ইসলামী দন্ডবিধির তিনটি ধারা আছে-
১. কিসাস ২. হুদুদ ৩. তাযীর
কিসাসঃ শাব্দিক অর্থ হল অনুরূপ করা বা সমান করা। শরীআতের পরিভাষায়, “হত্যা বা জখমের ক্ষেত্রে অনুরূপতা নীতিভিত্তিক ন্যায়বিচারকে কিসাস বলে”। কাজেই চোখের বদল চোখ, নাকের বদলে নাক, এবং হত্যার বদলা হত্যা এটাই হল কিসাস।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
وَ کَتَبۡنَا عَلَیۡہِمۡ فِیۡہَاۤ اَنَّ النَّفۡسَ بِالنَّفۡسِ ۙ وَ الۡعَیۡنَ بِالۡعَیۡنِ وَ الۡاَنۡفَ بِالۡاَنۡفِ وَ الۡاُذُنَ بِالۡاُذُنِ وَ السِّنَّ بِالسِّنِّ ۙ وَ الۡجُرُوۡحَ قِصَاصٌ ؕ فَمَنۡ تَصَدَّقَ بِہٖ فَہُوَ کَفَّارَۃٌ لَّہٗ ؕ وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۴۵﴾
আর আমরা তাদের উপর তাতে অত্যাবশ্যক করে দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং যখমের বদলে অনুরূপ যখম। তারপর কেউ তা ক্ষমা করলে তা তার জন্য কাফফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম।
(সুরা মায়েদা ৪৫)
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِصَاصُ فِی الۡقَتۡلٰی ؕ اَلۡحُرُّ بِالۡحُرِّ وَ الۡعَبۡدُ بِالۡعَبۡدِ وَ الۡاُنۡثٰی بِالۡاُنۡثٰی ؕ فَمَنۡ عُفِیَ لَہٗ مِنۡ اَخِیۡہِ شَیۡءٌ فَاتِّبَاعٌۢ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ اَدَآءٌ اِلَیۡہِ بِاِحۡسَانٍ ؕ ذٰلِکَ تَخۡفِیۡفٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ رَحۡمَۃٌ ؕ فَمَنِ اعۡتَدٰی بَعۡدَ ذٰلِکَ فَلَہٗ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۷۸﴾
হে ঈমানদারগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর তোমাদের উপর কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রিতদাস, নারীর বদলে নারী। তবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সাথে তার রক্ত-বিনিময় আদায় করা কর্তব্য। এটা তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে শিথিলতা ও অনুগ্রহ। সুতরাং এর পরও যে সীমালংঘন করে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(সুরা বাকারা ১৭৮)
এক্ষেত্রে ক্ষমার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে অংশের কেসাস ওয়াজিব হয়েছে সে অংশের কেসাস না নিয়ে সদকা করে দিলে আল্লাহ্ তা'আলা তার জন্য সে পরিমাণ গোনাহর কাফফারা করে দেবেন।” [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩১৬]
২. হুদুদঃ হুদুদ অর্থ নির্দষ্ট বা সীমারেখা। শরীআতে কিছু কিছু কাজের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তির উল্লেখ আছে। এগুলোকে হুদুদ বলে।
যথা-
1- অবিবাহিত ব্যভিচারীকে ১০০টি বেত্রাঘাত করা, বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম করে হত্যা করা।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَ لۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲﴾
ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী— তাদের প্ৰত্যেককে একশত বেত্ৰাঘাত করবে(১), আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে(২), যদি তোমরা আল্লাহ্ এবং আখেরাতের উপর ঈমানদার হও; আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করে।
(সুরা নুর ০২)
উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেন এবং তার প্রতি কিতাব নাযিল করেন। কিতাবে যেসব বিষয় নাযিল করা হয়, তন্মধ্যে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধানও ছিল, যা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন এবং তার পরে আমরাও করেছি। এখন আমি আশংকা করছি যে, সময়ের চাকা আবর্তিত হওয়ার পর কেউ একথা বলতে না শুরু করে যে, আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে পাই না। ফলে সে একটি দ্বীনী কর্তব্য পরিত্যাগ করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, যা আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন। মনে রেখো, প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে সত্য এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর প্রতি প্রযোজ্য- যদি ব্যভিচারের শরীয়তসম্মত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত হয় অথবা গর্ভ ও স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়৷ [বুখারীঃ ৬৮২৯, মুসলিমঃ ১৬৯১]
2- কারোও উপর ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আরোপকারীকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা।
[সূরা নূর : ৪]
3- চুরি ঠেকাতে চোরের হাত কেটে দেওয়া।
[সূরা মায়িদা : ৩৮]
4- ডাকাতি, সন্ত্রাস কিংবা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা/ বিদ্রোহ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা বা শূলে চড়ানো বা বিপরীত দিক থেকে হাত পা কেটে দেওয়া কিংবা দেশান্তরিত করা।
[সূরা মায়িদা : ৩৩]
5- মদ্যপানকারীকে ৮০ টি বেত্রাঘাত করা।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُتِيَ بِرَجُلٍ قَدْ شَرِبَ الْخَمْرَ، فَجَلَدَهُ بِجَرِيدَتَيْنِ نَحْوَ أَرْبَعِينَ»، قَالَ: وَفَعَلَهُ أَبُو بَكْرٍ، فَلَمَّا كَانَ عُمَرُ اسْتَشَارَ النَّاسَ، فَقَالَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ: أَخَفَّ الْحُدُودِ ثَمَانِينَ، «فَأَمَرَ بِهِ عُمَرُ»،
হযরত আনাস বিন মালেক রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মাদ পান করা এক ব্যক্তি আসল। তখন তাকে খেজুর গাছের দু’টি ডাল দিয়ে চল্লিশ বেত্রাঘাত করা হয়।[এক বেতে চল্লিশ হলে, দুই বেতের দ্বারা হচ্ছে আশি] একই পদ্ধতিতে আবু বকর রাঃ ও এ অপরাধের শাস্তি দিতেন। তারপর যখন হযরত উমর রাঃ এর সময় আসল। তিনি লোকদের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন। তখন আব্দুর রহমান পরামর্শ দিলেন যে, কমপক্ষে আশি বেত্রাঘাত। [দুই ডাল একসাথে নয়, বরং আলাদা করে আশিটি] তখন হযরত উমর রাঃ আশিটি বেত্রাঘাতের হুকুম দিলেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৭০৬]
6- মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম পরিত্যাগকারী ব্যক্তিকে ক্বতল করা।
عن عكرمة قال : أتي علي رضي الله عنه بزنادقة فأحرقهم. فبلغ ذلك ابن عباس فقال : لو كنت أنا لم أحرقهم، لنهي رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا تعذبوا بعذاب الله، ولقتلتهم لقول رسول الله صلى الله عليه وسلم : من بدل دينه فاقتلوه.
ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না।’ আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)
৩. তাযীরঃ কিসাস ও হুদুদ ব্যতিত বাকী সব অপরাধই তাযীরের মধ্যে পড়বে। রাষ্ট্রের অভিজ্ঞ আলিম ফকীহরা বসে বিভিন্ন অপরাধের সংজ্ঞা এবং শাস্তি নির্ধারণ করবেন এবং এটা পরিবর্তনযোগ্য।
নারীদের যেহেতু জ্ঞ্যানের কমতির বিষয়টি হাদীস শরীফে এসেছে,তাই দন্ডবিধির ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হলে বিচার কাজে সন্দেহ আসতে পারে।