জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
শিশুদের কে প্রহার করা যাবেনা।
করলে তাদের পিতামাতার অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ কিছু শর্ত মেনে হাত দ্বারা প্রহার করা যাবে।
কোনোভাবেই বেত/লাঠি দ্বারা প্রহার করা যাবেনা।
চেহারা লজ্জাস্থান বাদ দিয়ে অন্যত্রে আস্তে মারতে পারেন,তবে সেক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে ৩ বারের অধিক মারা যাবেনা,তার সহ্যের বাহিরে মারা যাবেনা।
রাগান্বিত অবস্থায় ছাত্রদের প্রহার করা নাজায়েজ।
বিশেষ প্রয়োজনে শিক্ষক প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রকে হাত দিয়ে বা বেত দিয়ে চেহারা লজ্জাস্থান বাদ দিয়ে অন্যত্রে আস্তে মারতে পারেন,তবে সেক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে ৩ বারের অধিক মারা যাবেনা,তার সহ্যের বাহিরে মারা যাবেনা।
তবে তাদেরকেও প্রহার না করে ধমক দেওয়াই বেশি উত্তম।
হযরত থানভী রাহ. বলেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কখনও শিশুকে প্রহার করবে না (পিতা ও উস্তাদ) উভয়ের জন্যই এই কথা)। রাগ প্রশমিত হওয়ার পর চিন্তা-ভাবনা করে শাস্তি দিবে। উত্তম শাস্তি হল ছুটি মওকুফ করে দেওয়া,বা তাকে তার কোনো পছন্দের খেলা খেলতে দুরে রাখা,কোনো পছন্দের কাজ না করতে দেওয়া। শিশুর উপর এর খুব প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।
মনে রাখবে, যার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করার কেউ থাকে না তার সম্পর্কে প্রশ্নকারী স্বয়ং আল্লাহ। এমনকি কোনো যিম্মী (মুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিক, যার নিরাপত্তা মুসলিম শাসকের যিম্মায়) কাফিরের উপর যদি কোনো শাসক জুলুম করে তাহলে হাদীস শরীফে এসেছে যে, আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। (আনফাসে ঈসা পৃ. ১৭৩)
এ সংক্রান্ত মাসিল আল কাউসারে প্রকাশিত আর্টিক্যাল নিচে তুলে ধরছিঃ
শিশুদেরকে প্রহার করা অত্যন্ত ভয়াবহ
শিশুদেরকে প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। আমাদের পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলতেন, অন্যান্য গুনাহ তো তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে, কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা, এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তওবার দ্বারা মাফ হয় না, যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে হচ্ছে নাবালেগ। নাবালেগের ক্ষমা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি শিশু যদি মুখে বলেও যে, আমি মাফ করলাম তবুও তা গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এই অপরাধের মাফ পাওয়া খুব জটিল। আর তাই শিশুদেরকে প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত।
ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শৈশব-কৈশরই হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তিকাল। স্বচ্ছ মেধা, সুস্থ বুদ্ধি, সরল চিন্তা ও স্পষ্ট মনোযোগের কারণে শিশুরা সহজেই সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে। সঙ্গত কারণেই তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিও অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।
এখানে মনে রাখা উচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে শিশুদের পরিচয়, তারা গায়রে মুকাল্লাফ তথা দায়ভার ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত। তারা শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল তেমনি মানসিকভাবেও কোমল। তাই তাদের সাথে কোমল ও নরম আচরণ করতে হবে। তাদেরকে শিক্ষাদান করতে হবে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ডাঁট-ধমক ও কঠোরতা পরিহার করে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে। যে নম্রতা ও কোমলতার আচরণ করতেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার সাথে করতেন।
আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোরতাকারীরূপে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ-কোমল আচরণকারী শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৭৮
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুল-ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সাথে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক ও ভৎর্সনা নয়।-আর রাসূলুল মুয়াল্লিম, পৃ. ১১
খতীবে বাগদাদীখ্যাত ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে আলী রাহ. শিক্ষকের আদাব সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, শিক্ষকের উচিত, ভুলকারীর ভুলগুলো কোমলভাবে ও নরম ভাষায় বলে দেওয়া, কঠোর আচরণ ও রুক্ষ ভাষার মাধ্যমে নয়।-আলফকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ ২/২৮৪
তিনি তার এ বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।
১. হযরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম রা. বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নামাযরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাযের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রতিউত্তরে আমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের উরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করলেন। আমার পিতামাতা তার প্রতি উৎসর্গিত হোন, তার মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তার পূর্বেও কাউকে দেখিনি এবং তার পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বললেন, আমাদের এই নামায মানষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। (অর্থাৎ নামাযে এ ধরনের কথা বলা যায় না।) বরং এ তো হল তাসবীহ, তাকবীর ও তেলাওয়াতে কুরআন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৩৭; আবু দাউদ, হাদীস : ৯৩০
২. হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কোমল আচরণকারী, তিনি সর্বক্ষেত্রে কোমলতাকে ভালবাসেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০২৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৬৫
মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হে আয়েশা! আল্লাহ তাআলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। তিনি নম্রতার জন্য এমন কিছু দান করেন, যা কঠোরতার জন্য দান করেন না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৩
৩. হযরত জারীর রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে প্রকৃত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮০৭
৪. হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোমলতা যে কোনো বিষয়কে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। আর কোনো বিষয় থেকে কোমলতা দূর হয়ে গেলে তাকে কলুষিত করে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৯৪
ইমাম মুহিউদ্দীন নববী রাহ. শিক্ষকের আদাব সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় বলেন, শিক্ষকের উচিত, তার ছাত্রের সাথে নরম ব্যবহার করা, তার প্রতি সদয় হওয়া। তার কোনো ভুল হলে বা অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রকাশ পেলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা। বিশেষত শিশু-কিশোরদের বেলায়।
তিনিও এ বিষয়ে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। একটি হাদীস এই- হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই মানুষ তোমাদের অনুসারী হবে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন দ্বীন শেখার জন্য তোমাদের নিকট আগমন করবে। যখন তারা আগমন করবে, তোমরা তাদের হিতকাঙ্খী হবে এবং তাদেরকে সদুপদেশ দিবে।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৫০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৪৯; (আততিবয়ান পৃ. ৫৬-৫৭)
