ওয়া আলাইকুমুস-সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
জবাবঃ-
সিরাত বিশ্বকোষ – একাদশ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) এ মুজিযা এবং কারামত এবং ইস্তিদরাজ সম্পর্কে বলা হয় যে,
মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে পার্থক্য
মুজিযা নিয়ে আলোচনা পূর্বেই হয়ে গেছে। এখন কারামাত বলতে কি বুঝায় এবং মুজিযা ও কারামাতের পার্থক্য তুলে ধরা হবে।
كرامة (কারামাত) শব্দটি كرم ধাতুমূল থেকে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ – উদার, দয়ালু, সম্মানিত হওয়া। আল্লাহ পাকের অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্যে “কারীম” একটি গুণবাচক নাম। আল-কুরআনে এটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ পাক সেখানে আল-কারীম (الكريم) অর্থাৎ উদার বা দয়ালু নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। তবে কারামাত বলতে যা বুঝায়, আল-কুরআনে উল্লিখিত আল-কারীম শব্দ তা বুঝায় না।
কারামাত (كرامة) শব্দটির বহুবচন কারামাত (كرامات)। ধর্মীয় পরিভাষায় এর অর্থ – আল্লাহ’র দেওয়া দান, যা সম্পূর্ণ মুক্ত, অবারিত অনুগ্রহ (ইহসান বা ইনআম)। তবে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহপূর্বক তার প্রিয়জনদেরকে অলৌকিক ঘটনা সম্পাদন করার যোগ্যতা প্রদান করে থাকেন। আর তারাও আল্লাহ পাকের অনুকম্পাসিক্ত হয়ে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করেন। এটিই কারামাত নামে অভিহিত। এ সমস্ত ঘটনা সাধারণত বস্তুজগতে সংঘটিত বিস্ময়কর ঘটনার সমন্বয়ে ঘটিত নতুবা ভবিষ্যতের কোন পূর্ব সংকেতস্বরূপ অথবা আধ্যাত্মিক বিষয়ের কোন ব্যাখ্যাস্বরূপ। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)
মুজিযা ও কারামাতের সংজ্ঞা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, মুজিযা ও কারামাতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তবে আউলিয়ায়ে কিরামগণের দ্বারা কারামাত প্রকাশ পাওয়া আদৌ সঠিক কিনা, সে ব্যাপারে আলিমগণ মতভেদ করেছেন।
মুতাযিলি মতবাদঃ অধিকাংশ মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। তাদের প্রসিদ্ধ যুক্তি, যা আল-কুরআনের সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্যকার জারুল্লাহ যামাখশারী কর্তৃক ৭২ : ২৬-২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন –
“তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তার অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না; – তার মনোনীত রাসুল ব্যতীত, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ রাসুলের অগ্রে ও পশ্চাতে প্রহরী নিয়োজিত করেন।” (সূরাহ আল-জিন্ন, ৭২ : ২৬-২৭)
আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে যামাখশারী বুঝাতে চান যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত নবীগণের মিশনের সত্যতা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বিভিন্ন রকমের অলৌকিক ব্যাপার প্রকাশ করেন, কিন্তু অন্য সকল অতি-প্রাকৃত ঘটনা তিনি সৃষ্টির অগোচরে সম্পন্ন করেন। আল জুব্বাঈ বলেন, ওয়ালীগণ যদি এই ক্ষমতার অধিকারী হোন তাহলে কিভাবে তাদেরকে নবীগণ থেকে পৃথক করা যাবে ?
