসিত ব্যক্তির যে ক্ষতি হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার প্রতিকারেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রশংসা দ্বারা প্রশংসিত ব্যক্তির অন্তরে অহংকার অহমিকা জন্মানোর অবকাশ থাকে আর বাস্তবিকই যদি তা জন্ম নিয়ে ফেলে তবে তো প্রশংসা দ্বারা তার মস্তবড় ক্ষতি করে ফেলা হল।
,
সুতরাং কারো প্রশংসা, খোশামোদ, তোষামোদ করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত না করাই ইসলামের বিধান।
,
দ্বীনের স্বার্থে তার অন্যান্য নেক আমল এর প্রশংসা করা যাবে,তবে অতিরঞ্জন করা জায়েজ হবেনা।
অতিরক্তি প্রশংসা ও তোষামোদের দ্বিমুখী ক্ষতি রয়েছে। যে ব্যক্তি প্রশংসা করে আর যার প্রশংসা করা হয়, উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রশংসিত ব্যক্তির অন্তরে অহংকার অহমিকা জন্মানোর অবকাশ থাকে আর বাস্তবিকই যদি তা জন্ম নিয়ে ফেলে তবে তো প্রশংসা দ্বারা তার মস্তবড় ক্ষতি করে ফেলা হল।
অতিশয় প্রশংসিত ব্যক্তি যদি সমাজের ক্ষমতাশালী কেউ হয়, তা হলে সে আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়।