রাগান্বিত অবস্থায় শিশুদের প্রহার করা অন্যায় স্বভাব-প্রকৃতির কারণেই শিশুরা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তাই শিশুদের শিক্ষাদান খুবই কঠিন। শান্ত-শিষ্টতার চেয়ে চপলতা ও চঞ্চলতাই তাদের মধ্যে প্রবল। ফলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কষ্টকর। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, শিক্ষকের মধ্যে ক্রোধের ভাব সৃষ্টি হয়ে যায় এবং প্রহার করার অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। এ সময় শাস্তি দিবে না; বরং নীরব-নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ দূর করবে। তারপর করণীয় ঠিক করবে। এটাই ইসলামের শ্বাশ্বত শিক্ষা ও ধর্মীয় নির্দেশনা।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান কর, সহজ ও কোমল আচরণ কর; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫৫৬, ২১৩৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৮৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১৫২, ১৫৩; মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস : ২৬০৮; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস : ২৪৫,
আল-আদাবুল মুফরাদের অন্য বর্ণনায় আছে, ‘তোমরা শিক্ষাদান কর এবং সহজ-কোমল আচরণ কর’ এ কথা তিনবার বলা হয়েছে।-হাদীস : ১৩২০
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আমাকে আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৬৩৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ২৯৬
রাসূলের জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না।’ লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তা বলার পর আমি চিন্তা করে দেখলাম, ক্রোধই হল সকল অনিষ্টর মূল।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩১৭১; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ২০২৮৬;
শিশুদেরকে বা অন্য কাউকে প্রহার করা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তার থেকে এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।-আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস : ১৮৬, মুসনাদে বাযযার, হাদীস-৩৪৫৪, তাবারানী, হাদীস-১৪৬৮
এ সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, কখনো রাগান্বিত অবস্থায় শিশুকে প্রহার করবে না। পিতা ও উস্তাদ উভয়ের জন্যই এ কথা। এ সময় চুপ থাকবে। যখন ক্রোধ দূর হয়ে যাবে তখন ভেবেচিন্তে শাস্তি দিবে। এতে শাস্তির মাত্রা ঠিক থাকবে। সীমালঙ্ঘন হবে না। কিন্তু যদি রাগান্বিত অবস্থায় মারতে আরম্ভ কর, তাহলে এক থাপ্পড়ের জায়গায় দশ থাপ্পড় দিয়ে ফেলবে। এর কারণে একে তো গুনাহ হল। কেননা, প্রয়োজনের অধিক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত এতে শিশুর ক্ষতি হবে। কেননা, সকল বিষয়ই মাত্রা অতিক্রম করলে ক্ষতি হয়ে যায়। তৃতীয়ত এর জন্য পরে অনুতাপ করতে হবে। তাই তিনি বলেছেন, ক্রুব্ধ অবস্থায় শাস্তি দিবে না।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলেছেন, শিশুদেরকে প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য গুনাহ তো তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তওবার দ্বারা মাফ হয় না। যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে হচ্ছে নাবালেগ। নাবালেগের ক্ষমা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জটিল। আর তাই শিশুদেরকে প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত।-ইসলাহী মাজালিস, মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী।
