ওয়া আলাইকুমুস-সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
জবাবঃ-
আলহামদুলিল্লাহ!
(ক) হ্যা, সতর্কবার্তা দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
(খ) সূরা আহজাবের আয়াত ৩৭ কেনো নাযিল হয়েছিল?
وَ اِذۡ تَقُوۡلُ لِلَّذِیۡۤ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِ وَ اَنۡعَمۡتَ عَلَیۡهِ اَمۡسِكۡ عَلَیۡكَ زَوۡجَكَ وَ اتَّقِ اللّٰهَ وَ تُخۡفِیۡ فِیۡ نَفۡسِكَ مَا اللّٰهُ مُبۡدِیۡهِ وَ تَخۡشَی النَّاسَ ۚ وَ اللّٰهُ اَحَقُّ اَنۡ تَخۡشٰهُ ؕ فَلَمَّا قَضٰی زَیۡدٌ مِّنۡهَا وَطَرًا زَوَّجۡنٰكَهَا لِكَیۡ لَا یَكُوۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ حَرَجٌ فِیۡۤ اَزۡوَاجِ اَدۡعِیَآئِهِمۡ اِذَا قَضَوۡا مِنۡهُنَّ وَطَرًا ؕ وَ كَانَ اَمۡرُ اللّٰهِ مَفۡعُوۡلًا ﴿۳۷﴾
এবং (হে রাসূল!) স্মরণ কর, যার প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন এবং তুমিও অনুগ্রহ করেছিলে, ৩৩ তাকে যখন তুমি বলছিলে, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিজ বিবাহে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। ৩৪ তুমি নিজ অন্তরে এমন কথা গোপন করছিলে, আল্লাহ যা প্রকাশ করে দেওয়ার ছিলেন। ৩৫ তুমি মানুষকে ভয় করছিলে অথচ আল্লাহই এ বিষয়ের বেশি হকদার যে, তুমি তাকে ভয় করবে। অতঃপর যায়দ যখন নিজ স্ত্রীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটাল তখন আমি তার সাথে তোমার বিবাহ সম্পন্ন করলাম, যাতে মুসলিমদের পক্ষে তাদের পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীগণকে বিবাহ করাতে কোন সমস্যা না থাকে, যখন তারা তাদের সাথে সম্পর্ক শেষ করে ফেলবে। আর আল্লাহর আদেশ তো কার্যকর হওয়ারই ছিল।(অর্থ:মুফতী তাকী উসমানী) (সূরা আহযাব-৩৭)
তাফসীর (মুফতী তাকী উসমানী)
এর দ্বারা হযরত যায়দ ইবনে হারেছা (রাযি.)কে বোঝানো হয়েছে। তার প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ তো ছিল এই যে, তিনি তাকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে পৌঁছে দেন ও ইসলাম গ্রহণ করার তাওফীক দান করেন। তিনি ছিলেন সেই চার সাহাবীর একজন, যারা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা এই যে, তিনি আট বছর বয়সে নিজ মায়ের সাথে নানাবাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে কায়ন গোত্রের লোক হামলা চালিয়ে তাকে গোলাম বানিয়ে ফেলে এবং উকাজের মেলায় হযরত হাকীম ইবনে হিযাম (রাযি.)-এর কাছে বিক্রি করে ফেলে। তিনি তার এ শিশু গোলামটিকে নিজ ফুফু হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাযি.)কে দিয়ে দেন। অতঃপর যখন হযরত খাদীজা (রাযি.)-এর সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ হয়, তখন হযরত খাদীজা (রাযি.) তাকে তাঁর খেদমতে পেশ করেন। হযরত যায়দ (রাযি.)-এর বয়স তখন পনের বছর। এর কিছুকাল পর তার পিতা ও চাচা জানতে পারে যে, তাদের সন্তান মক্কা মুকাররমায় আছে। তারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে আসল এবং আরজ করল আপনি যে কোনও বিনিময় চান আমরা দিতে রাজি আছি, তবু আমাদের সন্তানকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন। তিনি বললেন, আপনাদের ছেলে যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, তবে কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই তাকে আপনাদের হাতে ছেড়ে দেব। কিন্তু সে যদি যেতে সম্মত না হয়, তবে আমি তাকে যেতে বাধ্য করতে পারব না। একথা শুনে তারা অত্যন্ত খুশী হল। তারপর হযরত যায়দ (রাযি.)কে ডাকা হল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এখতিয়ার দিলেন যে, তিনি চাইলে নিজ পিতা ও চাচার সঙ্গে যেতে পারেন এবং চাইলে থেকেও যেতে পারেন, কিন্তু হযরত যায়দ (রাযি.) এই বিস্ময়কর উত্তর দিলেন যে, আমি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। একথা শুনে তার পিতা ও চাচা হতবিহ্বল হয়ে গেল। কী বলে তাদের ছেলে! স্বাধীনতার চেয়ে দাসত্বকেই সে বেশি পছন্দ করছে? নিজ পিতা ও চাচার উপর এক অনাত্মীয় ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে? কিন্তু হযরত যায়দ (রাযি.) তার কথায় অনড়। তিনি বললেন, আমি আমার এ প্রভুর আচার-ব্যবহার দেখেছি। আমি তার যে ব্যবহার