আইফতোয়াতে ওয়াসওয়াসা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না। ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

0 votes
125 views
in বিবিধ মাস’আলা (Miscellaneous Fiqh) by (2 points)
আসসালামুয়ালাইকুম ওয়ারহমাতুল্লহি ওয়াবারকাতুহ,
উস্তাদ, হাদিস থেকে আমরা জানি যে, একজন সাহাবী রদিয়াল্লহু আনহু প্রতিদিন সবাইকে ক্ষমা করে দিতেন। আর শুধু এই কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা উনাকে আশারায়ে মুবাশশারার মর্যাদা দিয়েছিলেন। আমরাও যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, জান্নাতের আশায় এই আমল করি, যদি সবাইকেই রোজ ক্ষমা করে দিই, তাহলে খুনের অপরাধও কি ক্ষমা করে দিতে হবে?
যাজাকাল্লহু খয়রন।

1 Answer

0 votes
by (61,230 points)
edited by

بسم الله الرحمن الرحيم

জবাব,

ইসলামে শাস্তির বিধান অবশ্যই রয়েছে কিন্তু পাশাপাশি ক্ষমা এবং মার্জনার নির্দেশও রয়েছে। ইসলামে পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর মত বাড়াবাড়ি নেই।  এর সুমহান দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই বিশ্বনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায়। তিনি (সা.) যখন দেখেন যে, অপরাধীর সংশোধন হয়ে গেছে তখন চরম শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর, তার সন্তান-সন্ততির ওপর এবং তার পবিত্র সাহাবিদের ওপর হেন কোন অন্যায় বা অত্যাচার নেই যা করা হয় নি কিন্তু শত্রু যখন ক্ষমার প্রত্যাশী হয়ে ক্ষমা কামনা করেছে তখন বিশ্বনবী, মানবতার নবী ও ক্ষমার মূর্ত প্রতীক হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অতীব ক্ষমাশীল, তিনি ক্ষমাকে পছন্দ করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন,

وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا ۖ فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ

 ‘আর অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় অনুপাতে হয়ে থাকে। কিন্তু (অন্যায়কারীকে) শোধরানোর উদ্দেশ্যে যে ক্ষমা করে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আশ শুরা, আয়াত: ৪০) 

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মক্কা থেকে হিজরতের সময় মহানবীর (সা.) আদরের কন্যা হজরত যয়নাবের ওপর এক পাষণ্ড হাব্বার বিন আসাদ বর্শা দিয়ে প্রাণঘাতি আক্রমণ করে। তিনি তখন অন্তঃসত্তা ছিলেন।  সেই হামলার কারণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তার গর্ভপাত ঘটে। অবশেষে এই আঘাত তার জন্য প্রাণহানীর কারণে পরিণত হয়। এ অপরাধে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার রায় প্রদান করা হয়েছিল।  মক্কা বিজয়ের সময় এই ব্যক্তি কোথাও পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে মহানবী (সা.) যখন মদিনায় ফিরে আসেন তখন হাব্বার মদিনায় মহানবীর (সা.) সকাশে উপস্থিত হয়ে বলে, আপনার ভয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বড় বড় অপরাধ রয়েছে আর আপনি আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। 

কিন্তু আপনার দয়া এবং মার্জনার খবর আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। যদিও আপনি আমার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দিয়েছেন কিন্তু আপনার ক্ষমা এবং মার্জনা এত ব্যাপক যে, এর ফলে আমার মাঝে এই সাহস সৃষ্টি হয়েছে আর আমি আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। 

আরও বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর নবী! আমরা অজ্ঞতা এবং শিরকে নিমজ্জিত ছিলাম, আল্লাহতায়ালা আমাদের জাতিকে আপনার মাধ্যমে হিদায়াত দিয়েছেন এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন। আমি আমার সীমালঙ্ঘন এবং অপরাধ স্বীকার করছি, আপনি আমার অজ্ঞতা উপেক্ষা করুন। এতে মহানবী (সা.) তার কন্যার এই হত্যাকারীকেও ক্ষমা করেন এবং বলেন, যাও হাব্বার! তোমার ওপর আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ হয়েছে, তিনি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের এবং সত্যিকার তওবা বা অনুশোচনা করার তৌফিক দিয়েছেন।’  (আল মাজুমুল কাবীর লিল তিবরানী, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৩১, মুসনাদ আন নিসায়ে যিকরে সুনানে জয়নাব, হাদিস নং ১০৫১, আল সিরাতুল হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩১-১৩২, বৈরুত-২০০২)

অনুরূপভাবে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত আছে, একজন কবি যার নাম ছিল কা’ব বিন জহির। সে মুসলমান নারীদের সম্পর্কে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় কবিতা লিখতো, তাদের সম্ভ্রমে হামলা করতো। তার বিরুদ্ধেও শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল। 

যখন মক্কা বিজয় হয় তখন কা’বের ভাই তাকে পত্র লিখে যে, মক্কা বিজয় হয়েগেছে, তোমার জন্য ভালো হবে মহানবীর (সা.) কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। সে মদীনায় এসে পরিচিত এক ব্যক্তির ঘরে অবস্থান করে আর মসজিদে নববী-তে গিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে ফজরের নামায পড়ে। এরপর নিজের পরিচয় না দিয়েই সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল! কা’ব বিন জহির অনুশোচনার সঙ্গে ফিরে এসেছে এবং ক্ষমা চাচ্ছে, যদি অনুমতি থাকে তাহলে তাকে আপনার সকাশে উপস্থিত করা যেতে পারে। 