আল্লামা ইবনে খালদূন ছাত্রদের প্রহার ও কঠোরতাকে ক্ষতিকর আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, খুব স্মরণ রাখবেন। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে প্রহার করা এবং ডাঁট-ধমক দেওয়া শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা উস্তাদের অযোগ্যতা ও ভুল শিক্ষা পদ্ধতির নমুনা। প্রহার করার ফলে শিশুদের মনে শিক্ষকের কঠোরতার প্রভাব বিরাজ করে। তাদের মন-মানসিকতায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং তারা লেখাপড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কঠোরতা তাদেরকে অধঃপতনমুখী করে তোলে। অনেক সময় তাদের মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, প্রহার ও কঠোরতার কারণে শিশুদের মাঝে মিথ্যা বলা ও দুষ্কর্মের মানসিকতা সৃষ্টি হয়। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ ও উচ্চ চেতনা দূর হয়ে যায়। শিক্ষকের মারধর থেকে বাঁচার জন্য তারা নানা অপকৌশল, মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এই সকল ত্রুটি তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। উত্তম চরিত্র ও সুন্দর মানসিকতার পরিবর্তে অসৎ চরিত্র ও অনৈতিকতার ভিত রচিত হয়।
এসব ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা ও নীতি নৈতিকতার বিষয়টি বাদ দিলেও শিশুদের প্রহারের অশুভ প্রতিক্রিয়া হয় বহুরূপী ও বহুমুখী। প্রথমত যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সুনামের সাথে তার শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে আসছে মারধরের দু-একটি ঘটনাই তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
দ্বিতীয়ত দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি বিরূপ মানসিকতার সৃষ্টি হয়। অনেক দ্বীনদার মুসলিম পরিবারেও এ অভিযোগ শোনা যায় যে, বাচ্চারা মাদরাসায় যেতে চায় না শিক্ষকের মারধর ও কঠোরতার কারণে। তৃতীয়ত, বাইরে মাদরাসার শিক্ষকদের ব্যাপারে দুর্নাম রটে যায় যে, তারা সবাই ছাত্রদের প্রহার করে। দুয়েকজনের অজ্ঞতামূলক আচরণের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজকে দুর্নাম বহন করতে হয়।
একদিকে জাগতিক শিক্ষার জন্য দুনিয়াবী লোকেরা শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন নিয়ে শিশু-কিশোরদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে এবং ইসলামের দেওয়া উন্নত চরিত্র ও মহৎ আচরণ, কোমল ও বিনম্র ভাষায় কথা বলে তাদেরকে জাগতিক শিক্ষার সুফল দেখাচ্ছে, অন্যদিকে দ্বীনী শিক্ষার সঙ্গে জড়িত দু-একজন ব্যক্তি ইসলামী দিক-নির্দেশনা ও শিক্ষার সুন্দর বৈশিষ্ট্য, উলামায়ে কেরামের মহৎ গুণাবলী পরিত্যাগ করে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা অত্যন্ত নাজুক বিষয়। এ জন্য উপযুক্ত শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করা এবং তাতে অংশ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
(লেখক মুহাম্মাদ আনসারুল্লাহ হাসান।
মাসিক আল কাওসার)
,
এজন্য শিশুর তরবিয়তের ক্ষেত্রে মূল পন্থা হল, কোমলতা ও সহনশীলতা। যে কোনো ভুল-ত্রুটি নজরে পড়লেই শাস্তির কথা ভাবা উচিত নয়। প্রথমে ক্ষমার কথা চিন্তা করা উচিত। ইমাম নববী রাহ. বলেন, ‘তাকে (ছাত্রকে) আপন সন্তানের মতো মমতা করবে এবং তার অন্যায় আচরণ ক্ষমা করে দিবে। কখনো কোনো বে-আদবী প্রকাশ পেলে ক্ষমা করে দিবে। কেননা, মানুষমাত্রই ভুল করে থাকে।’
এরপর কোমলতার সঙ্গে সংশোধনের চেষ্টা করবে।
শিশুর মন-মানস এবং স্বভাব-প্রকৃতির দিকে লক্ষ রাখা
কখনো শাস্তির প্রয়োজন হলে ঔষধ নির্ণয়ের মতো শাস্তির ধরন ও পরিমাণ নির্ণয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ক্রোধ চরিতার্থ করা নয়; উদ্দেশ্য হল শিশুর সংশোধন। এজন্য শাস্তির বিষয়ে অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সংযমের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।
