ওয়া আলাইকুমুস-সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া
বারাকাতুহু
বিসমিল্লাহির
রহমানির রহিম
بسم الله الرحمن الرحيم
জবাব,
হিংসা-বিদ্বেষ
থেকে বেঁচে থাকতে একটি কুরআনি দোয়া তুলে ধরা হলো-
رَبَّنَا
اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا
تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ
رَحِيمٌ
বাংলা অনুবাদ
: হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে
ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না;
হে আমাদের রব,
নিশ্চয় আপনি দয়াবান,
পরম দয়ালু। (সুরা হাশর : আয়াত ১০)
আমল : হজরত
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহ তাআলা এ দোয়ার মাধ্যমে সকল মুসলমানকে ছাহাবায়ে
কেরামের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং দোয়া করার আদেশ দিয়েছেন।
শরীরের বাহ্যিক
রোগগুলোকেই মানুষ রোগ মনে করে। বাহ্যিক অঙ্গগুলো রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের কাছে
যায়। ওষুধ ব্যবহার করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু হয়তো
অনেকে জানি না, শরীরের যেমন রোগ আছে, তেমনি আত্মারও রোগ আছে। রোগ দূর করার জন্য বিভিন্ন ওষুধও রয়েছে। আত্মা যদি সুস্থ
হয়ে যায় তাহলে মানুষের বাহ্যিক আচার ব্যবহারও ভালো হয়ে যাবে। মানুষের ভেতর পাপাত্মা
থাকলে তার আচার ব্যবহারেও দেখা দেবে বিভিন্ন অসঙ্গতি। রাসূল (সা.) এক হাদিসে বলেছেন,
‘(জেনে রেখো!) মানুষের দেহে
একটি গোশতের টুকরা আছে। তা যদি সংশোধন হয়ে যায় তাহলে মানব দেহও পুরোটা ঠিক হয়ে যাবে।
আর গোশতের ওই টুকরাতে যদি সমস্যা থেকে যায় তাহলে পুরো দেহেও সমস্যা দেখা দেবে। ওই অংশটির
নাম হচ্ছে কলব।’
যদি গাড়ির
ইঞ্জিনের সঙ্গে মানুষের কলবটাকে তুলনা করা হয় তাহলে এটাই হবে উত্তম উদাহরণ। গাড়ির বাহিক্য
সৌন্দর্য যতই থাকুক না কেন, যদি ইঞ্জিনে সমস্যা থেকে যায় তাহলে ওই গাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছা কষ্টকর। ইঞ্জিন
ঠিক থাকলে, বাহ্যিক সৌন্দর্যে ঘাটতি থাকলেও গাড়ি যথা সময়ে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। ঠিক
তেমনি কারো যদি ‘দিল মেঁ কুছ কালা’ থাকে তাহলে সে সবখানে সমস্যার অংশ হয়ে দেখা দেবে।
আর হৃদয় যদি প্রশস্ত হয় তাহলে কারো উপকার করতে না পারলেও সমস্যার কারণ হবে না। এতদিন
বুযূর্গগণ মানুষের আত্মার রোগ, আত্মার পরিচর্যার কথা বলে আসলেও চিকিৎসা শাস্ত্রে এর তেমন গুরুত্ব
নজরে আসেনি। এখন ডাক্তারগণ শরীরের যত্নের পাশাপাশি আত্মার যত্নের কথাও বলছেন। বলছেন
শুধু শরীরের পরিচর্যা নয় বরং মানসিকতারও পরিচর্যা দরকার। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মার রোগগুলোর
মাঝে রয়েছে অহংকার, লৌকিকতা, অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা, ভীরুতা ও হিংসা ইত্যাদি।
আগুন মানুষের
বাহ্যিক অঙ্গগুলোকে পোড়ায়। আগুনে পোড়ার পর অঙ্গে শুরু হয় জ্বালাযন্ত্রণা। হিংসাও আগুনের
মতোই এক ধরনের অদৃশ্য বস্তু। এর দ্বারাও পুড়ে। তবে শরীর নয় বরং মানুষের হৃদয়। সেই পুড়ার
জ্বালাযন্ত্রণাও আছে। এক কবি বলেছেন, ‘হিংসার আগুন অন্যকে পুড়ানোর আগে হিংসুককেই জ্বালিয়ে
ভস্মীভূত করে।’ তাই হিংসুকরা মানসিকভাবে কখনো শান্তি লাভ করতে পারে না। হয়তো এখনো গবেষণা
হয়নি যে, হার্ডের রোগীদের শতকরা কতজন হিংসা ও রেষারেষির কারণে আক্রান্ত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস,
যার ভেতর মানসিক এই আগুন জ্বলবে,
সে কখনো মানসিক ও হার্ডের দিক থেকে
পুরো সুস্থ থাকতে পারবে না। দ্বীনদারির দিক থেকেও হিংসা খুবই ক্ষতিকর একটি রোগ।
হাদিসে এসেছে,
নবী করিম (সা.) বলেন,
‘ তোমরা হিংসা থেকে দূরে
থাকো। হিংসা নেক আমলগুলোকে তেমনি বরবাদ করে দেয়, যেমন আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে।’
কারো কাছে মনে হতে পারে নেক আমল, হিংসা দ্বারা বিনাশ হয় কিভাবে?
