১) বিয়ের আগে থেকেই আমার প্যানিক, স্যানসেশন ও হিস্টারিক হওয়ার সমস্যা ছিলো। কিন্তু বিয়ের সময় আমার জাওজের পরিবারকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি। বিয়ের পরে আমি হিস্টারিক হয়ে হাত পা কাঁপার শুরু করলে আমার জাওজ আম্মুকে কল করে। আম্মু তাকে বুঝায়, কিন্তু আব্বু কল দিয়ে বলে, "তুমি কি ওর সাথে রাগ করেছো? ওকে বকা দিয়েছো? ওকে রাতে জাগিয়েছো বেশি? ও কী কাজ করেছে বেশি?" প্রশ্নগুলো একজন বাবা হিসেবে করা স্বাভাবিক হলেও, আমার জাওজ ভাবে, ভবিষ্যতে যদি কখনো আমি প্যানিকড হয়ে মারা যাই, তাহলে আব্বু ওর নামে মামলা দিতে পারে। বলতে পারে, "আমিতো ভালো মেয়ে দিয়েছিলাম, তুই মেরে অসুস্থ করেছিস"। এই ভয়ে, যাতে ভবিষ্যতে কোন সমস্যায় তাকে না পরতে হয় সেজন্য আমার সমস্যাগুলো তার পরিবারকে জানায়। তার পরিবার আমার পরিবারকে জানালে দুই পরিবারে ঝামেলা বেঁধে যায়। এতে, সে আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বিয়ে না ভাঙার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু বাহিরে সবার সামনে সে তার পরিবারের পরিবারের পক্ষ নেয়। বিশেষ করে, তার পরিবার যাতে তাকে ত্যায্য না করে বা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না করে সর্বোপরি আমি সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে তার পরিবার যেন তার পাশে থাকে সেজন্য সে সবাইকে বুঝায়, তার অন্য জায়গায় মেয়ে পছন্দ হয়েছিলো সেই মেয়েটাকে কেন বিয়ে করতে দিলো না।
২) আমার পরিবার শুরু থেকেই নিজেদের অবস্থান বুঝাতে চেয়েছিলো। ওরা আমাদের সমতুল্য না, আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে ওদের যায়না। আমি যদি সহশিক্ষায় না যেতাম, তবে কখনোই এমন জায়গায় আত্মীয়তা করতে হতো না তাদের। আমার পরিবারের এমন মনোভাব আমার পছন্দ হয়নি। তাছাড়া, এই ঝামেলায় আমার স্বামীর পক্ষে থাকাই বেশি যুক্তিযুক্ত লেগেছে আমার কাছে। আমি নিজের ব্যাক্তিগত সমস্যার জন্য তাকে বিপদে ফেলতে চাইনি।
৩) প্রায় দেড়মাসের মতো আমি ওদের বাড়িতে ছিলাম। আমার বাসার কোন মানুষের সাথে কোনরকম যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি আমাকে। কিন্তু, ওই পরিবার প্রতিটা মুহুর্তে আমার পরিবারকে অভিশাপ হতে শুরু করে নানারকম গালিগালাজ করতো। নিজের পরিবারের জন্য অপমানজনক কথা শুনাটা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিলো। উপরন্তু, আমার জাওজ তার পরিবারের পক্ষে থাকার জন্য আমার সাথে খুব একটা ভালো করে মিশতো না। খোঁটা দিতো, বডি শেমিং করতো। তার পরিবারের জন্য এমন করছে ভাবলেও, যখন পরিবারের কেগ আশেপাশে থাকতো না তখনও খোঁটা দিলে নিজেকে অসহায় লাগতো। বাসর রাতে আমি তার সাথে নারীসুলভ অভিমান দেখিয়েছি, সেই জড়তা থেকে ভাবতাম, হয়তো আমার প্রতি তার মনটা এখনো নরম হয়নি তাই এমন করছে।
৪) খোঁটা দেয়ার অভ্যাস থাকলেও, তার মাঝে একটা ভালোবাসাকাতর মানুষ দেখতে পেতাম। পরিবারের কেউ তাকে খুব একটা আগলে রাখেনা। মনে হতো আরেকটু বেশি ভালোবাসলে হয়তো তার কাছে যাওয়া যাবে। কিন্তু তার কাছে গেলে সে আরো দূরে সরাতো। অজুহাত, তার পরিবার। (আমি বুঝতে পারিনা তার পরিবারের কারণে আমার থেকে দূরে ছিলো নাকি আমার আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে) স্ত্রী হিসেবে তার কাছে যেতে চাইতাম, কিন্তু যখন সে দূরে সরাতো, তখন নিজের প্রতি একটা ঘৃণা কাজ করতো। মনে হতো চলে গেলেই সে ভালো থাকবে।
