সহীহ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘ইহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা’নত, কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। (সহীহ বুখারী ১/১৮৬)
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিজের ব্যাপারেই বলেন, আমার কবরকে তোমরা উৎসবের স্থান বানিও না। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৭৯)
কবর সংক্রান্ত যে সব বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন (যথা যিয়ারত, সালাম ও দুআ) সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো কিছু করা বৈধ নয়। কবরকে সিজদা করা, চুমু খাওয়া, তাতে বাতি জ্বালানো-এগুলো বড় গুনাহ ও শিরকী কাজ। এ বিষয়ে শরীয়তের অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস বরাতসহ পেশ করা হল।
,
সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী কতক উম্মত নিজ নবী ও বুযুর্গদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি। (সহীহ মুসলিম ১/২০১)
অন্য এক হাদীসে কবরের উপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (সুনানে তিরমিযী ১/৭৩)
আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.কে এই ফরমান দিয়ে পাঠালেন যে, কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমান করে দিবে এবং কোনো মূর্তি দেখলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে। (জামে তিরমিযী ১/২০৩)
ফিকহে ইসলামীর প্রসিদ্ধ কিতাব তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ পৃ. ৩৪১ বলা হয়েছে, কবর মুছবে না, কবরে চুমু দিবে না এবং কবরকে স্পর্শ করবে না। কেননা, এটা নাসারাদের রীতি। (সামনে এ সংক্রান্ত আরো বরাত উল্লেখ করা হয়েছে।)
উল্লেখ্য কবরে চুমু খাওয়া, সিজদা করা, তাওয়াফ করা, কবরের উপর ইমারত বানানো, গিলাফ চড়ানো, মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো ইত্যাদি একদিকে যেমন শরীয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ, অপরদিকে তা কবরবাসী ওলীদের প্রতি চরম অবিচার। কেননা, তাঁরা পুরো জীবন শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন অথচ মৃত্যুর পর তাদরে প্রতি ভক্তি নিবেদনের নামে ওই সব কাজ-ই করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সাহাবা, তাবেয়ীন এবং ওলি-বুযুর্গদের পথ-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের ঈমান-আমল ঠিক করা, তাওহীদ ও সুন্নাহ্কে আঁকড়ে ধরা এবং শিরক-বিদআত ও সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই তাদেরকে প্রকৃত সম্মান করা যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।
কবর যিয়ারতের মাসনূন তরীকা
কবর যিয়ারতের সুন্নত তরীকা হচ্ছে কবরের কাছে গিয়ে সালাম দিবে।
এরপর কবরকে পিছনে রেখে কিবলামুখী হয়ে দাড়িয়ে নিজের জন্য এবং কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দুআ করবে। এছাড়া কুরআন মজীদ থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করে কবরবাসীর জন্য ইসালে ছওয়াব করা যেতে পারে।
(সহীহ মুসলিম ১/৩১৩; শরহু মুসলিম নববী ৭/৪৩; হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/১৬৯; শরহুস সুদূর পৃ. ৩১১; রদ্দুল মুহতার ২/২৪২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৫০; আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৫-১৯৬; ইলাউস সুনান ৮/৩৩০-৩৪৩
জাহেলী যুগের কবর পূজা সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে উম্মতকে কবরের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর যখন ঐ সময়ের রসম-রেওয়াজ ভালোভাবে দূর হল তখন তিনি কবর-যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে বলেছেন-
كنت نهيتكم عن زيارة القبور، فزوروها، فإنها تزهد في الدنيا وتذكر الآخرة.
