بسم الله الرحمن الرحيم
জবাব,
ইসলামে
ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিমের প্রতি ইসলামের প্রথম বার্তাই- اِقْرَاْ- পড়, ইলম অর্জন কর। ইসলাম থেকে ইলমকে আলাদা করা অসম্ভব। ইসলামের প্রতিটি
অংশের মধ্যেই ইলম বিরাজমান। ইলম ছাড়া যথাযথভাবে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। ইলম ছাড়া ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন- কোনো ক্ষেত্রেই
সত্যিকার অর্থে ইসলাম পালন সম্ভব নয়। তাবেঈ উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. বলেন-
من عمل على
غير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح.
যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে সে সঠিকভাবে যতটুকু করবে না করবে, বরবাদ করবে তার চেয়ে বেশি।
-তারীখে তাবারী ৬/৫৭২
দ্বীনী
ইলমের বিভিন্ন স্তর ও ভাগ রয়েছে। একটি ভাগ ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া হিসাবে। ফরযে আইন
বলা হয়, যা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। বিশেষভাবে
এই প্রকারের ইলমের ব্যাপারেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
طَلَبُ
الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ.
প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম অর্জন করা ফরয। -মুসনাদে
আবু হানীফা (হাছকাফী), হাদীস ১, ২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৪
নিয়ত বিশুদ্ধ
করা
সকল আমলের
ক্ষেত্রেই নিয়ত একটি বড় বিষয়। এমনকি মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য সূচিত হয় এই নিয়তের
মাধ্যমে। মুমিন এজন্যই মুমিন যে, সে ঈমান গ্রহণের ক্ষেত্রে তার নিয়ত ঠিক রেখেছে অর্থাৎ শুধুমাত্র
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ঈমান এনেছে। আর মুনাফিক এই কারণেই মুনাফিক যে, সে তার ঈমানের ক্ষেত্রে নিয়তকে
বিশুদ্ধ রাখেনি। খালেস নিয়তের দ্বারা বাহ্যত ছোট আমলও আল্লাহর দরবারে অনেক বড় হয়ে যায়।
আবার নিয়তের গড়মিলের কারণে অনেক বড় আমলও বিফলে যায়।
ইলম শিক্ষার
পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও বিশুদ্ধরূপে আমল করা ছাড়াও পার্থিব বহু উদ্দেশ্য সামনে
চলে আসে। এজন্য নিয়তের বিষয়ে ইলম অন্বেষণকারীর খুবই সতর্ক থাকা জরুরি। স্বয়ং আল্লাহর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ
تَعَلّمَ عِلْمًا مِمّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزّ وَجَلّ لَا يَتَعَلّمُهُ
إِلّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنّةِ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي رِيحَهَا.
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শিক্ষা করা হয় এমন
ইলম (দ্বীনী ইলম) যেই ব্যক্তি পার্থিব কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শিক্ষা করবে কিয়ামতের
দিন সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৪৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৬৪
অন্য এক
হাদীসে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا
تَعَلّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ، وَلَا تُمَارُوا بِهِ
السّفَهَاءَ، وَلَا تَخَيّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنّارَ
النّارَ.
তোমরা এই
উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা করো না যে, এর মাধ্যমে আলেমদের সাথে গর্ব করবে বা মূর্খদের সাথে বিবাদে
লিপ্ত হবে। কিংবা মজলিসের অধিকর্তা হবে। যে এমন করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম, তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
-সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৭৭
বিশিষ্ট
বুযুর্গ বিশর হাফী রাহ. বলেন-
لَا أَعْلَمُ
عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ عَمَلًا أَفْضَلَ مِنْ طَلَبِ الْعِلْمِ وَالْحَدِيثِ
لِمَنْ اتّقَى اللهَ وَحَسُنَتْ نِيّتُه.
পৃথিবীর
বুকে ইলম অন্বেষণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো আমল সম্পর্কে আমার জানা নেই; যদি অন্বেষণকারীর নিয়ত বিশুদ্ধ
থাকে এবং সে আল্লাহকে ভয় করে চলে। -আলআদাবুশ শারইয়্যাহ, ইবনে মুফলিহ ২/৩৭
ইলমের জন্য
দরকার মেহনত
হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
إِنّ
أَحَدَكُمْ لَمْ يُولَدْ عَالِمًا، وَإِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتّعَلّمِ.
তোমাদের
কেউই আলেম হয়ে জন্ম লাভ করে না। ইলম তো হাসিল হয় শিক্ষা করার মাধ্যমে। -আলমাদখাল ইলাস
সুনানিল কুবরা, বায়হাকী ১/২৬৭
হযরত ইবনে
আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার এত বিপুল ইলম কীভাবে অর্জিত হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন-
بِلِسَانٍ
سَؤُولٍ، وَقَلْبٍ عَقُولٍ.
