উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
শরীয়তের বিধান হলো বিবাহ পূর্ব প্রেম স্পষ্ট আকারে হারাম।
ইসলাম এর কোনোভাবেই অনুমতি দেয় না।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যার সঙ্গে বিবাহ হারাম নয় এই রকম কোনো নারীর সঙ্গে একাকী অবস্থান নিষেধ , অনুরুপ বিবাহ হারাম নয় এই রকম পুরুষের সঙ্গেও একাকি অবস্থান নিষেধ, কেননা সেখানে শয়তান তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে থাকে।’ (সহীহ মুসলিম)
,
ইসলামের মধ্যে সবচেয়ে নিবিড় বন্ধন একটাই, সেটা হলো বিয়ের বন্ধন। বিয়ের বন্ধনে প্রেম-ভালোবাসা সবই আছে। বিয়ের আগে প্রেম করাটা ইসলামে নিষিদ্ধ। এমনকি ইসলামের বিধিবিধান অনুসারে বিয়ের আগে প্রেম-ভালোবাসা হারাম। কারণ এইধরনের সম্পর্ক একজন মুসলমানের জন্য ঈমানী, চারিত্রিক, সামাজিক ইত্যাদি দিক থেকে ক্ষতিকর। আর এ সম্পর্কে কোরআন মাজীদে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে,
‘তিনি তোমাদের জন্য হালাল করে দেন পবিত্র ও উত্তম বস্তু আর হারাম করে দেন অপবিত্র ও ক্ষতিকর বস্তু।’ (সূরা: আল আরাফ, আয়াত: ১৫৭)
ইসলামে নারী ও পুরুষের পর্দা করার নির্দেশ শক্ত ও পরিষ্কার ভাষায় দেওয়া হয়েছে। যেখানে দৃষ্টি নিচু ও সংযত রাখা, কোমলভাবে কথা না বলা, লজ্জা স্থান হিফাজত করার কথা এবং পর্দা করার কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা পুরুষের পর্দা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
...قل للمؤمنين يغضوا من أبصارهم ويحفظوا فروجهم
‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জা স্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা সম্পর্কে অবগত আছেন।’ (সূরা: আন-নূর, আয়াত: ৩০)
এবং নারীদের পর্দা প্রসঙ্গে বলেছেন যে,
...وقل للمؤمنات يغضضن من ابصارهن و يحفظن فروجهن
‘ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য্যকে প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, এদের ব্যতীত যেন কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ না করে, গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্যে তারা যেন জোরে পদচারনা না করে। মুমিনগন, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা: আন নুর, আয়াত: ৩১)
.
বিবাহপূর্ব প্রেম এটি একটি সুস্পষ্ট হারাম সম্পর্ক।
যেখানে আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, প্রশান্তির চেয়ে বেশি থাকে সন্দেহ, শরীরকেন্দ্রিক ভোগবাদী চিন্তা, মানসিক উত্তেজনা আর ধীরে ধীরে আত্নিক অবক্ষয়। আমরা আমাদের চারপাশে এখন হরহামেশা এগুলোই দেখছি, এখনো দেখছি এবং ভবিষ্যতেও দেখবো। আর তাই ইসলাম দুইজন নারী পুরুষকে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে বেধে তাদের শারীরিক, আত্নিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে।
একজন স্ত্রী ও একজন স্বামী একে অপরের প্রতি শ্রদ্বাবোধ, আস্থা, বিশ্বাসে যে সম্পর্ক তৈরী করে সেখানেই রয়েছে যথার্থ প্রশান্তি।
তাছাড়া বিবাহ পূর্ব প্রেম বা ভালোবাসা হচ্ছে জিনা ব্যভিচারের প্রবেশপথ।
ব্যভিচারের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
ولا تقربوا الزني إنه كان فاحشة وساء سبيلا
‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সূরা: বনী ইসরাইল, আয়াত: ৩২)
.
তাই কাউকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যেও তার সঙ্গে বিবাহপূর্ব প্রেম নামে যে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে, তা করার কোনো অবকাশ নেই।
.
প্রশ্ন জাগতে পারে, অনেকের ক্ষেত্রে তা হয়তো শারীরিক সম্পর্কে না-ও গড়াতে পারে, সে ক্ষেত্রেও কি তা হারাম হবে? তার উত্তর খোঁজার জন্য এই হাদিসগুলোতে চোখ বুলানো যেতে পারে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীকে) দেখা, জিবের ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)। (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দুই চোখের ব্যভিচার হলো, (বেগানা নারীর দিকে) তাকানো, কানের ব্যভিচার যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের ব্যভিচার আবেগ উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের ব্যভিচার (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে) স্পর্শ করা আর পায়ের জিনা ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া এবং মনের ব্যভিচার হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। (মেশকাত, হাদিস : ৮৬)
ইসলামে জিনার নিকট যাওয়াই হারাম অর্থাৎ যেসকল জিনিস জিনার নিকটবর্তী করে দেয় তার কাছে যাওয়াই হারাম।
,
বিবাহপূর্ব প্রেম নর-নারীকে জিনার নিকটবর্তী করে দেয় আর জিনা হচ্ছে একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহ।
.