সব শিশু প্রকৃতিগতভাবে এক ধরনের নয়। কেউ সামান্য তাম্বীহ দ্বারাই ঠিক হয়ে যায় আবার কাউকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেউ শাস্তির দ্বারা সংশোধিত হয়, কেউ আরো বিগড়ে যায়। এ বিষয়গুলো আগে থেকেই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্থির করা উচিত এবং যার জন্য যে পরিমাণ তাম্বীহ প্রয়োজন তার জন্য তা-ই প্রয়োগ করা উচিত।
তাম্বীহ ও শাস্তির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা
অনেকে বেত ও শাস্তিকে সমার্থক মনে করে থাকেন। যেন বেত ছাড়া শাস্তির কোনো উপায় নেই। অথচ এটা হল সর্বশেষ ব্যবস্থা। পূর্বের ব্যবস্থাগুলো পরীক্ষা না করে চুড়ান্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
ইবনে মাছকইুয়াহ বলেন, ‘শিশুর প্রথম ভুল ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। পুনরায় ওই ভুল হলে পরোক্ষভাবে তাম্বীহ করবে। যেমন তার উপস্থিতিতে বলা হল, ‘এই কাজ করা ঠিক নয়। কেউ যদি তা করে থাক তবে সাবধান হয়ে যাও। এরপর সরাসরি তাম্বীহ করা যায়। এরপরও যদি ওই ভুল হয় তাহলে হালকা প্রহার করা যায়। এই সবগুলো পর্যায় অতিক্রম করার পরও যদি দেখা যায় সে সংশোধিত হয়নি তাহলে কিছুদিন তাকে আর কিছু বলবে না। এরপর আবার প্রথম থেকে আরম্ভ করবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ইমাম মাওয়ারদী রাহ.-এর একটি নির্দেশনা উল্লেখ করেছেন। তা এই যে, ‘শিশুকে সংশোধন করা মুরববীর জন্য কঠিন হয়ে গেলে এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার মধ্যে আনুগত্য সৃষ্টি না হলে করণীয় হচ্ছে কিছু সময় তাকে অবকাশ দেওয়া। এরপর নতুনভাবে প্রচেষ্টা আরম্ভ করা।’-আততারবিয়াতু ওয়াত তা’লীম ফিলফিকরিল ইসলামী #
,
প্রহার বা শারীরিক শাস্তির সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু শর্ত, সংক্ষেপে পেশ করা হলো:
১. বালেগ হওয়া থেকে প্রহার করা যাবে এর আগে নয়। তবে আরও উত্তম হলো, বাচ্ছার ভালো-মন্দ পার্থক্য করার মত বয়স হয়ে গেলে এবং ভুল ও অপরাধ বোঝার মতো বুদ্ধি হয়ে গেলেই প্রহার করা যাবে।
২. আঘাতের সংখ্যা নির্ধারণ: প্রহার করার আগে শিক্ষককে অপরাধ ও অপরাধীর অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে আঘাতের সংখ্যা নির্ধারণ করে নিতে হবে। কারণ কোন কোন অপরাধীর ক্ষেত্রে কেবল একটি বেত্রাঘাত অপরাধ থেকে ফেরাতে যথেষ্ট। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে আরও বেশির প্রয়োজন হতে পারে। তবে সব সময় মনে রাখতে হবে আঘাতের সংখ্যা যেন দশ-এর বেশি না-হয়।
৩. শরীরের একই স্থানে প্রহার না করে বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা এবং হালকা ভাবে।
৪, মাথা, পেট ও লজ্জাস্থানের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় প্রহার করা যাবে না।
,
(০২)
শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের হক নিয়ে বিস্তারিতঃ
১। উস্তাদের আদব রক্ষা করাঃ কথা বার্তা, শব্দ প্রয়োগ, আচার-আচারন, উঠা-বসা, চলা-ফেরা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই আদব রক্ষা করতে হবে। যেমনঃ উস্তাদের আগে বেড়ে কথা না বলা, উস্তাদের সামনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জোরে কথা না বলা, তাঁদের দিকে পিছন দিয়ে না বসা, এক সঙ্গে চলার সময় তাঁদের সামনে না চল, তাঁদের সামনে বেশি না হাসা, বৃথা কথা না বলা ইত্যাদি।
২। শিক্ষকের প্রতি ভক্তি রাখাঃ শিক্ষকের সাথে ভক্তি সহকারে কথা বলা, ভক্তি সহকারে তাঁদের দিকে দৃষ্টি দেয়া এবং হাবভাব ভক্তি প্রকাশ করা কর্তব্য।
৩। শিক্ষকের আজমত ও শ্রদ্ধা করাঃ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে শ্রদ্ধা ও আজমতের সাথে তাঁদের সামনে হাজির হওয়া কর্তব্য।
