بسم الله
الرحمن الرحيم
জবাব,
আলিমদের মাঝে মতভেদ হলে আম মানুষ কী
করবে?
আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা
এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র
তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।
১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা,
যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত,
যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস,
আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর
ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায,
জুমার নামায, যাকাত, রোযা,
হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক
ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ,
মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি,
প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ
ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল
তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ
নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও
বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের
মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!
২. অসংখ্য আমল, আহকাম ও মাসাইল এমন আছে, যেগুলোতে আলিমদের
মাঝে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোকে ইজমায়ী আহকাম বা সর্বসম্মত বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।
কিছু মানুষ এসব বিষয়েও নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করে, এরপর আলিমদের
অভিযুক্ত করে যে, তারা এখানে দ্বিমত করছেন!
৩. আল্লাহ তাআলা যাকে বিচার-বিবেচনার
সামান্য শক্তিও দিয়েছেন তিনি যদি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সত্য অন্বেষণের নিয়তে
জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি) এবং মুজমা আলাইহ (সর্বসম্মত বিষয়সমূহ) সামনে
নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বাতিলের পক্ষাবলম্বনকারীরা ‘আলিম’ (জ্ঞানী) নন; বরং হাদীসের
ভাষায় عليم اللسان اللسان ‘বাকপটু’। এই শ্রেণীর লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলে আহলে হক্ব আলিমদেরকে, যারা ‘আসসুন্নাহ’ ও‘আলজামাআ’র নীতি-আদর্শের উপর আছেন, চিনে নিতে দেরি হবে না। এরপর তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন করলে তিনি তো নিন্দিত
মতভেদ থেকে বেঁচেই গেলেন। আর বৈধ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে তিনি যদি তার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত
ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের নির্দেশনা অনুসরণ করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। ইনশাআল্লাহ আখিরাতে
তিনি দায়মুক্ত থাকবেন।
৪. কুরআন-হাদীসের বাণী ও ভাষ্য থেকে
প্রাপ্ত কিছু চিহ্ন ও আলামত আছে, যেগুলোর সাহায্যে
ঈমানদারির সাথে চিন্তা-ভাবনা করে কেউ কোনো আলিমকে নির্বাচন করতে পারেন, যার সাহচর্য তিনি গ্রহণ করবেন এবং যার সাথে দ্বীনী বিষয়ে পরামর্শ করবেন।
সময় করে আলিমদের মজলিসে যান, তাঁদের কাছে বসুন এবং লক্ষ করুন, যেসব আমল
সর্বসম্মত, যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে সুন্নত এমন বিষয়ের অনুসরণ
আর যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে নাজায়েয ও বিদআত তা বর্জনের বিষয়ে কে বেশি ইহতিমাম
করেন, কার সাহচর্যের দ্বারা আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়,
ইবাদতের আগ্রহ বাড়ে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী সম্পর্কে
