জবাব
بسم الله الرحمن الرحيم
স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহামের শরয়ী বিধান
নবীগণের স্বপ্ন ছাড়া আর কারো স্বপ্নকে শরীয়ত দলীলের মর্যাদা দেয়নি। শরীয়ত স্বপ্নকে শুধু সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর সেটাও শুধু ঐ স্বপ্নের ক্ষেত্রে, যেটাকে ভালো স্বপ্ন বলা যায়; অর্থাৎ যেটা শয়তানের পক্ষ থেকেও নয় এবং কল্পনাপ্রসূতও নয়।
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الرّؤْيَا الصّالِحَةُ مِنَ اللهِ، وَالرّؤْيَا السّوْءُ مِنَ الشّيْطَانِ، فَمَنْ رَأَى رُؤْيَا فَكَرِهَ مِنْهَا شَيْئًا فَلْيَنْفُثْ عَنْ يَسَارِهِ، وَلْيَتَعَوّذْ بِاللهِ مِنَ الشّيْطَانِ، لَا تَضُرّهُ وَلَا يُخْبِرْ بِهَا أَحَدًا، فَإِنْ رَأَى رُؤْيَا حَسَنَةً، فَلْيُبْشِرْ وَلَا يُخْبِرْ إِلّا مَنْ يُحِبّ.
ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ খারাপ স্বপ্ন দেখলে বাম দিকে থুথু দিবে এবং আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং এ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর এ দুঃস্বপ্নের কথা কারো কাছে বলবে না। অপরদিকে ভালো স্বপ্ন দেখলে সুসংবাদ গ্রহণ করবে এবং এ স্বপ্নের কথা (একান্ত বর্ণনা করতে হলে) মহব্বতের লোকদের নিকটই বর্ণনা করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬১
আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেন-
الرّؤْيَا ثَلَاثَةٌ: فالرّؤْيَا الصّالِحَةُ بُشْرَى مِنَ اللهِ، وَرُؤْيَا تَحْزِينٌ مِنَ الشّيْطَانِ، وَرُؤْيَا مِمّا يُحَدِّثُ الْمَرْءُ نَفْسَهُ، فَإِنْ رَأَى أَحَدُكُمْ مَا يَكْرَهُ فَلْيَقُمْ فَلْيُصَلِّ، وَلَا يُحَدِّثْ بِهَا النّاسَ.
স্বপ্ন তিন প্রকার। এক. ভালো স্বপ্ন। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদস্বরূপ। দুই. শয়তানের পক্ষ থেকে পেরেশানকারী স্বপ্ন। তিন. কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। তোমাদের কেউ যদি স্বপ্নে অপ্রীতিকর কিছু দেখে তাহলে সে যেন উঠে নামায আদায় করে এবং মানুষের কাছে সে স্বপ্ন বর্ণনা না করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬৩; জামে তিরমিযী, হাদীস ২২৭০
★কাশফ হল অদৃশ্য জগতের কোনো কথা প্রকাশিত হয়েছে বলে ধারণা হওয়া।
★ইলহাম অর্থ চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোনো কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। তবে স্বপ্ন যেমন দলীল নয়, কাশফ-ইলহামও দলীল নয়।
হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنّ لِلشّيْطَانِ لِمّةً، وَلِلْمَلَكِ لِمّةً، فَأَمّا لِمّةُ الشّيْطَانِ فَإِيعَادٌ بِالشّرِّ، وَتَكْذِيبٌ بِالْحَقِّ، وَأَمّا لِمّةُ الْمَلَكِ فَإِيعَادٌ بِالْخَيْرِ، وَتَصْدِيقٌ بِالْحَقِّ، فَمَنْ وَجَدَ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَعْلَمْ أَنّهُ مِنَ اللهِ، فَلْيَحْمَدِ اللهَ، وَمَنْ وَجَدَ مِنَ الْآخَرِ فَلْيَتَعَوّذْ مِنَ الشّيْطَانِ، ثُمّ قَرَأَ اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.
নিশ্চয়ই মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। শয়তানের উদ্রেক হল, মন্দ প্রতিশ্রুতি ও সত্য অস্বীকার করা। আর ফেরেশতার উদ্রেক হল, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি ও হকের সত্যায়ন। যে ব্যক্তি এটি (ভালো কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে তাকে বুঝতে হবে, এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। তাই তার উচিত আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা। আর যে দ্বিতীয়টি (অর্থাৎ খারাপ কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে সে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এরপর তিনি (সূরা বাকারর ২৬৮ নং আয়াত) পাঠ করেন-
اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.