মুহাদ্দিসগণ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য হচ্ছে, হিংসা এমন একটি রোগ, যখন কারো ভেতর বাসা বাধে তখন সে অন্যের ক্ষতি করতে সদা সচেষ্ট থাকে। কোনরূপ ক্ষতি
করতে না পারলে, ওই লোকের দোষ মানুষের কাছে বলে বেড়ায়। তার কুৎসা রটায়। আর এগুলোর কারণে হাশরের
ময়দানে যার কুৎসা রটিয়েছিলো, তাকে ওর নেক আমলের সওয়াব দিয়ে দেয়া হবে। এভাবেই মূলত তার নেক
আমলগুলো বিনাশ হয়ে যাবে।
অন্য এক হাদিসে
এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে যত মারাত্মক রোগ ছিলো,
সেগুলো তোমাদের মাঝে চলে এসেছে। হিংসা
এবং রেষারেষি সবকিছুকে মুণ্ডিয়ে ফেলে। মুণ্ডানো দ্বারা উদ্দেশ্য চুল মুণ্ডানো নয় বরং
দ্বীনকে মুণ্ডিয়ে দেয়া। (সুনানে তিরমিজি) সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন,
এ সকল রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত;
এটা সর্বসম্মত মত। তাই রাসূল (সা.)
সাহাবায়ে কেরামের সামনে এ কথা বললেও এর দ্বারা উদ্দেশ পরবর্তী উম্মত।
তিনটি গুণ
লাভ করতে পারলে হিংসা বাসা বাঁধতে পারবে না
রাসুল (সা.)
এর সেবায় যে কজন সাহাবি সদা লেগে থাকতেন তাদের অন্যতম ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ।
তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিনটি গুণ আছে, যেগুলো কোনো মুমিন অর্জন করতে পারলে তার অন্তরে কারো প্রতি হিংসা আসবে না। প্রথম
গুণ হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকল কাজ করা। দ্বিতীয়,
মুসলমানদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত দায়িত্বশীলদের
কল্যাণ কামনা করা। তৃতীয়, মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা। (মনে রেখো) দ্বীনের দাওয়াত এমন
এক ফলপ্রসূ কাজ যে, তা মুসলমানকে অমুসলিমদের থেকে সুরক্ষা দেবে।’ (সুনানে তিরমিজি)।
রাসূল (সা.)
যে তিনটি গুণের আলোচনা করলেন, তা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হচ্ছে-
আল্লাহর সন্তুষ্টির
জন্য কাজ করা:
সমাজে হিংসা
ছড়ায় যখন অন্যকে প্রতিপক্ষ মনে করা হয়। কিন্তু আমার কাজের লক্ষ যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি
লাভ করা, অন্যকে পেছনে ফেলা বা ঘায়েল করা নয় তাহলে কখনো হিংসা তৈরি হবে না। বরং মনে করা
হবে, ওই লোকও আমার সহযোগী। কোরআন এবং হাদিসে এ ব্যাপারে জোর তাকিদ দেয়া হয়েছে। আল কোরআনে
বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, কোরবানি, আমার জীবন-মরণ একমাত্র আল্লাহর জন্য।’ অন্যত্র বলা হয়েছে,
‘তাদেরকে নির্দেশ দেয়া
হয়েছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ইবাদত করতে।’
আজ মুসলমান
পরস্পর দ্বন্দ-কলহে লিপ্ত। হিংসা-বিদ্বেষের কারণে মুসলমানের দেশ,
সমাজ ও পরিবার অশান্তির আগুন জ্বলছে।
অথচ ইসলাম শান্তির ধর্ম। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা একে অন্যের পেছনে লেগে থেকো না,
অন্যের গোপন বিষয় সন্ধান করো না,
পরস্পর হিংসা করো না বরং পরস্পর ভাই
ভাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে বসবাস করো।’ তাছাড়া হিংসা থেকে বাঁচার জন্য রাসূল (সা.)
