আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ উস্তাদ।
নিম্নোক্ত লিখাটি বড় হলেও পড়ার অনুরোধ থাকলো, এবং এটি ঠিক নাকি ভুল, এব্যাপারে জানতে চাচ্ছি। ফেইসবুকে অনেকেই শেয়ার দিচ্ছেন, তবে লেখকের নাম অজানা।
" ইসলামে প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিয়ে করাকে জায়েজ করেছে এটা সত্য কথা। কিন্তু একাধিক বিয়েকে কখনো উৎসাহিত করে নি। কুরআন, হাদীস, সীরাতে সাহাবা ও সলফে সালেহীনদের জীবন চরিত্র গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে এটি স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়। বহুবিবাহের ফজিলতের চেয়ে শরীয়ত মাসআলা বেশি বলে শর্তারূপ করেছে।
ইদানিংকালে নেট দুনিয়া স্বল্প শিক্ষিত ও অতিউৎসাহী কিছু নেটিজন এটিকে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রমোট করছেন দেখে অবাক হতে হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরামের আমলে একাধিক বিয়েকে উৎসাহিত করার ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা যা করেছিলেন সেটি প্রয়োজনের তাগিদে, নিজের যৌন চাহিদা বা খায়েশাত পুরণ করার জন্য কখনো নয়।
কুরআনের যে আয়াত দিয়ে বহু বিহাহকে জায়েজ করা হয়েছে, এবং এর দলিল পেশ করা হয়, সেই আয়াতেই সয়ং আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় বিবাহকে অযথাই উতসাহিত করেন নাই।
কারণ একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সবার মধ্যে সমতা বিধান করা স্বামীর কর্তব্য। কারো ক্ষেত্রে কম বেশি হলে শেষ বিচারের দিন স্বামীকে জবাবদিহি করতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে।
আল্লাহ বলেছেন "একাধিক স্ত্রী থাকলে তোমরা হয়তো একজনের দিকে বেশি ঝুঁকে যেতে পার; তাই তোমরা একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করো।"
এখানে সয়ং আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বলছেন, "তোমরা একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করো।" সেখানে বহু বিবাহের জন্য সর্ব সাধারণের মাঝে মার্কেটিং করা মূলত মহান রবের ইচ্ছার বিরোধী কাজ। আল্লাহ বন্দাকে নিরুৎসাহিত করে বলছেন "তোমরা সমতা রক্ষা করতে পারবে না।"
কুরআনে সূরা নিসায় বলা হয়েছে-
” যদি তোমরা আশঙ্কা কর, ইয়াতীমের প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না,তাহলে যেসব মহিলা তোমাদের পছন্দ হয় তাদের মধ্যে থেকে এক দুই তিন বা চারজনকে বিয়ে করে নাও। কিন্তু যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে তোমরা তাদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে একজনকেই বিয়ে কর।অথবা ঐসব মহিলাদের বিবি বানাও , যারা তোমাদের মালিকানায় এসেছে। অবিচার থেকে বাঁচার জন্য এটাই বেশি সহজ।” সুরা নিসা(৪:৩)
এ আয়াতটি নাযিল হয় ওহুদ যুদ্ধের পরক্ষণেই। ওহুদ যুদ্ধে অনেক মুসলিম শহীদ হন। তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও পারিবারিক পরিবেশের প্রয়োজন ছিল। এ কারণে তাদেরকে বিভিন্নজনের তত্ত্বাবধানে রাখা হলো। বুখারী শরীফে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে একটি এতিম মেয়ে ছিল। সে ব্যক্তির একটি বাগান ছিল, যার মধ্যে উক্ত এতিম বালিকাটিরও অংশ ছিল। সে ব্যক্তি উক্ত মেয়েটিকে বিয়ে করে নিল এবং নিজের পক্ষ থেকে ‘দেন মোহর’ আদায় তো করলোই না, বরং বাগানে মেয়েটির যে অংশ ছিল তাও সে আত্মসাৎ করে নিল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়।
এ আয়াতটি সর্তকতার সাথে পড়লে কয়েকটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে আসে।
১) বহুবিবাহ মুসলমানদের জন্য ‘অত্যাবশ্যক’ (ফরজ) বা পছন্দনীয় (মুস্তাহাব) কিছু নয়। বিশেষ কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ মাত্র।