এভাবে মুতাযিলি সম্প্রদায় কারামাতের যথার্থতা অস্বীকারের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।
দার্শনিকগণের অভিমতঃ দার্শনিক ইবনে সীনার দৃষ্টান্ত থেকে কারামাতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার সৃষ্টিতত্ত্ব “অপরিহার্য ও আত্মসচেতন ইচ্ছাসম্পন্ন” উদ্ভবের অস্তিত্বমূলক অদৃষ্টবাদের মধ্যে মুজিযাত ও কারামাতকে তিনি স্থান দিয়েছেন। নবীগণ তাদের মানবীয় প্রকৃতির পরিপূর্ণতা ও বাহ্যিক বস্তুনিচয়ের উপর প্রকৃতিগত আত্মিক প্রভাবেই মুজিযা দ্বারা তাদের আগমনকে সুনিশ্চিত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, ইবন রুশদ তার “তাহাফুতুত তাহাফুত” গ্রন্থে (সম্পা. Bouyes, 515) একটি পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। তা হলো, যার মধ্যে গুনগত পার্থক্য নিহিত শুধু সেগুলোই অলৌকিক ঘটনা। কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব। তার রিসালা ফি আকসামিল উলুম গ্রন্থে (তিসউর রাসাইলের অন্তর্ভুক্ত, কায়রো সংস্করণ, ১৩২৬/১৯০৪) ইবনে সিনা বলেন, কারামাত প্রকৃতিগতভাবে মুজিযার সমার্থক। তার ইশারাত গ্রন্থে (সম্পা. Foger Leiden, ১৮২০ খৃ.) তিনি এ কথা সমর্থন করেন যে, আধ্যাত্মিক গভীরতার কল্যাণে যার আত্মা জাগতিক বস্তুর উপর প্রভাবশীল এবং যিনি এই প্রভাব কল্যাণকর ও নীতিসিদ্ধ পন্থায় ব্যবহার করেন, যদি তিনি নবী হোন তাহলে আল্লাহ’র দান হিসেবে তিনি তা লাভ করেন, সেটিই মুজিযা। আর যদি তিনি ওলী হোন, তাহলে তিনি কারামাতের সৌভাগ্য অর্জন করেন। নবীগণ নবুওয়াতপ্রাপ্ত হোন আল্লাহ’র প্রতি তাদের প্রকৃতিগত সহজাত প্রবৃত্তি, প্রজ্ঞার ত্রিবিধ পরিপূর্ণতা, চিন্তাশক্তি ও কঠোর সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে, যদিও সেই সাধনা বা মুজিযা নিন্ম মানের হয়। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ৭ম খ.)
আশআরী সম্প্রদায়ের জবাবঃ ধারণা করা হয়, কিছু সংখ্যক আশআরী, যেমন – আল ইসফারাইনী, আল হালিমী প্রমুখ কারামাত প্রসঙ্গে মুতাযিলি সম্প্রদায়ের জোরালো মতামত বা বিচার-বিবেচনাকে সমর্থন করে। তবে আশআরী সম্প্রদায়ের সাধারণ মতবাদের যথার্থতা নিন্মে বর্ণিত যুক্তির ভিত্তিতে স্বীকৃত –
(ক) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাব্যতাঃ কোন নবীর নৈতিক পরিপূর্ণতার নিদর্শন কোন অলৌকিক ঘটনা বা মুজিযা অহেতুক না, বরং তা আল্লাহ পাকের সদিচ্ছা বা কার্যকর ইচ্ছা। তিনি তার সেই ইচ্ছাকে একজন নবীর মাধ্যমে সম্পাদন করে থাকেন। সেই অলৌকিক কাজটি সম্পাদিত হয় কোন ঘোষণা বা চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায়। সুতরাং আল্লাহ পাকের পক্ষে কোন বিজ্ঞপ্তি বা চ্যালেঞ্জ ছাড়াই কোন সাধকের মাধ্যমে অতি প্রাকৃত কোন ঘটনা ঘটানো বৈধ বা জায়েজ।
(খ) আল-কুরআনের সমর্থনঃ এমন কতগুলো ঘটনার অস্তিত্ব দিবালোকের মতো দেদীপ্যমান ও যথার্থ বলে প্রমাণিত, কুরআন মাজিদে যা উল্লেখ হয়েছে, যার ধারকগণ কোন নবুওয়াতের দাবীদার ছিলেন না, যেমন –
“….. যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতো, তখনই তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেতো; সে বলতো, এসব তুমি কোথায় পেলে ? সে বলতো, তা আল্লাহ’র কাছ থেকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।” (সূরাহ আলি ইমরান, ৩ : ৩৭)
সন্দেহাতীতরূপে ঘটনাটি ছিল বিস্ময়কর, অলৌকিক। ঈসা আলাইহিস সালামের মা মারিয়াম নিজে কোন নবী ছিলেন না, নবুওয়াতের দাবীদারও ছিলেন না, অথচ তার কাছে পাওয়া যেতো অসম মৌসুমে মৌসুমী ফল। আরো উল্লেখ হয়েছে –
“তুমি কি মনে করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ?” (সূরাহ আল-কাহফ, ১৮ : ৯)
যারা একটি পার্বত্য গুহাতে একাধারে তিনশত বছর ঘুমন্ত ছিলেন, তারা নবী-রাসুল নন, অথচ এ সকল ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘটনা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে অলৌকিক নিদর্শন। আরো উল্লেখ পাওয়া যায় –