তিনি (সা.) যেহেতু তার চেহারা সম্পর্কে জানতেন না, তাকে চিনতেন না বা হতে পারে সে ব্যক্তি মুখ ঢেকে রেখেছিল যার ফলে অন্যান্য সাহাবীরাও চিনতে পারেনি, তাই তিনি (সা.) বলেন যে, হ্যাঁ, সে আসতে পারে। 
তখন সেই ব্যক্তি বলে, আমিই কা’ব বিন জহির। তখন এক আনসারী তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কেননা, তার অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধেও মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মহানবী (সা.) পরম স্নেহ পরবশ হয়ে বলেন, একে ছেড়ে দাও, কেননা, সে ক্ষমা প্রত্যাশী হয়ে এখানে এসেছে।  এরপর সে মহানবীর (সা.) সন্নিধানে একটি কাসীদা বা কবিতার অর্ঘ্য পেশ করে। মহানবী (সা.) তার এক দৃষ্টিনন্দন চাদর তখন পুরস্কারস্বরূপ তাকে উপহার দেন। 

এই শত্রু, যার বিরুদ্ধে মৃত্যু দণ্ডাদেশ জারী করা হয়েছিল, মহানবী (সা.)-এর দরবার থেকে তিনি শুধু প্রাণ ভিক্ষা নিয়েই ফিরে নি বরং পুরস্কার নিয়ে ফিরে গিয়েছে। 

এমন আরো অনেক ঘটনা মহানবীর (সা.) জীবনে দেখা যায়, যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সংশোধনের পর তিনি (সা.) তার ব্যক্তিগত শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন, তার নিকটাত্মীয়ের যারা শত্রু ছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছেন এবং ইসলামের শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন। কিন্তু যেখানে সংশোধনের জন্য শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে তিনি শাস্তিও দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা যেখানে শাস্তির কথা বলেছেন সেখানে ধনী-দরিদ্র সবার সাথে সমান ব্যবহারের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। 

আমরা দেখতে পাই, মদিনায় শাসনকালে মহানবী (সা.) এবং পরবর্তীতে তার খলিফারাও এই শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে দেখিয়েছেন, কীভাবে শাস্তি দেয়া উচিত আর কীভাবে ক্ষমা করা উচিত। শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য কি আর ক্ষমার উদ্দেশ্য কী তাও আমাদেরকে সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে। 

আমাদের মাঝেও আজ ক্ষমার সেই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেই দৃষ্টান্ত আমাদের প্রিয় নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এর পাশাপাশি সমাজে বিশৃঙ্খলাকারীদেরকে সংশোধনের লক্ষ্যে শাস্তি দিয়ে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনও করতে হবে, যাতে করে অপরাধীরা অপরাধ করতে ভয় পায়।

প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনী ভাই/বোন!

কোন হত্যাকারী ব্যক্তিকে তার তওবা ও নিজেকে সংশোধনের পর তাকে ক্ষমা করা এটি অত্যন্ত মহত একটি গুন। যার প্রতি আল্লাহ তায়ালা দান করবেন। কারণ, নবীজী সা: কখনো কখনো সংশোধনের পর ব্যক্তিগত শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন, তার নিকটাত্মীয়ের যারা শত্রু ছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছেন এবং ইসলামের শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন। কিন্তু যেখানে সংশোধনের জন্য শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে তিনি শাস্তিও দিয়েছেন।

সুতরাং প্রশ্নেল্লিখিত বিষয়টি হাদিসে উল্লেখিত ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হওয়া না হওয়া উক্ত ব্যক্তির উপরে নির্ভর করবে। অর্থাৎ সে যদি তওবা না করে এবং পূর্বের থেকেও অধিক অপরাধের সাথে লিপ্ত থাকে তাহলে তাকে ক্ষমা না করে শাস্তি দেওয়াই শ্রেয়। কারণ, বিশৃঙ্খলাকারীদেরকে সংশোধনের লক্ষ্যে শাস্তি দিয়ে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনও করতে হবে, যাতে করে অপরাধীরা অপরাধ করতে ভয় পায়।


(আল্লাহ-ই ভালো জানেন)

--------------------------------
মুফতী মুজিবুর রহমান
ইফতা বিভাগ
Islamic Online Madrasah(IOM)

আই ফতোয়া  ওয়েবসাইট বাংলাদেশের অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য ফতোয়া বিষয়ক সাইট। যেটি IOM এর ইফতা বিভাগ দ্বারা পরিচালিত।  যেকোন প্রশ্ন করার আগে আপনার প্রশ্নটি সার্চ বক্সে লিখে সার্চ করে দেখুন। উত্তর না পেলে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ ৪ টি প্রশ্ন করতে পারবেন। এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আমাদের ফেসবুকেও শেয়ার করা হবে। তাই প্রশ্ন করার সময় সুন্দর ও সাবলীল ভাষা ব্যবহার করুন।

বি.দ্র: প্রশ্ন করা ও ইলম অর্জনের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো সরাসরি মুফতি সাহেবের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা যেখানে প্রশ্নকারীর প্রশ্ন বিস্তারিত জানার ও বোঝার সুযোগ থাকে। যাদের এই ধরণের সুযোগ কম তাদের জন্য এই সাইট। প্রশ্নকারীর প্রশ্নের অস্পষ্টতার কারনে ও কিছু বিষয়ে কোরআন ও হাদীসের একাধিক বর্ণনার কারনে অনেক সময় কিছু উত্তরে ভিন্নতা আসতে পারে। তাই কোনো বড় সিদ্ধান্ত এই সাইটের উপর ভিত্তি করে না নিয়ে বরং সরাসরি স্থানীয় মুফতি সাহেবদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

Related questions

...