অধিক জিজ্ঞাসাকারী
যবান ও সজাগ হৃদয়ের মাধ্যমে। -ফাযাইলুস সাহাবাহ, ইমাম আহমাদ ২/৯৭০; আলআহাদু ওয়াল মাছানী, ইবনু আবী আছেম ৩/২৯৩
ইলম অর্জনের
ক্ষেত্রে কষ্ট-মুজাহাদা শিকার করার ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ঘটনা
অতি প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন অল্প বয়সী সাহাবীদের একজন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
ওফাতের পর তিনি বড় বড় সাহাবীদের কাছে গিয়ে ইলম অন্বেষণ করতেন। আর এলাকার সমবয়সী ছেলেদেরকেও
বলতেন, চল আমরা সাহাবীদের কাছে গিয়ে ইলম শিক্ষা করি। কেননা তাঁরা তো
এখন অনেকেই জীবিত। বন্ধুরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলত, এত বড় বড় সাহাবী থাকতে কি
মানুষেরা তোমার ইলমের মুখাপেক্ষী হবে? ফলে তারা যেত না আর তিনি গিয়ে সাহাবীদের
কাছ থেকে ইল শিক্ষা করতেন।
তিনি বলেন, আমি যখন শুনতাম অমুক সাহাবীর
কাছে ইলম আছে তাঁর বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। কোনো সময় এমনও হত যে, সাহাবীর আসতে দেরি হচ্ছে আর
আমিও ক্লান্ত। তখন আমি তাঁর অপেক্ষায় আমার চাদরখানাকে বালিশ বানিয়ে তাঁর দরজায় শুয়ে
পড়তাম। আর বাতাসে ধূলা উড়ে এসে আমার শরীর ধূলা ধূসরিত হয়ে যেত। যখন সাহাবী বাড়ি থেকে
বের হয়ে তাঁর দরজায় আমাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখতেন; তখন বলতেন, আয় আল্লাহ! নবীজীর চাচাত ভাইয়ের
এ কী অবস্থা! আমাকে সম্বোধন করে বলতেন, আপনার কোন্ জিনিসের প্রয়োজন? আমার কাছে খবর পাঠালে আমি
নিজেই আপনার বাড়িতে গিয়ে হাযির হতাম। তখন আমি বলতাম, কখনোই না। আমিই আপনার কাছে
আসার বেশি মুখাপেক্ষী। এরপর আমি তাঁর থেকে হাদীসের জ্ঞান হাসিল করতাম।
একসময় যখন
বড় বড় সকল সাহাবা একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন লোকজন দ্বীনী জ্ঞান হাসিল করার জন্য
আমার চারপাশে ভিড় জমাতে লাগল। তখন ঐ আনসারী ছেলেরা আমাকে দেখে বলত-
كَانَ هَذَا
الْفَتَى أَعْقَلَ مِنّا.
এই যুবকই
আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছিল। -সুনানে দারেমী, হাদীস ৫৯০; তবাকাতু ইবনে সা‘দ ২/২৮৪
হাদীস শরীফে
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলেম ও তালিবে ইলমের প্রশংসা করে ইরশাদ
করেছেন-
وَإِنّ
الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنّهُ
لَيَسْتَغْفِرُ لِلْعَالِمِ مَنْ فِي السّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، حَتّى الْحِيتَان
فِي الْمَاءِ، وَفَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى
سَائِرِ الْكَوَاكِبِ.
নিশ্চয়
ফেরেশতাগণ তালিবে ইলমের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। আর আলেমের
জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকে আসমান-যমীনের সবকিছু। এমনকি পানির নিচে থাকা মাছ। (অন্য
বর্ণনায়, গর্তের পিপিলিকা।) আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর তেমন তারকারাজির
মাঝে চন্দ্র যেমন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৭১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮২, ২৬৮৫; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/১৬১
★প্রিয় প্রশ্নকারী
দ্বীনি ভাই/বোন!
ইলম অর্জন করলে মানুষ আল্লাহ তায়ালার নিকট দামী হয়ে যায়।
বিধায় শয়তান সবসময় চেষ্টা করে কিভাবে তাকে ইলম অর্জন থেকে দূরে রাখা যায়।
প্রশ্নেল্লিখিত ছুরতে আপনি আপনার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতে
থাকুন। পূর্ণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কোন ত্রুটি থাকলে গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। যেকোন
জায়গা থেকে আপনি ইলম অর্জন করতে পারেন। তবে ইলম অর্জনে এ নিয়ত থাকবে
যে, ইলম অন্বেষণ
করা, এর জন্য মেহনত করা আল্লাহ
তাআলা পছন্দ করেন এবং তিনি এতে অত্যন্ত খুশি হন। ইলমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পরিচয়
পাওয়া যায়; তাঁর আদেশ-নিষেধ
জানা যায় এবং সিরাতে মুস্তাকীমের সন্ধান লাভ করা যায়। ইলমের মাধ্যমে আল্লাহর কালাম
ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী জানা ও বোঝা যায়। ইলমের দ্বারা
নিজের ও অন্যের সব ধরনের মূর্খতা দূরীভ‚ত হয়। সর্বোপরি ইলমের মাধ্যমে
আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় দ্বীন ও শরীয়তের দাওয়াত এবং দ্বীনের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার
কাজ আঞ্জাম দেওয়া যায়। সুতরাং শুধু এসব উদ্দেশ্যেই একমাত্র আল্লাহ পাককে সন্তুষ্ট করার
জন্য আমরা ইলম শিক্ষা করব এবং তা অর্জনের জন্য চেষ্টা-মেহনত করব।