অর্থাৎ শয়তান তোমাদের অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দান করেন। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ১১০৫১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৯৮
এ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মনে যেসব কথার উদ্রেক হয় সেগুলোর কোনোটা ভালো, কোনোটা মন্দ। আর ভালোটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে। জানা কথা, কোন্টা ভালো আর কোন্টা মন্দ, তা নির্ণয়ের একমাত্র মাধ্যম হল শরীয়ত। শরীয়ত দ্বারাই তার ভালো-মন্দ যাচাই করতে হবে।
সেজন্য তাসাওউফ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু সুলাইমান দারানী রাহ. (২০৫ হি.) বলেন-
رُبّمَا يَقَعُ فِي قَلْبِي النُكْتَةُ مِنْ نُكَتِ القَوْمِ أَيّاماً، فَلاَ أَقْبَلُ مِنْهُ إِلاّ بِشَاهِدَيْنِ عَدْلَينِ، الكِتَابُ وَالسّنّة.
প্রায়ই আমার অন্তরে (সূফী) সম্প্রদায়ের কোনো ভেদতত্ত্ব উদয় হয়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সাক্ষীদ্বয়- কুরআন ও সুন্নাহ-এর সাক্ষ্য ব্যতীত আমি তা গ্রহণ করি না।’ -সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৪৭৩
,
বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে, যদি আপনারা স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহাম বিষয়ক হাদীসগুলোর পাঠ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। স্বপ্নের বিষয়ে হাদীসে একথা বলা হয়নি যে, যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটা ভালো। কাশফ-ইলহামের ক্ষেত্রেও বলা হয়নি, যেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটা ভালো। বরং বলা হয়েছে, যেটা ভালো সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই কোনো স্বপ্ন কাশফ-ইলহামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলতে হলে আগে তা ভালো হওয়া প্রমাণিত হতে হবে। আর ভালো-মন্দ নির্ণয়ের মাপকাঠি হল শরীয়ত।
,
★সুতরাং আওলিয়ায়ে কেরামদের ইলহাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা আকীদা রাখবো যে,
১. আলিমুল গাইব একমাত্র আল্লাহ তাআলা। স্বপ্ন, কাশফ-ইলহাম ও কারামতের মাধ্যমে কোনো বিষয় জানতে পারাকে ইলমুল গায়ব বলে না। কেননা এটা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়। বরং আল্লাহ যখন জানান তখনি জানতে পারেন। আবার এ জানাটাও নিশ্চিত জ্ঞান নয়। তাই এ ধারণা রাখার কোনো অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাগণ গায়েব জানেন।
২. ওহী শরীয়তের দলিল। আর নবী ছাড়া অন্য কারো স্বপ্ন, কাশ্ফ ও এলহাম শরীয়তের দলিল নয়। এর দ্বারা কোন বিধি-বিধান সাব্যস্ত হবে না। আকীদা-বিশ্বাস প্রমাণ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আত-তাশাররুফ বিমারিফাতি আহাদীসিত তাসাওউফ, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. পৃ. ২৬২
৩. এগুলো বিশ্বাস করা যাবে, যদি তাতে কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়ত বিরোধী কিছু না থাকে। বরং শরীয়তের বিধানের অধীন থেকে এর দ্বারা কোনোভাবে উপকৃত হতে পারলে তাও করা যাবে। যেমন, স্বপ্নে দেখল অমুক কাজটা করলে তার ব্যবসায় বরকত হবে। আর এ কাজটা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয় বরং ভাল। তাহলে তার জন্য এ কাজ করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু স্বপ্নে দেখা এই নির্দেশকে শরীয়তের হুকুম মনে করা যাবে না।
,
অতএব এটা স্পষ্ট হল যে, কাশফ-ইলহাম কখনো শরীয়তের দলীল ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না।
,
কিছু উলামায়ে কেরামদের দাবী হলোঃ
আল্লাহ্ তা‘য়ালা প্রদত্ত ইলহাম এর জ্ঞান দ্বারা আজ থেকে প্রায় সাড়ে আটশত বছর পুর্বে ( হিজরী ৫৪৮ সাল মোতাবেক ১১৫২ সালে খ্রিস্টাব্দে) শাহ নেয়ামতুল্লাহ রহঃ তার বিখ্যাত কাব্যগুলো রচনা করেন। অনেক ওলী আউলিয়া মাশায়েখগণ মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইলহাম পেয়ে থাকেন।
,
★★সুতরাং প্রশ্নে উল্লেখিত শাহ নিয়ামতউল্লাহর কাসিদা সওগাত কখনো শরীয়তের দলীল ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না।
,
এগুলো বিশ্বাস করা যাবে, যদি তাতে কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়ত বিরোধী কিছু না থাকে।