“কিতাবের জ্ঞান যার ছিলো, সে বললো, আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা আপনাকে এনে দিবো; সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত অবস্থায় দেখলেন তখন বললেন, এটি আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ ….” (সূরাহ আন-নামল, ২৭ : ৪০)
ঘটনাটি ঘটেছিলো সুলায়মান আলাইহিস সালামের আদেশে হয় একজন জিন্ন বা কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির মাধ্যমে (নোটঃ তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই ব্যক্তির মানুষ হওয়ার পক্ষেই মত দেখা যায়, বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের তাফসীরে), যারা কোন নবী ছিলেন না যিনি চোখের পলকে রানী বিলকিসের বিরাট সিংহাসন এনেছিলেন অনেক দূর থেকে।
সুতরাং কারামাত সম্ভব, তাবে তাকে মুজিযার সাথে সংযুক্ত করা কোনক্রমেই সঙ্গত হবে না। আল্লাহ মুজিযা প্রকাশ করেন নবীগণের মিশনের প্রমাণস্বরূপ, আর কারামাতকে প্রকাশ করেন ওলীগণকে সম্মানিত ও তাদের ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া সংরক্ষণ মানসে। মুজিযাত সকল মানুসের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ, তবে কারামাত গোপন করাই বিধেয়। সর্বদা দুটোর মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পার্থক্য বজায় রাখা কর্তব্য। জেনে রাখতে হবে, যাবতীয় ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা এটা থেকে ভিন্নতর। উল্লেখ্য যে, আশআরী মতবাদ আরো বিধৃত হয়েছে – ইবন খালদুন, মুকাদ্দিমা, অনু ৬খ. ; DE Slane, ১খ. , ৪৩খ. ; অনু. Rosenthal, ১খ. , ৯১খ. গ্রন্থসমূহে।
(গ) সূফী মনস্তত্ত্ব কর্তৃক স্বীকৃতঃ ওলীগণের কারামাত সূফী দার্শনিকগণ কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। সুন্নী সূফী বিদ্যায় পারদর্শীগণ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সাধারণভাবে আশআরী মতবাদের খুবই নিকটবর্তী। এই মতবাদে কারামাত ও মুজিযার পার্থক্যের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোন ওলী-দরবেশ বিস্ময়কর কার্যাবলী সম্পাদন করলে তিনি সে কারণে নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন না। তিনি তদানীন্তন রাসুল কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় আইনের অনুশাসন মানতে বাধ্য থাকেন।
কারামাত কখনো মুজিযার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না, বরং মুজিযার পৃষ্ঠপোষকতা করে। মনে রাখতে হবে যে, ওলীগণের কারামাত সেই নবীর মুজিযার প্রমাণ, যে নবীর তিনি উম্মত। সে কারণে মুজিযা নবীর সত্যতার প্রতীক। আমরা দেখতে পাই, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে অবিশ্বাসীরা যখন মক্কাতে শূলীতে দেয়, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক দূরে মদিনার মসজিদে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র উপর জুলুম-অত্যাচারের করুণ অবস্থা। সহচরবৃন্দকে তা সবিস্তারে অবহিত করেন। অপরদিকে আল্লাহ পাক খুবাইবের অন্তরায় দূরীভূত করেন। তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দর্শন লাভ করেন, তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাম পেশ করেন, তিনিও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালামের জবাব দেন, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু সালামের জবাব শুনতে পান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য দুয়া করেন। মক্কা-মদিনার মধ্যে দূরত্ব ছিল বিস্তর। তবুও তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ, সালাম আদান-প্রদান সুনিশ্চিতরূপে অস্বাভাবিক ব্যাপার। এটি খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু’র জন্য ছিল কারামাত আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল মুজিযা। (দাতা গনজে বখশ, কাশফুল মাহজুব)