২) একের অধিক বিয়ে শর্তযুক্ত। শর্তপূরণের সাপেক্ষেই এটি হালাল হয়।
৩) সমতা বিধান না করতে পারলে একটি বিবাহে সন্তুষ্ট থাকতে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমতা বিধান না করতে পারলে একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ।
৪) সমতা বিধান ফরজ।
৫) ইসলাম বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করে নি তবে নিরুৎসাহিত করেছে।
“আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনেই সন্তুষ্ট থাক।” (সূরা নিসা : ৩)
অর্থাৎ ঢালাওভাবে সবপুরুষের জন্য সব পরিস্থিতিতে বহুবিবাহকে আল্লাহ জায়েয করেন নি। আমাদের দেশে অনেকের এ ভুল ধারণা রয়েছে যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সওয়াবের কাজ। ধারণাটি ভুল। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে এটি মুবাহ মাত্র। অপ্রয়োজনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। (দ্রষ্টব্য- নিসা : ৩)
যারা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন তারা আল্লাহর দেয়া শর্ত ‘সমব্যবহার’ অনেক ক্ষেত্রেই করেন না, এক্ষেত্রে সমব্যবহার হলো -
একই মানের বাসস্থান।
একই মানের খাদ্য।
একই মানের পোশাক।
একই মানের সুযোগ সুবিধা (যেমন চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি)।
সমপরিমাণ সময় দান। রাসূল (স.) তার অল্পবয়স্কা স্ত্রী (আয়েশা (রা.)) এর জন্য যতদিন বরাদ্দ করেছিলেন বৃদ্ধা স্ত্রী সাওদা এর জন্যও ততদিনই বরাদ্দ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর নিজের দিনটি আয়েশা (রা.)-কে দিয়ে দেন। কাজেই যারা এরূপ সমব্যবহার করতে পারবে না তাদের জন্য একাধিক বিবাহ হালাল নয় বরং এক স্ত্রী গ্রহণ ফরজ। (সূরা নিসা : ৩)
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর একাধিক স্ত্রী বর্তমান বিদ্যমান ছিল। আর তিনি ছিলেন আদল ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক। সকল স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দান করতেন। স্ত্রীদের জন্য যতটুকু সময় ব্যয় করতেন, তা সকলের জন্য সমানভাবে ভাগ করতেন। এভাবে সাওদাসহ আরো কয়েকজন স্ত্রী সমানভাবে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আরাম ও প্রশান্তি লাভের সময়ের ভাগ পেতেন। কিন্তু মূলতঃ তাঁদের বয়সের কারণে তারা রাসূল (স.)-কে প্রশান্তি দিতে অক্ষম ছিলেন। স্বেচ্ছায় নিজের অধিকার সতীন আয়েশা (রা.) এর অনুকূলে ছেড়ে দিয়ে রাসূল (স.)-কে দায়মুক্ত করেন।
আরও বলা হয়েছে-
“তোমরা যতই আগ্রহ রাখো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতে কখনো সক্ষম হবে না……”(সুরা নিসা ০৪:১২৯)
এ ব্যপারে নবী মুহাম্মদ (স:) বলেন,
“যে ব্যক্তির দুই জন স্ত্রী আছে, কিন্তু তার মধ্যে এক জনের দিকে ঝুঁকে যায়, এরূপ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অর্ধদেহ ধসা অবস্থায় উপস্থিত হবে।”
(আহমেদ ২/৩৪৭; আসবে সুনান; হাকিম ২/১৮৬) ইবনে হিব্বান ৪১৯)
উপরোক্ত দলীল থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, বহু বিবাহ শর্ত সাপেক্ষে জায়েয কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিনা প্রযোজনে খাহেশাতে বা সমতা রক্ষা করতে না পারলে বহু বিবাহকে নিরুৎসাহিতই বেশী করা হয়েছে।
বহুবিবাহের ইস্যুটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। ইসলামে একের অধিক বিবাহকে
প্রয়োজনে জায়েজ করা হয়েছে এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ বিয়ের অনুমতি দেয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে বা প্রাসঙ্গিক শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা কম হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন-চরিত্র ও সীরাতের সাথে এটিকে না মিলিয়েই আম আওয়াজ তুলতে চাই।