৫) আমার পরিবার কিছুতেই নরম হয়নি, দেড় মাসে নরম হওয়াটা স্বাভাবিকও না অবশ্য। এর মধ্যে, আমার পরিবার ছাড়া আমাকে রাখলেও, সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি মনে হয়। সে রোজ বলতো, আমার পরিবার আমাকে চায়না, কোনরকমে তার ঘাড়ের মধ্যে চাপিয়ে দিয়েছে, তারা কোন খোঁজ নিচ্ছেনা। আমার এক মামা কথা বলতো, ওই মামার থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়ে দিতে বলতো, তাহলে ব্যবসা করে আমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারবে। আবার সে-ই বলতো, দরবার হলে আমাকে ছেড়ে দেয়া তার জন্য কোন ব্যাপার না, মোহরানা আদায় করার মতো সামর্থ্য তার যথেষ্টই আছে। আমার ভাশুরের সাথে যতোটা কথা বলতাম, বা আমার শশুরবাড়ির লোকজন, তাদেরকে আমি নরমই দেখেছি। আমার জাওজের ব্যাপারেও মনে হতো, সে সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি থাকতে চায়। কিন্তু এই ঝামেলাতে সে আসলেই কী চাইছিলো, এটা একটা রহস্যের মতো।
৬) আমি ২য়বার প্যানিকড হয়ে গেলে ও জিডি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, থানা জিডি নেয়নি। তখন পুলিশ বলে তোমার বউকে বলো সে খোলা তালাক দিয়ে চলে যাক। আমার পরিবারে ফেরার মতো মুখ ছিলোনা, সিদ্ধান্ত নেই চাকরি নিয়ে কোথাও চলে যাবো, কিন্তু এই বাড়িতে থাকবোনা। ও বললো, যাওয়ার দরকার নেই, তুমি থাকো, মোহরানা কমিয়ে নিলে আইনিভাবে আটকাতে পারবেনা। সবার সামনে মোহরানা শোধ করেছে এমন একটা মিথ্যা দলিলে সাক্ষর রেখে নতুন করে কাবিননামা তৈরী করে। কিন্তু মিথ্যা দলিলে সাক্ষর করার কারণে আমি রেগে যাই। সে তখন খুব ভালোমানুষি দেখিয়ে আমার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করালেও আমি আমার বাবার প্রতি এতোটা মিথ্যাচার হতে দিতে পারিনি। সেখান থেকে আমার মেজাজ বিগড়ে যেতে থাকে। তখন পরিবারের সামান্য কথাতেও আমার আকাশচুম্বী রাগ হতো। সামান্য খোঁটাও সহ্য হতো না। আমি এতো অসুস্থ হয়ে পরি যে ৬ দিন বিছানার বাহিরে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পরে। তারপর বললাম, আমি চলে যাবো। আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিন। আমি ভাইকে নিয়েছি, সে ভাইয়ের সাথে আসতে দেয়নি। তখন, "আমি তার স্ত্রী নই, সে আমার স্বামী নয়" মর্মে আরেকটা দলিলে সাক্ষর করায়। পরদিন আমি বাসায় আসি, কিন্তু আমার পরিবার জানতে পারলে কাগজ ক্যানসেল করানোর জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। তারপর এই কাগজ ক্যানসেল করিয়ে আনি। কাগজ ক্যানসেল করার সময় সে বলছিলো, আমার প্রতি দয়া হয়েছে তার, একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে রাখতে ভালো লাগেনি, মানবতা থেকে ক্যানসেল করাতে এসেছে৷ কিন্তু এছাড়া তাকে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হয়েছে। সবথেকে বড় কথা, সেবার প্রথম তার চোখে মায়া দেখেছি।
৭) আমার পরিবার ক্যানসেল করানো কাগজ দেখে, এতে কাজির সিগনেচার না থাকায় কাবিননামা বাতিল হয়েছে। পরে তাকে আসতে বলা হয়। কিন্তু তার কথা ছিলো, আমার বাবা যেন তার বাবাকে কল করে ক্ষমা চায়। এটা আমার বাবার পক্ষে করা সম্ভব না বলে, আমার পরিবার কোর্টে যেতে চায়। পারিবারিকভাবে বসে ব্যাপারটা মীমাংসা করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হলেও তাদের পরিবার বসতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে বলে, তোকে মায়া করে ভুল করেছি।
৮) ৪ মাস অপেক্ষায় থাকার পর, আমার পরিবার নিষ্ঠুর আচরণের শর্তে সংসার ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমিও তাকে মাফ করতে পারবোনা বলে কাগজে প্রয়োজনীয় সিগনেচার দিয়েছি। কিন্তু আমি নিজের কাজগুলোর জন্যও লজ্জিত। আমার মনে হচ্ছে, একটা মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভুল করেছে হয়তো। ওকে বুঝালে বুঝানো যাবে, ওর ভয়গুলো কাটালে কাটানো যাবে। এখানে নিষ্ঠুর আচরণের শর্ত পূরণ হয়েছে কী না আমি জানিনা। আমার পরিবার বিয়ে করাতে চাইছে, কিন্তু একজন মেয়ে হিসেবে সংসারে হিকমত অবলম্বন করতে না পারার কারণে আমি আল্লাহর কাছে লজ্জিত। তার প্রতি বিশ্বাস কিংবা করুণা, কোনটাই অনুভব করছি না আমি। কিন্তু নতুন কোন সংসার শুরু করার অনুমতি কী পাবো আমি? আল্লাহর কাছে কী এই সংসারের বৈধতা শেষ হয়েছে?