জবাবঃ-
উক্ত লেখাটি দারুল উলূম দেওবন্দের মাসিক ‘দারুল উলূম’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গাজি আবদুর রহমান কাসেমির রচনার ছায়া অবলম্বনে লেখা হয়েছে এবং রেফারেন্সগুলোও সেখান থেকেই সংগৃহীত হয়েছে। মাসিক আল- ফাতেহ নামক অনলাইন একটি পত্রিকায় এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। আমরা সেখান থেকে সংগ্রহ করেছি----
ইসলামে কুফুর, কাফের ও কাউকে কাফের বলে ঘোষণা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়। সমকালে বিষয়টি জনপরিসরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র এই রচনাটিতে এ সংক্রান্ত সূক্ষ্ম ও জটিল আলোচনায় না গিয়ে এর সাধারণ ও প্রাথমিক কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হবে।
পরিভাষার সাথে শব্দমূলের একটা গভীর যোগাযোগ থাকে। সেটা ধরতে পারলে পরিভাষাটিকে গভীর থেকে বুঝা সহজ হয়। এ জন্য পারিভাষিক অর্থে যাওয়ার আগে শাব্দিক অর্থের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আরবি ‘কুফরুন’ শব্দের মধ্যে ঢেকে দেওয়া, অকৃতজ্ঞতা করা ও আল্লাহকে অস্বীকার করার অর্থগুলো পাওয়া যায়।
পারিভাষিকভাবে কুফুরকে পরিচয় করাতে গিয়ে নানাজন নানা শব্দে একে উল্লেখ করেছেন। শব্দ ভিন্ন হলেও একটু গভীরভাবে দেখলে বুঝা যাবে মর্মগতভাবে সবগুলো আসলে একই অর্থ ধারণ করছে। যেমন, আল্লামা ইবনে হাজম রহ. বলেছেন : আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করা, কুরআনুল কারীমে যে সকল নবীর নুওয়াত প্রমাণিত হয়েছে, তাদের কোন একজনের নবী হওয়াকে অস্বীকার করা, কিংবা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল বিষয় নিয়ে এসেছেন, সেগুলো থেকে এই অস্বীকারকারীর নিকট যেগুলো বিরাট দলের বর্ণনার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, তার কোন কিছুকে অস্বীকার করা; অথবা, এমন কোন কাজ করা, যার কুফুরী হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—এমন সব কিছুর জন্য আল্লাহ তাআলা ‘কুফরুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। (আল ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়াননিহাল, ৩:১১৮)
এখানে অস্বীকার করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্বীকার না করা। সুতরাং যদি এমন হয়, একজন লোক এগুলোকে অস্বীকার করে না, আবার স্বীকারও করে না; হয়তো সে বিশ্বাস করে না, বা তার সন্দেহ আছে; তাই সে চুপ থাকে ও এড়িয়ে চলে, তাহলে সেও কাফের বলে বিবেচিত হবে। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সংজ্ঞার মধ্যে এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। (মাজমুউল ফাতওয়া, ১৩:৩৩৫)
ইবনে হাজমের সংজ্ঞার শেষ অংশটুকু পরিস্কার হওয়ার জন্য আমরা আরেকটি সংজ্ঞার দিকে দৃষ্টিপাত করি। ইমাম ইবনুল ওয়াজির বলেন : কুফুরের মূল কথা হলো—আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ জ্ঞাত কিতাব সমূহের কোন অংশকে স্বেচ্ছায় মিথ্যা বলা, কোন রাসূলকে অস্বীকার করা, অথবা তারা যা যা নিয়ে এসেছেন, তার মধ্য থেকে যেগুলোর ব্যাপারে স্বভাবত আবশ্যকীয়ভাবে মুসলমানমাত্রই জ্ঞাত থাকে, সে রকম কোন অংশকে অস্বীকার করা (ইসারুল হক: ৩৭৬)। আরেক জায়গায় তিনি কুফুরের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেখানে এসব বিষয়কে অস্বীকার করার পাশাপাশি এগুলোর প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থের বাইরে অপব্যাখ্যা করাকেও কুফুর বলে আখ্যায়িত করেছেন (ইসারুল হক: ২২৩)। ধরা যাক, পরকালে জান্নাত মানে কী এটা স্বভাবত আবশ্যকীয় জ্ঞাত একটি বিষয়। এখন কেউ যদি জান্নাতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, এর মানে হলো দুনিয়ার জীবনে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবনযাপন—এই অপব্যাখ্যা কুফুরি হবে।