অন্তরে ভয় ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং কার সঙ্গীদের অধিকাংশের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে ভালো;
কে পূর্ণ সতর্কতার সাথে গীবত থেকে বেঁচে থাকেন এবং প্রতিপক্ষের সাথেও
ভালো ব্যবহারের আদেশ দেন; কার কথা থেকে বোঝা যায় কুরআন-হাদীসের
ইলম তার বেশি, কার কথায় নূর ও নূরানিয়াত বেশি; তেমনি যে আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা কাকে সমর্থন করেন।
এ ধরনের নিদর্শনগুলোর আলোকে বিচার করার পর কেউ যদি সালাতুল হাজত পড়েন, আল্লাহর দরবারে দুআ করেন, ইসতিখারা করেন, এরপর নেক নিয়তের সাথে কোনো আলিমকে নির্বাচন করেন তাহলে ইনশাআল্লাহু তিনি দায়মুক্ত
হবেন।
তবে এক্ষেত্রেও জরুরি মনে করা যাবে না
যে, সবাইকে ঐ আলিমের কাছেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা
উচিত এবং তাঁরই কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তদ্রূপ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে ঐসব লোকদের
সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যারা অন্য আলিমের ফতোয়া
ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেন। অন্য কেউ যদি আল্লাহর রেযামন্দির জন্য চিন্তা-ভাবনা
করে অন্য কোনো আলিমকে তার দ্বীনী রাহনুমা বানান তাহলে আপনার আপত্তি না থাকা উচিত,
না তার সাথে আপনার তর্ক-বিতর্ক করা সমীচীন আর না আপনার সাথে তার।
যে আলিমদেরকে আপনি নির্বাচন করেননি তাদের
সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা কোনোটাই জায়েয নয় এবং
বিনা দলীলে তাদের কাউকে বাতিল মনে করাও বৈধ নয়। আপাতত এ কয়েকটি কথাই নিবেদন করলাম।
মুফতীর শর্তাবলি:
একজন মুফতীর মাঝে কি কি শর্তের উপস্থিতি
আবশ্যক আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যায় তার একটা পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। তাতে মুফতীর
সাতটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
১. ইসলাম। মুফতী যিনি হবেন তার জন্য
ইসলামের পবিত্র ধর্ম বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়া আবশ্যক। সুতরাং ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী কারো
ধর্মীয় অভিমত ফতোয়া বলে বিবেচিত হবে না।
২. বয়সের পরিপক্বতা। একজন মুফতীকে অবশ্যই
যথোপযুক্ত প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হতে হবে। অপ্রাপ্ত কিংবা অপরিপক্ব বয়সী কারো ফতোয়া
গৃহীত ফতোয়ার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হবে না।
৩. জ্ঞান বুদ্ধি। একজন মুফতীকে সুস্থ, স্বচ্ছ জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। সুতরাং জ্ঞানবুদ্ধিতে
অস্বচ্ছতা, অপরিপক্বতা কিংবা প্রতিবন্ধিতা আছে এমন কারো ফতোয়া
ফতোয়া হিসেবে গৃহীত হবে না।
৪. ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠতা। একজন
মুফতীকে যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। সুতরাং অন্যায়াশ্রয়ী কোনো পাপ
পঙ্কিলতায় অভ্যস্ত ব্যক্তি মুফতীর সুমহান আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না।
৫. ইজতিহাদ। ইজতিহাদ অথর্, সর্বসম্মত গৃহীত দলীল প্রমাণের আলোকে শরঈ বিধান সম্বন্ধে ধারণা
লাভ ও তা উদ্ভাবনের উদ্দেশে ফকীহের সবটুকু সাধ-সাধ্য ও শ্রম-সাধনা ব্যয় করা। একজন
মুফতীর প্রধানতম শর্ত হলো, ইজতিহাদ। ইমাম শাফী রহ. বলেন,
আল্লাহ তা‘আলার দীনের ব্যাপারে শুধু এমন ব্যক্তির জন্যই ফতোয়া প্রদান
বিধিত যিনি কুরআনের নাসেখ-মানসুখ (রহিতকারী এবং রহিত কৃত আয়াত-প্রবচন), মুহকাম- মুতাশাবিহ (দ্ব্যর্থহীন এবং দ্ব্যর্থবোধক আয়াত প্রবচন), তাওয়ীল-তানযীল (কুরআনের মূল পাঠ এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) এবং এতদোভয়ের
উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রজ্ঞাবান হবেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের নাসিখ মানসুখ সম্বন্ধে গভীর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হবেন,
কুরআন বিষয়ে যে পরিমাণ পাণ্ডিত্বের প্রয়োজন হাদীস বিষয়েও সে পরিমাণ
পাণ্ডিত্বাধিকারী হবেন, ভাষা জ্ঞান, কাব্য
জ্ঞান তথা কুরআন-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে যেসব শাস্ত্রের প্রয়োজন সে সম্পর্কে সম্যক
অবগতি লাভ করবেন, এগুলো সুবিচার বোধের আলোকে প্রয়োগ করবেন,
দেশজ সার্বিক রীতিনীতির আবর্তন-বিবর্তন সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা রাখবেন
এবং এসবের সাথে সাথে প্রখর মেধা সম্পন্ন হবেন। সুতরাং কারো মাঝে যদি এসব জ্ঞান গুণের
সমাবেশ হয় তবে কেবল তিনিই ফতোয়া ফারায়েজ সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার লালন করবেন এবং
হালাল হারাম সম্বন্ধে ফতোয়া দিতে পারবেন। আর যিনি জ্ঞান-গুণের এ উচ্চতায় পৌঁছুতে
পারবেন না তার জন্য ফতোয়া প্রদানের অধিকার অনুন্মুক্ত।- খতীবে বাগদাদী, আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ৩০৯, আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যায়
ইমাম শাফেয়ী রা. এর মুফতীর শর্তাবলি উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয়েছে, এটাই হলো, ইজতিহাদের বস্তুনিষ্ঠ অর্থ। ৩২/২৮ তবে আল্লামা
তুমুরতাশী রহ. বলেন, মুফতীর জন্য ইজতিহাদটা হলো প্রাধান্য শর্ত।
ইবনে আবিদীন রাহ. বলেন, এর অর্থ হলো মুজতাহিদের উপস্থিতিকালে
তিনিই মুফতী নিয়োগের ব্যাপারে প্রাধান্য পাবেন।- রদ্দুল মুহতার ৫/৪৯৮, ৫০৫ ইবনে দাকীকুল ঈদ রহ. হুবহু একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।- আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যা
৩২/২৮।
৬. উন্নত প্রতিভাশক্তি। এর অর্থ একজন
মুফতীকে বিপুল পরিমাণ নির্ভুলতা ও যথার্থতার প্রমাণ দিতে হবে। এবং তার মাসআলা উদ্ভাবন
শক্তি বিশুদ্ধ ও গতিময় হতে হবে। সুতরাং অনুন্নত মেধার অধিকারী এবং যাদের ত্রুটিবিচ্যুতির
পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি তাদের জন্য ফতোয়া প্রদানের অধিকার অরক্ষিত।
৭. বিচক্ষণতা ও সচেতনতা। একজন মুফতীর
মাঝে বিচক্ষণতা ও সচেতনতাবোধ থাকা আবশ্যক। ইবনে আবিদীন রহ. বলেন, মুফতীর জন্য গভীর বিচক্ষণ ও চৌকস হওয়া আবশ্যক। যাতে তারা নীতিহীন
মানুষের চক্রান্ত ও ছলচাতুরী অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। কারণ অনেক মানুষ ছলচাতুরী,
প্রবঞ্চনা ও জালিয়াতিপ্রসূত কথার মারপ্যাচে মিথ্যাকে সত্য করার ব্যাপারে
বেশ সিদ্ধহস্ত। এক্ষেত্রে মুফতী মহোদয় অসচেতন হলে বড়ো ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা
ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।- ইবনে আবিদীন, রদদুল মুহতার
৪/৩০১
প্রশ্নকারী প্রিয় দ্বীনী ভাই/বোন!
১. প্রশ্নেল্লিখিত বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে
উপরে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। সতর্কতা ইহাই যে, অধিকাংশ হক্কানী উলামায়ে কেরাম যেই কথা বলেন তা গ্রহণ করা।
২.একজন মুফতীর মাঝে অবশ্যয় উপরে উল্লেখিত
শর্তগুলি থাকা আবশ্যক। যদি কোন ব্যক্তি না জেনে কোন ইলম ছাড়ায় ফতওয়া দেয় তাহলে তার
ব্যাপারে হাদীসে কঠোর শাস্তির কথা এসেছে। বিধায় যিনি ফতওয়া দিবেন তার জন্য শতর্কতা
অবলম্বন করা যেমন জরুরী, তেমনি সাধারণ মানুষের
জন্যও উচিত যার তার কাছে ফাতওয়া জানতে না চওয়া । যেন শুনে এমন নামধারী মুফিতী যিনি
তাহকীক্ব ছাড়া ফতওয়া দেন তার থেকে ভুল ফতওয়া নিয়ে আমল করলে উভয়ে গুনাহগার হবে।