একজন মুসলিমের জন্য ফরজ (فرض) বা আবশ্যিক বিধানগুলো ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি এবং দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হয়। এগুলো পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর জন্য বাধ্যতামূলক।
একজন মুসলিমের জন্য প্রধান ফরজ বিধানগুলো হলোঃ-
★১. ঈমান বা বিশ্বাস (আকীদাহ)
আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস।
ফেরেশতাদের উপর বিশ্বাস।
কিতাবসমূহ (আসমানী গ্রন্থ) উপর বিশ্বাস।
রাসূলদের উপর বিশ্বাস।
কিয়ামতের দিন (আখেরাত) এর উপর বিশ্বাস।
তাকদীর (ভাগ্য) ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত—এ বিশ্বাস।
ঈমান ছাড়া অন্য কোন আমল গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
তরজমা: রাসূল ঈমান আনয়ন করেছেন ঐ সকল বস্তু সম্পর্কে যা তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানরাও। সবাই ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর নবীগণের প্রতি। তারা বলে, আমরা তাঁর নবীগণের মাঝে কোন পার্থক্য করি না এবং তারা আরো বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা আপনার নিকট ক্ষমা চাই, ওহে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সকলেই আপনারা দিকে প্রত্যাবর্তন করি। [সূত্র : সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৫।]
তারই বিস্তারিত হলো ঈমানে মুফাসসালঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
“যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর, তাঁর ফেরেশতাগণের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের ওপর এবং তাঁর রাসূলগণের ওপর ও কিয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাস করবে না, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূরে গিয়ে পড়বে”। [সূত্র: সূরা নিসা, আয়াত ১৩৬।
হাদীসে জিবরাঈলে উল্লেখ আছে, হযরত জিবরাঈল আ. আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ছদ্মবেশে এসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঈমান কাকে বলে? জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
اَنْ تُؤ مِنَ بِا للّهِ وَمَلئِكَتِه وَكُتُبِه وَرُسُلِه والْيَؤمِ الاَخِرِ وَتُؤْمِنُ بِا لْقَدْرِ خَيْرِه وَ شَرِّه
ঈমানের হাকীকত হলো, তুমি মনে-প্রাণে বদ্ধমূলভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহ তা‘আলার ওপর, তাঁর ফেরেশতাগণের ওপর, আসমানী কিতাবসমূহের ওপর, আল্লাহ তা‘আলার নবী-রাসূলগণের উপর, কিয়ামত দিবসের ওপর এবং তাকদীরের ভালো-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হওয়ার ওপর। [সূত্র: বুখারী খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২ ও মুসলিম। মিশকাত শরীফ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১১]
★নামাজ (সালাত) – দৈনিক ৫ ওয়াক্ত
ফজর (ভোরে)
যোহর (দুপুরে)
আসর (বিকেলে)
মাগরিব (সূর্যাস্তের পর)
ইশা (রাতে)
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ এবং পরিপূর্ণ ঈমানের প্রমাণ।
★যাকাত
নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে (নিসাব পরিমাণ), বছরে একবার যাকাত দিতে হয়।
সাধারণত ২.৫% হারে।
★রোযা (সাওম)
রমজান মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখা ফরজ।
★হজ্জ
শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলিমদের জন্য জীবনে একবার হজ্জ পালন ফরজ।
এটি নির্ধারিত মাস (যিলহজ্জ) এবং নির্দিষ্ট নিয়মে সম্পন্ন করতে হয়।
★প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন (ফরজে আইন)
ঈমান, তাওহীদ, নামাজ, রোযা, যাকাত, হালাল-হারাম ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।
★সততা ও আমানতদারি
সত্য বলা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, হক আদায় ইত্যাদি আচরণ ধর্মীয় দিক থেকে ফরজ।
★হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা
শিরক, সুদ, মদ, জিনা, চুরি, হত্যা, গীবত, মিথ্যা, অপবাদ, অন্যায় গালাগালি ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা ফরজ।
একজন মুসলিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব বিধানসমূহঃ-
★ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাজ পড়া
প্রাপ্তবয়স্ক, মুকীম (বাসস্থানে অবস্থানরত) পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ ওয়াজিব।
হাদীস:
“আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতাম...।”
— সহীহ বুখারী ও মুসলিম
★ওয়াজিব কুরবানী (ঈদুল আযহায়)
নিসাব পরিমাণ সম্পদ যার থাকে, তার জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ- “তোমার রবের জন্য নামাজ পড় এবং কুরবানী কর।”
— (সূরা কাউসার, 108:2)
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
“যার সামর্থ্য আছে, কিন্তু কুরবানী করেনি—সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।”
— (ইবনে মাজাহ, হাদীস: 3123)
★বিদায় তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা) – হজ্জের সময়।
হাজীদের জন্য বিদায় তাওয়াফ ওয়াজিব।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
“হজ্জ পালনের পর সর্বশেষ কাজ হওয়া উচিত কাবা ঘরের তাওয়াফ।”
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: 1327)
★বিতর নামাজ আদায় করা (ঈশার পরে ৩ রাকাআত)
বিতর নামাজ হানাফি মাযহাব অনুযায়ী ওয়াজিব।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
“তোমরা বিতর নামাজ পড়, কেননা তা তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে।”
— (আবু দাউদ, হাদীস: 1416)
★রমজানের কাযা ও কাফফারা আদায়।
রোযা ভঙ্গ করলে কাযা ও কাফফারা (দণ্ড) আদায় ওয়াজিব।
★নযর মানা (মানত) পূরণ করা
কেউ যদি মানত করে (যেমন: “এটা হলে আমি আল্লাহর রাস্তায় এত টাকা দেব”) — তা পালন ওয়াজিব।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ-
“তারা মানত পূরণ করে এবং এক ভীতিকর দিনকে ভয় করে...”
(সূরা আদ-দাহর, 76:7)
★কুরআন তিলাওয়াত শোনা অবস্থায় চুপ থাকা
যখন কুরআন পাঠ হচ্ছে, তখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা ওয়াজিব।
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ-
“যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাকো।”
(সূরা আরাফ, 7:204)