কয়েকটি গুণ অর্জনের কথা বলেছেন। কারো মাঝে সে গুণগুলো এসে গেলে আল্লাহ তায়ালার রহমতে
তার ভেতর হিংসা বাসা বাঁধতে পারবে না।
মানুষের কল্যাণকামিতা:
বুখারী শরিফের
এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামিতার নাম। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন,
হে আল্লাহর রাসূল! কার জন্য কল্যাণ
কামনা করবো? রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা, তার রাসূল ও কিতাব এবং মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ও জনসাধারনের জন্য কল্যাণ কামনার
নাম হচ্ছে দ্বীনদারি।’ হিংসা সাধারনত হয় কারো ক্ষতি করার ইচ্ছা থেকে। কারো যদি ইচ্ছা
থাকে আমি সকলের কল্যাণ করবো তাহলে হিংসা আসবে কোথায় থেকে?
এ জন্য বুযূর্গগণের উপদেশ হলো,
কারো ওপর যদি তোমার হিংসা হয় তাহলে
তুমি তার কল্যাণ করার জন্য লেগে পড়। তাহলে দেখবে মন থেকে আস্তে আস্তে হিংসা উধাও হয়ে
গেছে।
সংঘবদ্ধ জীবন
যাপন করা:
রাসূল (সা.)
হিংসার আগুন থেকে নিজকে বাঁচানোর জন্য জামাতবদ্ধ জীবন যাপনের কথা বলেছেন। এক সঙ্গে
মিলমিশে থাকার বরকতে হিংসা আসতে পারবে না। তাছাড়া মিলেমিশে থাকতে হলে,
মনে হিংসা রেখে এক সঙ্গে থাকা কখনো
সম্ভব নয়। কারণ হিংসা পরস্পর দূরত্বের কারণগুলোকে সৃষ্টি করে। সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের
গুরুত্ব আরো বহু হাদিসে এসেছে। এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন,
আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে আদেশ করবো
আর পাঁচটি বিষয়ে নিষেধ করবো। নির্দেশিত পাঁচটি বিষয়ের অন্যতম একটি হচ্ছে সংঘবদ্ধ জীবন।
নামাজের জামাতে এক কাতারে দাঁড়ালেও মানুষের মনের অবস্থা পরিবর্তন হয়। নিয়মিত যারা জামাতে
নামাজ আদায় করে তাদেরও পরস্পর সম্পর্ক গভীর হয়। তাই আমাদের মন থেকে হিংসা রেষারেষি
দূর করতে হলে করণীয় হচ্ছে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন। যার ছোট্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে মসজিদে জামাতের
সঙ্গে নামাজ আদায়ের ফলে পরস্পর সুস্পর্ক তৈরি হওয়া। (সংগৃহিত)
প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনী ভাই/বোন!
হিংসা করা
নাজায়েয ও হারাম। হিংসা করা থেকে বাঁচতে উপরে উল্লেখিত
সুরা হাশরের ১০ নং আয়াত নিয়মিত পাঠ করার
পাশাপাশি "আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম " পড়বেন। সূরা নাস এবং সূরায়ে ফালাক
পড়বেন। আর আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দু'আ করবেন, যেন আল্লাহ তা'আলা আপনাকে হিংসা থেকে হেফাজত করেন। বিশেষ করে যার প্রতি আপনার হিংসা হয় তার কল্যাণের জন্য দোয়া
করবেন ইনশাআল্লাহ আপনার অন্তর থেকে হিংসা দূর হয়ে যাবে।