তালাক সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতিতে দেওয়ার বিধিবিধান আমি জানি। আমি এখানে শুধু কিছু একাডেমিক আলোচনা করতে চাই। চার মাযহাব মতে, এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। অধিকাংশ সাহাবিরও একই মত। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো বিপরীত মতও তো আছে। অর্থাৎ যদি ধরে নিই ৯০%ই 'এক বৈঠকে তিন তালাকে তিন তালাক' এর পক্ষে, তাহলেও যে ১০% 'তিন তালাকে এক তালাক হয়' এই নীতিতে বিশ্বাস করে তাদের দলীলও তো কম শক্তিশালী নয়। এমন তো নয় যে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কায়্যিম (রহঃ) দলীল ছাড়াই ২য় মতটি গ্রহণ করেছেন। আমি আবু দাউদ শরিফের একটি হাসান হাদিস এর লিংক দিচ্ছি :
https://sunnah.com/abudawud:2196
আবার মুফতি জুনায়েদ হাসান সাবেরি (ইনি এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হয় এই মতের পক্ষের) বলেছেন ঃ ওমর (রাঃ) বলেছেন, তার খেলাফতের যামানায় এক বৈঠকে তিন তালাক দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছিল দেখে তিনি তিন তালাককে তিন তালাকই গন্য করা শুরু করেন। তার আগ পর্যন্ত এক বৈঠকে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হত। সাবেরি হুজুরের মত হলো, সাহাবিদের ইজমাও তো আমাদের মানতে হবে।( লিংক ঃ
https://www.youtube.com/watch?v=1LOsLNiaZ64)
আমার প্রশ্ন হলো, আমি যদি ধরে নিই যে নবিজীর যামানায় যেহেতু এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে কখনো তিনি তিন তালাক ধরেছেন, কখনো এক তালাক ধরেছেন (কারণ দুই মতের পক্ষেই হাদিস আছে), এমনকি ওমর (রাঃ) এর খিলাফতকালের একটা সময় পর্যন্ত এই মাসলার উপর আমল হয়েছে সেহেতু এই মতটিকে একেবারে ফেলে দেওয়ার সুযোগ আছে কি? প্রশ্ন হতে পারে, আপনি কি ইজমাকে শরিয়তের দলিল মনে করেন না? আমি বলব, অবশ্যই করি, কিন্তু যেহেতু দুই ধরণের হাদিসই আছে, এবং দুটির কোনোটিই মানসুখ হয়নি (হলে আবু বকর রাঃ এর যামানায় তা থাকত না) সেক্ষেত্রে কেউ যদি এক সুন্নাত অনুসারে তার বিচারকাজ চালান তাহলে সেটাকে কি 'ইজমা' বলার সুযোগ আছে? নাকি ধরে নেওয়া উচিত যে এটা তার সাময়িক সময়ের জন্য নিজের বিচারকার্য চালানোর জন্য গৃহীত পদ্ধতি, ভিন্ন কোনো শাসক এসে বিপরীত সুন্নাতটিও বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পাবে? অর্থাৎ, কোনো খলিফার জন্য দুই সুন্নাতের মধ্য থেকে একটাকে চূড়ান্ত ঘোষণা করে অপরটাকে কেয়ামত পর্যন্ত বাতিল করার সুযোগ আছে কি? এটাকে কি ইজমা বলা যায়? আমার জানামতে, ইজমা হয় সে বিষয়ে যেটি কুরআন-হাদিসে স্পষ্টভাবে নেই, কিন্তু যেটির বাপারে হাদিস থেকে একাধিক পন্থা আছে তার একটিকে চূড়ান্ত করে দিয়ে অপরটিকে চিরতরে বাতিল করা যায় না। অর্থাৎ, উমর (রাঃ) তার সময়ে তার সুবিধাজনক পথটি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু বিপরীত মতটিকে একেবারে হারাম ঘোষণা করেননি, পরবর্তীতে উম্মত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন হাদিসের উপর আমল করলেও তাকে হারাম বলা যাবে না।। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির (রহঃ)কেও দেখলাম, তিনি তিন তালাকে তিন তালাক হওয়ার বিধানের পক্ষে হলেও বিপরীত মতটি স্বীকার করে নিয়েছেন (
https://www.youtube.com/watch?v=UIHn8jLAtjk)।
আমি একটি কথা ভাবছি, দয়া করে জানাবেন আমার ভাবনাটি সঠিক কিনা। নবিজী (দঃ)কে আমরা তালাকের ক্ষেত্রে দুই রকম আমল করতেই দেখতে পাই কেন? আমার ধারণা, এক বৈঠকে কেউ যদি তিন তালাক দেয় তাহলে সেটা তিন তালাক হবে নাকি এক তালাক হবে তা নির্ভর করছে তালাকদাতার নিয়তের উপর। যে তার স্ত্রীকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করতেই তালাক দিয়েছে সে একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হবে (যেমনঃ এক সাহাবি তার স্ত্রীকে জেনা কর‍তে দেখে দিয়েছিলেন)। অর্থাৎ, তিনি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে আমি আর এর সাথে ঘর করবই না, তাহলে এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হবে (যদিও কাজটা হারাম হবে)। কিন্তু যদি কেউ মুখ ফস্কে তিন তালাক দিয়ে ফেলে পরে মন চায় ঘর করতে, অথবা ঠান্ডা মাথাতেই এক বৈঠকে তিন তালাক দিয়ে ফেলে, কিন্তু পরে মন চায়, বা কাজির হুকুম হয় তার জন্য এক তালাক হিসেবে গ্রহণ করারও সুযোগ আছে (কিন্তু একাধিক বৈঠকে তিন তালাক দিলে আর সেই সুযোগ নেই)। যদি আমরা ব্যাপারটাকে এভাবে নিই তাহলে উভয় প্রকারের হাদিসের মধ্যেই সমন্বয় সাধন হয় এবং বহু সংসার হিলা বিয়ের হাত থেকে বেঁচে যায়।
আমার প্রশ্ন হলো আমার এই ধারণা কি ভুল? যদি ভুল হয় তাহলে কি বলতে চাচ্ছেন এক বৈঠকে তিন তালাক দিলে এক তালাক হবে এই ফতোয়া একদম পরিত্যাক্ত? যদি পরিত্যাক্ত বা পরিত্যাজ্য হয় তাহলে রুকানা (রাঃ) এর ওই হাদিসটি (উপরে আমি যেটার লিংক দিয়েছি, আবু দাউদ শরিফের হাসান হাদিস) এর কী ব্যাখ্যা? আর ওমর (রাঃ) এর আগ পর্যন্ত যে উক্ত হাদিসের নীতিটির উপর আমল হয়েছে তারই বা কী ব্যাখ্যা তা দয়া করে জানাবেন? সাথে এও জানাবেন, "এক বৈঠকে তিন তালাকে এক তালাক" পক্ষের আলেমরা কেন তাহলে এই নীতির উপর এলেন? তাদের বোঝার ভুলটা কোথায় হলো?
দয়া করে দলিলভিত্তিক, সুচিন্তিত ও প্রাসঙ্গিকভাবে জবাব দেবেন।