আল্লাহ তায়ালা এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘এবং যারা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে অন্য উপাস্যর ইবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতিত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।’ (সূরা: ফুরকান, আয়াত: ৬৮-৬৯)
‘নষ্ট নারীরা হচ্ছে নষ্ট পুরুষদের জন্য, নষ্ট পুরুষরা হচ্ছে নষ্ট নারীদের জন্য, (আবার) ভালো নারীরা হচ্ছে ভালো পুরুষদের জন্য, ভালো পুরুষরা হচ্ছে ভালো নারীদের জন্য, (মোনাফেক) লোকেরা (এদের সম্পর্কে) যা কিছু বলে তারা তা থেকে পাক ও পবিত্র; (আখিরাতে) এদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিজিক।’ (সূরা: আন-নূর, আয়াত: ২৬)
.....الخبيثات للخبيثين
..الطيبات للطيبين
‘ব্যাভিচারি পুরুষ কেবল ব্যাভিচারিনী নারী অথবা মুশরিক নারীকে বিয়ে করে এবং ব্যাভিচারিনীকে কেবল ব্যাভিচারি অথবা মুশরিক পুরুষ বিয়ে করে এবং এদেরকে মুমিনদের জন্য হারাম করা হয়েছে।’ (সূরা: আন-নূর, আয়াত: ৩)
.
★★শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের জন্য যদি পাক্কা ইরাদা থাকে,আর বিবাহ করতে সামাজিক, আর্থিক,পারিবারিক,সবদিক থেকে কোনো বাধা না থাকে,তাহলে এহেন পরিস্থিতিতে বিবাহের জন্য পাত্রি দেখা জায়েজ।
পাত্রি রাস্তায় বা অন্য কোনো স্থানে দেখা যাবে।
তবে সেখানে শরীয়ত বহির্ভুত কোনো কাজ করা নাজায়েজ।
সেখানে পাত্র ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ তাকে দেখতে পারবেনা।
সেখানে অবশ্যই পাত্রির সাথে কোনো রুমে বা জনমানবহীন এলাকায় একাকি হওয়া যাবেনা,এইরকম স্থান হলে সেখানে তার কোনো মাহরাম বা অন্য কোনো মহিলা থাকতে হবে।
★ যদি কেউ বিবাহ করার পাক্কা নিয়তে নিজ পাত্রীকে তার ও তার অভিভাবকের অজান্তে গোপনে থেকে লুকিয়ে দেখে, তাহলে তাও বৈধ। তবে এমন স্থান থেকে লুকিয়ে দেখা বৈধ নয়, যেখানে সে তার একান্ত গোপনীয় অঙ্গ প্রকাশ করতে পারে। অতএব স্কুলের পথে বা কোন আত্মীয়র বাড়িতে থেকেও দেখা যায়।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمْ امْرَأَةً فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَنْظُرَ إِلَيْهَا إِذَا كَانَ إِنَّمَا يَنْظُرُ إِلَيْهَا لِخِطْبَتِهِ وَإِنْ كَانَتْ لَا تَعْلَمُ.