আমি তোমাদের কবর-যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। (এখন ঐ নিষেধ মানসূখ করা হচ্ছে) এখন তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার। কারণ তা দুনিয়ার মোহ দূর করে এবং আখিরাতকে মনে করিয়ে দেয়। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৫৭১; মিশকাত পৃ. ১৫৪
শুধু নিজ শহরের কবরস্থানে যাওয়া যাবে, নাকি অন্যান্য শহরেও নেককার অলী-বুযুর্গের কবর যিয়ারতে যাওয়ার অনুমতি আছে? কিছু মনীষীর সিদ্ধান্ত, কেউ যদি অন্য কোনো শহরে গিয়ে থাকে, তাহলে ওখানের কবরও যিয়ারত করতে পারে। কিন্তু শুধু কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়া সহীহ না।
তবে ইমাম গাযালী রাহ.সহ আরো অনেক মনীষীর মতে এরও অনুমতি আছে। আর এটাই সহীহ। তবে এই শর্তে যে, ওখানে গিয়ে শরীয়ত পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত হবে না।
ফাতাওয়ায়ে শামী খ. ২ পৃ. ২৪২, নতুন মুদ্রণ, মিশর।
,
কবর-যিয়ারতের পদ্ধতি
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতের এই তরীকা বলেছেন যে, কেউ যখন কবরস্থানে যায়, তো কবরবাসীদের যেন এ বলে সালাম দেয়-
السلام عليكم دار قوم مؤمنين، أنتم لنا فرط ونحن لكم تبع، وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، نسأل الله لنا ولكم العافية.
অর্থ : হে মুমিনদের বসতি! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা আমাদের পূর্বসূরী আর আমরা তোমাদের উত্তরসূরী। আর ইনশাআল্লাহ আমরা তোমাদের সাথে যুক্ত হব। আমরা আল্লাহর কাছে আফিয়াত চাই। আমাদেরও জন্য এবং তোমাদেরও জন্য। -মুসলিম ১/৩১৩,৩১৪; সুনানে নাসায়ী ১/২২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯৮৫
,
এরপর কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দুআ করবে এবং কিছু পড়ে ঈসালে ছওয়াব করবে। হাদীসে কিছু কিছু সূরার কিছু বিশেষ ফযীলতও উল্লেখিত হয়েছে। তেমনি দরূদ শরীফেরও ফযীলত এসেছে। তো দরূদ শরীফ, সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা ইখলাস এবং আরো যেসব সূরা ইচ্ছা পড়ে ঈসালে ছওয়াব করবে। ওখানের দুআ হয়তো হাত না উঠিয়ে করবে অথবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে করবে। -ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী খ. ৫ পৃ. ৩৫০ কিতাবুল কারাহিয়্যা
,
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য
কবর-যিয়ারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন তা এই যে, কবরের দৃশ্য দেখে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বের বিশ্বাস তাজা করা, নিজের মৃত্যু ও কবর-জীবনকে স্মরণ করা এবং আখিরাতের প্রস্তুতির সংকল্প গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করা এবং মাগফিরাতের দুআ ও ঈসালে ছওযাবের মাধ্যমে তাদের উপকৃত করা। আর আল্লাহওয়ালাদের কবর যিয়ারতের দ্বারা যে পথে চলে তারা আল্লাহর দরবারে মাকবূল হয়েছেন ঐ পথে চলার পাক্কা এরাদা করা।
,
কোনো কাজে কোনো জায়গায় গেলে শরীয়ত সম্মত পন্থায় যিয়ারত করতে পারে,এটাই অধিকাংশদের মত।
যারা মাজার যিয়ারত করে,তাদের আকীদা যদি শুদ্ধ থাকে,শিরকি কোন কাজ যদি জেনে বুঝে না করে থাকে,তাহলে তারা মুসলমান।
★যেহেতু বুযুর্গদের মাযারে, সেখানে শরীয়তের খেলাফ কর্মকাণ্ড হয়,তাই সেখানে গিয়ে তাদেরকে সঠিক ভাবে সুন্নাত পদ্ধতিতে কবর যিয়ারতের পদ্ধতি জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিতে হবে।
যে সমস্ত ইসলামি স্কলারগন এই যিয়ারতকে পুরোপুরি নাজায়েজ বলেন,তাদের ইজতিহাদ হিসেবে তাদের মতটিও ছহীহ আছে।