পেয়েছি তারপর দুনিয়ার কোনও ব্যক্তিকেই আমি তার উপর প্রাধান্য দিতে পারব না। প্রকাশ থাকে যে, এটা সেই সময়ের ঘটনা, যখনও পর্যন্ত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেননি। শেষ পর্যন্ত তার পিতা ও চাচা তাকে ছাড়াই ফিরে গেল, তবে আশ্বস্ত হয়ে গেল যে, তাদের ছেলে এখানে ভালো থাকবে। অনন্তর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আজাদ করে দিলেন এবং পবিত্র কাবার কাছে গিয়ে কুরাইশের লোকজনের সামনে ঘোষণা করে দিলেন ‘আজ থেকে সে আমার পুত্র! আমি তাকে দত্তক গ্রহণ করলাম। এরই ভিত্তিতে লোকে তাকে যায়দ ইবনে মুহাম্মাদ ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র’ বলে ডাকত।
হযরত যয়নব (রাযি.)-এর সাথে হযরত যায়দ (রাযি.)-এর বিবাহ হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু স্ত্রীর সম্পর্কে হযরত যায়দ (রাযি.)-এর সব সময়ই অভিযোগ ছিল যে, তার অন্তর থেকে জাত্যাভিমান সম্পূর্ণ লোপ পায়নি এবং খুব সম্ভব সে কারণেই তার পক্ষ থেকে হযরত যায়দ (রাযি.)-এর প্রতি মাঝে-মধ্যে রূঢ় আচরণ হয়ে যেত। হযরত যায়দ (রাযি.)-এর এ অভিযোগ ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল এবং এক সময় তিনি তাকে তালাক দেওয়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পরামর্শও চাইলেন। তিনি তাকে স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে নিষেধ করলেন এবং তাকে নিজের কাছে রাখার জন্য উপদেশ দিলেন। বললেন, আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর। কেননা তালাক জিনিসটি আল্লাহ তাআলার পছন্দ নয়। স্ত্রীর যেসব হক তোমার উপর রয়েছে তা আদায় করতে থাক।
হযরত যায়দ (রাযি.) তালাক সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়ার আগেই আল্লাহ তাআলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহী মারফত জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যায়দ কোনও না কোনও দিন যয়নবকে তালাক দেবেই এবং তারপর আল্লাহ তাআলার ইচ্ছানুসারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে যাবে, যাতে পোষ্যপুত্রের বিবাহকে দূষণীয় মনে করার যে কুসংস্কার আরবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে চিরতরে তার মূলোৎপাটন হয়ে যায়। বস্তুত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য এটা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কেননা একে তো হযরত যায়দ (রাযি.)-এর সঙ্গে হযরত যয়নব (রাযি.)-এর বিবাহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পীড়াপীড়িতেই সম্পন্ন হয়েছিল। দ্বিতীয়ত তালাকের পর তিনি স্বয়ং তাকে বিবাহ করলে বিরুদ্ধবাদীদের এই অপপ্রচার করার সুযোগ হয়ে যাবে যে, দেখণ্ডদেখ এ নবী তার পোষ্যপুত্রের বউকে বিবাহ করে ফেলেছে! এ কারণেই হযরত যায়দ (রাযি.) যখন তালাকের ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন, তখন তিনি হয়ত চিন্তা করেছিলেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ আসলে তা তো শিরোধার্য করতেই হবে, কিন্তু এখনও যেহেতু চূড়ান্ত কোন নির্দেশ আসেনি, তাই এখন যায়দকে এমন পরামর্শই দেওয়া চাই, যেমনটা স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের ক্ষেত্রে সাধারণত দেওয়া হয়ে থাকে, যেমন বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব মিলেমিশে থাক, তালাক দিতে যেও না, আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর এবং একে অন্যের হক আদায় কর। সুতরাং তিনি এ রকমই পরামর্শ দিলেন। তিনি একথা প্রকাশ করলেন না যে, আল্লাহ তাআলার ফায়সালা হল হযরত যায়দ (রাযি.) একদিন না একদিন তার স্ত্রীকে তালাক দেবেই এবং তারপর যয়নব (রাযি.) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহাধীনে চলে আসবে। এ বিষয়টাকেই আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ‘তুমি নিজ অন্তরে এমন কথা গোপন করছিলে, আল্লাহ যা প্রকাশ করে দেওয়ার ছিলেন’। সহীহ রেওয়ায়াতসমূহের আলোকে এ হাদীসের সঠিক তাফসীর এটাই। ইসলামের শত্রুরা ভিত্তিহীন কিছু বর্ণনাকে অবলম্বন করে আয়াতের যে ব্যাখ্যা করেছে তা সম্পূর্ণ গলত। এ প্রসঙ্গে সেসব রেওয়ায়েত নিশ্চিতভাবেই অযৌক্তিক এবং তা আদৌ ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়।