৪। শিক্ষকের সাথে তাওয়াজু ও বিনয়ের সাথে থাকাঃ কথা-বার্তা ও আচার-আচরণ সবকিছুইতেই বিনয় থাকতে হবে। দুনিয়ার সব ক্ষত্রেই খোশমোদ তোষামোদ নিন্দনীয়; একমাত্র শিক্ষকের বেলায় তা প্রশংসনীয়।
৫। শিক্ষকের শরয়ী প্রয়োজনীয় খেদমত করাঃ এই খেদমতের মধ্যে শিক্ষক অভাবী এবং ছাত্র স্বচ্ছল হলে উস্তাদের বৈষয়িক সহযোগিতা করা এবং তাঁদেরকে হাদিয়া-তোহফা প্রদান করাও অন্তর্ভক্ত।
৬। শিক্ষকের হক অনেকটা পিতার মত। বস্তুত শিক্ষক হলেন রুহানী পিতা, তাই পিতার ন্যায় শিক্ষকের হকও তাঁর মৃত্যুর পরও বহাল থাকে। এ জন্যই শিক্ষকের মৃত্যুর পরও সর্বদা তাঁর জন্য দুয়া করা কর্তব্য। শিক্ষকের নিকটাত্নীয়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁদের খেদমত করা, এমনিভাবে শিক্ষকের বন্ধু-বান্ধব ও সমসাময়িক অন্যান্য শিক্ষকদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং প্রয়োজনে তাঁদের খেদমত করা কর্তব্য।
৭। কোন কারনে শিক্ষক অসন্তুষ্ট হলে বা শিক্ষকের মেজাযের পরিপন্থী কোনো কথা বলে ফেললে সাথে সাথে নিজের ত্রুটির জন্য ওজরখাহী করা এবং শিক্ষককে সন্তুষ্ট করা জরুরি।
৮। ছাত্রের কোনো অসংগত প্রশ্ন বা অসংগত আচরনের কারনে শিক্ষক রাগ করলে, বকুনি দিলে বা মারধর করলে ছাত্রের কর্তব্য সেটা সহ্য করা। এমনকি অন্যায়ভাবে কিছু বললেও তাঁর নিন্দা-শেকায়েত না করা এবং মন খারাপ না করা উচিত।
৯। ছাত্রের কর্তব্য মনোযোগের সাথে উস্তাদের বক্তব্য ও ভাষণ শ্রবন করা, অন্যমনষ্ক না হওয়া এবং শিক্ষকের কথা ভাল করে ইয়াদ/মুখস্ত করা।
১০। শিক্ষক কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে নিষেধ করলে তা মান্য করা উচিত এবং কখনো তাঁকে অসুবিধায় ফেলতে চেষ্টা না করা উচিত। কোনো বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন করাও নিষেধ। নিজের মেধার গৌরব প্রদর্শনের জন্য প্রশ্ন করা বা সস্পষ্ট কিংবা অর্থহীন প্রশ্ন করাও উচিত নয়।
১১। শিক্ষকের কোনো বক্তব্য বোধগম্য না হলে সে জন্য উস্তাদের প্রতি কুধারনা পোষন করবে না বরং বুঝতে না পারাকে নিজের বোধশক্তির ত্রুটি মনে করবে।
১২। শিক্ষকের মতের বিপরীত অন্য কারও মত তাঁর সামনে বয়ান করবে না।
১৩। পাঠ দানের সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকা উচিত। এদিক-সেদিক তাকানো, কথা-বার্তা বলা বা হাসি তামাশায় লিপ্ত হওয়া সম্পূর্ণ বর্জনীয়।
১৪। নিজের কোন ত্রুটি হলে শিক্ষকের সামনে অকপটে তা স্বীকার করে নেয়া কর্তব্য। অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমানিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত না হওয়া উচিত।
১৫। শিক্ষকের কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সে জন্য উস্তাদের প্রতি ভক্তি হারিয়ে না বসা বরং তার এমন কোন সুব্যাখ্যা বের করা, যাতে উস্তাদ রক্ষা পান। অবশ্য স্পষ্টতই শিক্ষকের থেকে কোনো অন্যায় সংঘটিত হলে তার সমর্থন না করা চাই।
১৬। মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র যোগাযোগ ও হাদিয়া- তোহফা দ্বারা তাঁদের মন খুশি করতে থাকা কর্তব্য। সারাজীবন এটা করতে থাকবে। ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেলেই উস্তাদের হক বন্ধ হয়ে যায় না।
১৭। নিজের দ্বারা উস্তাদের আসবাবপত্রের ক্ষতি সাধন হলে আদবের সাথে সেটা উস্তাদকে জানিয়ে দেয়া জরুরী। গোপন রেখে শিক্ষককে কষ্ট দেয়া অনুচিত।
১৮। শিক্ষক রোগাক্রান্ত হলে অথবা দুর্বল হয়ে পড়লে কিংবা অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকলে সবক পাঠ বন্ধ রাখা।
১৯। শাগরিদকে উস্তাদের খেদমতে হাজির হয়ে ইলম শিক্ষা করতে হবে। শাগরিদের নিকট পড়াবার জন্য আসার কষ্ট শিক্ষককে না দেয়াই উত্তম।
২০। উস্তাদ যা পড়াবেন পূর্বাহ্নে তা মুতালা (আগেই পড়ে আসা) করাও উস্তাদের হকের অন্তর্ভুক্ত।
২১। উস্তাদ কোনো ছাত্রের জন্য কোনো বিশেষ বিষয় বা বিশেষ বই পড়া ক্ষতিকর মনে করে নিষেষ করলে ছাত্রের পক্ষে তা থেকে বিরত থাকা উচিত।