“স্বভাবত আবশ্যকীয়ভাবে মুসলমানমাত্রই জ্ঞাত”—এর ব্যাখ্যায় আল্লামা কাশ্মিরী রহ. বলেন : এসব বিষয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলো : দীনের সেইসব অকাট্য ও সুনিশ্চিত বিষয়সমূহ যেগুলোর দীনের অংশ হওয়ার ব্যাপারটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং তা প্রজন্ম পরম্পরা ও প্রশিদ্ধি লাভ করেছে। এমন যে সাধারণ মুসলমানগণও এসবের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। যেমন তাওহিদ, নবুওয়াত, খতমে নবুওয়াত, পুনরুত্থান, শাস্তি ও প্রতিদান, নামাজ ও জাকাত ওয়াজিব হওয়া, মদ হারাম হওয়া ইত্যাদি।
একটা প্রশ্ন হতে পারে—এমন গাফেল মুসলমানও তো আছে, যে এমন সাধরণ বিষয়গুলোর কোন কিছু না জানতে পারে। তার ক্ষেত্রে কী হবে? এবং দীনের কোনো বিষয় এ পর্যায়ে পোঁছার মানদণ্ড কী হবে? এ প্রশ্নের জবাবে আল্লামা কাশ্মিরী রহ. বলেছেন : এমন ব্যাপক প্রশিদ্ধির মানদণ্ড হলো : সাধারণ মুসলমানের সকল স্তরে এ সবের সংবাদটি পোঁছে যাওয়া। এখন, প্রত্যেকেই জানতে হবে—এমনটি জরুরী নয়। এমনিভাবে সাধারণ মুসলমানের যে স্তর দীনের ব্যাপারে আগ্রহ রাখে না, তাদের মধ্যে পোঁছাও জরুরী নয়। বরং, যে স্তরগুলো দীনের ব্যাপারে আগ্রহ রাখে, তেমন স্তরগুলোতে পোঁছে গেলেই বিষয়গুলো “স্বভাবত আবশ্যকীয়ভাবে মুসলমানমাত্রই জ্ঞাত” বলে প্রমাণিত হবে (ইকফারুল মুলহিদীন : ২,৩)। এমন কোন কিছুকে স্বীকার না করলে সে ব্যক্তি কাফের হবে, এবং তাকে কাফের বলার কাজটিকে তাকফীরকরণ বলা হয়।
কুফরের এই সংজ্ঞা ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় ‘তাকফীর’ বা কাউকে কাফের বলার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সতর্কতা-আবশ্যক একটি বিষয়। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কুফরের প্রকার নিয়ে কিছু আলোচনা করা সঙ্গত হবে।
কুফরের প্রকার :
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন : কুফর দুই প্রকার : কর্মগত কুফর ও অস্বীকারমূলক কুফর
অস্বীকার মূলক কুফর : নবীজি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছেন—এটা জানার পরও অস্বীকার করা। যেমন, আল্লাহ তাআলার নামসমূহ, তাঁর কোন গুন বা কর্ম বা কোন বিধান।
কর্মমূলক কুফর : এটি দুই রকমের হতে পারে : এক. যার কারণে মানুষ ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়। মুর্তিপূজা করা, কুরআনুল কারীমকে অস্বীকার করা, কোন নবীকে হত্যা করা বা গালি দেওয়া। দুই. যার কারণে ইসলাম থেকে বের হয় না, তবে গুনাহগার হয়। যেমন, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানাবলী অনুযায়ী ফায়সালা না করা, নামাজ না পড়া। এমনিভাবে হাদীসে যে জিনাকারী, চোর ও মদ্যপের ঈমানকে নাকচ করা হয়েছে, তা এ দৃষ্টিকোণ থেকেই। অর্থাৎ, কর্মগত কুফর; আকীদাগত অস্বীকারমূলক কুফর নয় (আস্সালাতু ওয়া আহকামু তারিকিহা : ৫৬,৫৭)। তবে, এর জন্য শর্ত হলো এসবকে সে হালাল মনে না করতে হবে। পক্ষান্তরে এগুলোকে যদি সে হালাল মনে করে তাহলে সে সরাসরি কাফের হয়ে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে (কাজি ইয়াজকৃত ইকমালুল মু’লিম, ১:৩১৯)।
