আমাদের মহানবী সা. এমন একটি সময় আরব ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন আরব সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করছিল।
এ সমাজে ছিল না কোনো নিয়মনীতি ও আইনের শাসন। গোত্রীয় কলহ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, সামাজিক শ্রেণিভেদ, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া প্রভৃতি সমাজকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছিল। ঐতিহাসিকরা আরবের এই সময়কে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। জাহেলিয়া যুগের এই রক্তপাত, অন্যায় ও অনাচার বালক মুহাম্মদ সা.-এর মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি সমাজের সব অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশেষে তাঁর মনে একটি অভিনব চিন্তার উদয় হলো। তিনি তাঁর সমবয়সী কতিপয় যুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংঘ গড়ে তুললেন। এ সংগঠন সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। (আসলে নামটি হবে ‘হালফুল ফুজুল'( حلف الفضول )
আরবি حلف শব্দের অর্থ শপথ, চুক্তি বা অঙ্গীকার। الفضول শব্দটির অর্থ কল্যাণ, শান্তি, মর্যাদা- সম্মান ইত্যাদি। অর্থাৎ হালফুল ফুযুল অর্থ কল্যাণের অঙ্গীকার বা শান্তিসংঘ ।) আরব সমাজের সব অন্যায় প্রতিরোধের লক্ষ্যে হিলফুল ফুযুল গঠিত হলেও একটি বিশেষ যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী সা. এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন বলে মনে করা হয়। এ যুদ্ধের নাম ‘হরবুল ফুজ্জার’ বা অন্যায় সমর।
সম্ভবত ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওকাজ মেলার (মক্কার ওকাজ নামক স্থানে প্রতিবছর এই মেলা বসত) ঘোড়দৌড়, জুয়াখেলা ও কাব্য প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে পবিত্র জিলকদ মাসে মক্কার কোরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। আরবে পবিত্র জিলকদ মাস ছিল শান্তির মাস। এ মাসে আরব দেশে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই জিলকদ মাসে শুরু হওয়া এ যুদ্ধকে ‘হরবুল ফুজ্জার’ (মতান্তরে ‘ফিজার’) বা অন্যায় সমর বলা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর স্থায়ী এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বালক মুহাম্মদ সা.-এর কোমল মনকে মারাত্মকভাবে ব্যথিত করে তোলে। এ যুদ্ধে অনেক লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ১৪ কিংবা ১৫ বছর (সিরাতে ইবনে হিশাম)। যদিও তিনি অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি; কিন্তু এই যুদ্ধের বীভৎসলীলা দেখে বালক মুহাম্মদ সা. অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং আরববাসীদের এরূপ ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ভাবতে থাকেন। আরবে শান্তি বজায় রাখার জন্য তিনি একটি শান্তিসংঘ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সমমনা নিঃস্বার্থ কিছু উৎসাহী যুবক ও পিতৃব্য জুবাইরকে নিয়ে তিনি এ শান্তিসংঘ গঠন করেন। এ সংঘের চারজন বিশিষ্ট সদস্য ফজল, ফাজেল, ফজায়েল ও মোফাজ্জেলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘হিলফুল ফুজুল’।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيمَ، قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ عُلَيَّةَ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ إِسْحَاقَ، عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: شَهِدْتُ مَعَ عُمُومَتِي حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ، فَمَا أُحِبُّ أَنْ أَنْكُثَهُ، وَأَنَّ لِي حُمْرَ النَّعَمِ.
আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, আমি আমার চাচাদের সাথে মুতাইয়্যাবীনের চুক্তিতে (হিলফুল ফুযূল) শরীক ছিলাম। বহুমূল্য লাল উটের বিনিময়েও তা লংঘন করা আমার পছন্দনীয় নয় (আহমাদঃ ১৬৫৫ ও ১৬৭৬)।