‘‘যখন তোমাদের কেউ কোন রমণীকে বিবাহ প্রস্তাব দেয়, তখন যদি প্রস্তাবের জন্যই তাকে দেখে, তবে তা দূষণীয় নয়; যদিও ঐ রমণী তা জানতে না পারে।’’
সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমি এক তরুণীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তাকে দেখার জন্য লুকিয়ে থাকতাম। শেষ পর্যন্ত আমি তার সেই সৌন্দর্য দেখলাম যা আমাকে বিবাহ করতে উৎসাহিত করল। অতঃপর আমি তাকে বিবাহ করলাম।
,
★★★ইসলামে পাত্রি দেখা সংক্রান্ত বিস্তারিতঃ
পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্র যা দেখবে তা হল, পাত্রীর কেবল চেহারা ও কব্জি পর্যন্ত হস্তদ্বয়। অন্যান্য অঙ্গ দেখা বা দেখানো বৈধ নয়। কারণ, এমনিতে কোন গম্য নারীর প্রতি দৃক্পাত করাই অবৈধ। তাই প্রয়োজনে যা বৈধ, তা হল পাত্রীর ঐ দুই অঙ্গ।
এই দর্শনের সময় পাত্রীর সাথে যেন তার বাপ বা ভাই বা কোন মাহরাম থাকে। তাকে পাত্রের সাথে একাকিনী কোন রুমে ছেড়ে দেওয়া বৈধ নয়। যদিও বিয়ের কথা পাক্কা হয়।
★পাত্র যেন পাত্রীর প্রতি কামনজরে না দেখে।
আর দর্শনের সময় তাকে বিবাহ করার যেন পাক্কা ইরাদা থাকে।
পাত্রীকে পরিচয় জিজ্ঞাসা বৈধ। তবে লম্বা সময় ধরে বসিয়ে রাখা বৈধ নয় এবং বারবার বহুবার অথবা অনিমেষনেত্রে দীর্ঘক্ষণ তার প্রতি দৃষ্টি রাখাও অবৈধ। অনুরূপ একবার দেখার পর পুনরায় দেখা বা দেখতে চাওয়া বৈধ নয়।
পাত্রীর সাথে মুসাফাহা করা, রসালাপ ও রহস্য করাও অবৈধ। কিছুক্ষণ তাদের মাঝে হৃদয়ের আদান-প্রদান হোক, এই বলে সুযোগ দেওয়া অভিভাবকের জন্য হারাম।
এই সময় পাত্রীর মন বড় করার জন্য কিছু উপহার দেওয়া জায়েয।
অবশ্য পাত্রীর গলে নিজে হার পরানো বা হাত ধরে ঘড়ি অথবা আংটি পরানো হারাম। পরন্তু পয়গামের আংটি বলে কিছু নেই। এমন অঙ্গুরীয়কে শুভাশুভ কিছু ধারণা করা বিদআত ও শির্ক। যা পাশ্চাত্য-সভ্যতার রীতি।
এরপর পছন্দ-অপছন্দের কথা ভাবনা-চিন্তা করে পরে জানাবে।
অনুষ্ঠান করে ক্ষণেকের দেখায় পাত্রী আচমকা সুন্দরী মনে হতে পারে অথবা প্রসাধন ও সাজসজ্জায় ধোঁকাও হতে পারে।
তাই গোপনে পাত্রি দেখা জায়েজ আছে,ও সংক্রান্ত উপরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
★পাত্রী দেখার সময় কালো কলপে যুবক সেজে তাকে ধোঁকা দেওয়া হারাম। যেমন পাত্রীপক্ষের জন্য হারাম, একজনকে দেখিয়ে অপরজনের সাথে পাত্রের বিয়ে দেওয়া। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ غَشَّ.
‘‘যে (কাউকে) ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’’ (ইর ১৩১৯নং)
পক্ষান্তরে একজনের সাথে বিবাহের কথাবার্তা হয়ে বিবাহ-বন্ধনের সময় অন্যের সাথে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে দিলে সে বিবাহ শুদ্ধ নয়। এমন করলে মেয়েকে ব্যভিচার করতে দেওয়া হবে।
★পাত্রের বাড়ির যে কোন মহিলা বউ দেখতে পারে। তবে পাত্র ছাড়া কোন অন্য পুরুষ দেখতে পারে না; পাত্রের বাপ-চাচাও নয়। সুতরাং বুনাই বা বন্ধু সহ পাত্রের পাত্রী দেখা ঈর্ষাহীনতা ও দ্বীন-বিরোধিতা। পাত্রী ও পাত্রীপক্ষের উচিৎ, একমাত্র পাত্র ছাড়া অন্য কোন পুরুষকে পাত্রীর চেহারা না দেখানো। নচেৎ এতে সকলেই সমান গোনাহগার হবে।
পাত্রী দেখার আগে অথবা পরে বাড়ির লোককে দেখানোর জন্য পাত্রীর ফটো বা ছবি নেওয়া এবং পাত্রীপক্ষের তা দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষ করে বিবাহ না হলে সে ছবি রয়ে যাবে এ বেগানার কাছে। তাছাড়া ঈর্ষাহীন পুরুষ হলে সেই ছবি তার বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য পুরুষ তৃপ্তির সাথে দর্শন করবে। যাতে পাত্রী ও তার অভিভাবকের লজ্জা হওয়া উচিৎ।
অবশ্য প্রগতিশীল (দুর্গতিশীল) অভিভাবকের কাছে এসব ধর্মীয় বাণী হাস্যকর। কিন্তু আল্লাহর আযাব তার জন্য ভয়ংকর।
﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
‘‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।’’