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. আকীদাগত অস্বীকারমূলক কুফর ও কর্মগত কুফরের মধ্যে যে ব্যবধান দেখিয়েছেন, এর পর্যালোচনা করতে গিয়ে শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানি রহ. বলেন : ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনুল কাইয়িম রহ. এই দুই কুফুরের মধ্যকার পার্থক্যের উপর সবসময় খুব জোর দিতেন। এই ব্যবধানটুকু সামনে না রাখলে সেই মুসলমান নিজের অজান্তেই মুসলমানদের জামাত থেকে বের হয়ে যাবে। খুরুজ বা বের হয়ে যাওয়ার এই ফিতনায় নিপতিত হয়েছিল পুরনো যুগের খারেজিরা এবং সমকালে নিপতিত হয়েছে তাদের অনুসারীরা (ফিতনাতুত তাকফীর : ২৭)।
এই ব্যবধানটি সামনে রাখলে আমরা তাকফীর বা কাউকে কাফের বলার ক্ষেত্রে নির্ভুল থাকতে পারব। কারণ অনেক সময় দেখা যায় এমন কিছু শব্দের কারণেও লোকজন একে অপরকে কাফেল বলতে থাকে, যেগুলো কেবল বিভিন্ন রেওয়ায়েত ও হাদীসের মধ্যে এসেছে; অথচ, অনেক সময়ই দেখা যাবে এর সম্পর্ক আকীদাগত অস্বীকারমূলক কুফুরের সাথে নয়; কর্মগত কুফুরের সাথে। যার দ্বারা মানুষ কাফের হয় না; ফাসেক ও পাপী হয় কেবল।
এখন আমরা তাকফীর বা কাউকে কাফের বলে ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। তাকফীরের বিষয়টিও দুই ধরণের :
১. তাকফীরে মুতলাক বা সাধারণভাবে তাকফীর : কারো নাম না নিয়ে শুধু কুফরের বিষয়টির ব্যাপারে বলা যে, এই কাজটি করলে, বা এই বিশ্বাস রাখলে অথবা এই বিষয়টি না মানলে মানুষ কাফের হয়ে যাবে।
২. তাকফীরে মুআইয়ান বা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে কাফের বলা : এটা বলতে হলে সেই ব্যক্তির মধ্যে কুফুরের বিষয়টি পাওয়া গেছে কি না সে ব্যাপারে অকাট্য দলীল-প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিত হতে হবে। শুধুমাত্র ধারণা বা অনুমানের ভিত্তিতে এ কাজ করা বৈধ নয়। যেমন কাদিয়ানি কাফের হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত।
আমরা অনেক সময় মনে করি শুধুমাত্র কালেমা পড়লেই বুঝি একজন মানুষ মুসলামান হয়ে যায়। এই ধারণা সত্য নয়। বরং, কোন ব্যক্তি মুসলমান হলো নাকি কাফের হলো এটা বুঝার জন্য উপরের আলোচনার সবটুকু মাথায় রাখা জরুরী। ফলে, এমন হতে পারে কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাসসহ ইসলামের সকল বিষয়ে বিশ্বাস রাখে, কিন্তু সুদকে হালাল মনে করে, সে কাফের হয়ে যাবে। এই জায়গাটিতে এসে কারো কারো ভেতরে একটা অন্ধ আবেগ কাজ করে। সে বলে : কী দরকার লোকজনকে খুঁটে খুঁটে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার জন্য আসেননি। এসেছেন কুফুর থেকে বাঁচাতে। মনে রাখি, ইসলাম থেকে বের করে দেওয়া যায় না। ব্যক্তি নিজে বের হয়ে যায়। এখানে বের করে দেওয়ার কোন অপশনই নেই। এখন কেউ যদি নিজে বের হয়ে যায়, এবং সে বের হয়ে গেছে বলে শরীয়ত স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তাকে মুসলমান বলে জোর করে ধরে রাখার অধিকার কারো নেই। সিদ্ধান্তটা আসবে একাডেমিক বিবেচনা থেকে; আবেগ এখানে মূল্যহীন। অপরদিকে কেউ যদি প্রকৃতপক্ষে কাফের না হয়ে থাকে, তাহলে তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেওয়া ভয়ানক অপরাধ। হাদীসে এসেছে, কোন মুসলমান যখন অপর মুসলমানকে কাফের বলে, আর প্রকৃতপক্ষে সে কাফের না হয়, তাহলে সেই কুফুরি এসে তার নিজের উপর পতিত হয়।(শেষ)