নবিজী খাদিজা রাযি এর জীবদ্দশায় কোন নারীকে বিয়ে করেন নি। এটিও একটি সুন্নত। দীর্ঘ ২৪ বছর সংসার করেছেন। আপনি আগে ২৪ বছর একজন নিয়ে সংসার করুন তার পরে দ্বিতীয় বিয়ের সুন্নত পালন করুন। এটিতো নবিজীর শিক্ষা।
বহুবিবাহের আয়াত নাজিল হয়েছিলো উহুদ যুদ্ধের পর। মাসনা থেকে আয়াত শুরু হওয়ার কারণ ও পেক্ষপট এটি। আয়াতের শানে নুযুল পড়ুন। যখন বিপুল পরিমাণ মুসলিম পুরুষ সৈন্য মারা গেলেন। নারীরা তখন কেউ বিধবা হল, কেউ এতীম হল।স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের সংখ্যা কমে গেলো। বহুবিবাহ ছাড়া সব মেয়ের জন্য স্বামীর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো না। এপেক্ষাপটে আল্লাহ জায়েজ ঘোষনা করেছেন কিন্তু শর্ত ও নিরুৎসাহিতের সাথে। আর এখানে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও সম্ভ্রম সুরক্ষাই মূল উদ্দেশ্য। (বিস্তারিত দেখুন : তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন : ২/২৮৬-২৯৫, আনওয়ারুল বয়ান : ২/২৩৫, তাফসির ফি জিলালিল কোরআন : ১/৫৭৭-৫৮৩)।
সুতারাং দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বিয়ের হুকুম এসেছিল নারীর স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে, পুরুষের খায়েশ মিটানোর জন্য নয়। সেসব নারীদের পেক্ষিতে এই আয়াত যারা বিধবা ও অসহায়। তাদের আশ্রয়ের জন্য। তাদের ও তাদের সন্তানের নিরাপত্তা ও হেফাজতের জন্য। আজকের যেসব ইসলামপন্থী তরুণ মাসনার আওয়াজ তুলছেন, তারা কী কখনো এমন অসহায় নারীদের নিয়ে ভাবছেন? তাদের প্রয়োজনে বিবাহ করে দায়িত্ব নিচ্ছেন? বরং অধিকাংশই শর্তের বাহিরে কেবল নিজের মনোরঞ্জন মেটানোর জন্য এসব বিষয় ভাইরাল করছেন। আবেগ নয়, আসুন শরীয়াহ বাস্তবতা অনুধাবন করে বহু বিবাহ কেন জায়েজ সে পেক্ষাপট অনুধাবনের চেষ্টা করি।
হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাযি:) ইন্তেকালের পরবর্তী জীবনের বিয়েগুলো ছিল কোনটা সামাজিক কারণে, কোনটা রাজনৈতিক কারণে,কোনটা ধর্মীয় কারণে। নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজাতুল কুবরা রাযি: ছাড়া সকল স্ত্রীদের আল্লাহর নির্দেশে, ইসলামের প্রয়োজনে বিয়ে করেছিলেন।
যেমন, পালিত পুত্রের স্ত্রীর সাথে দেখা দেয়া নাজায়েজ এবং বিধবা হলে বা ডিভোর্স হলে বিয়ে করা জায়েয; এই নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজেই তালাকের পর পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন। আম্মাজান আয়েশার সাথে তার বিয়ের পয়গাম সয়ং আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। মূলত অল্পবয়সে মানুষের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে। কাজেও দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর উম্মুল মোমেনীন আয়েশা (রা:) সর্বোচ্চসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আলী (রাযি:) রাসূলের নিকট দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি চাইলে তিনি বলেছিলেন “যে আমার ফাতিমাকে কষ্ট দেয় সে যেন আমাকেই কষ্ট দিল।”অর্থাৎ তিনি নিজেও প্রথম স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়েকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
হজরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.) বলেছেনন- “আমি রসুলুলাহ ((স)-কে মিম্বরে বসে বলিতে শুনেছি − হিশাম ইবনে মুগীরা আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর নিকট তাহার মেয়ে বিবাহ দেওয়ার জন্য আমার নিকট প্রস্তাব করেছে। কিন্তু আমি অনুমতি দিই নি এবং আলী (রা.) আমার কন্যা ফাতেমা (রা.)কে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত আমি অনুমতি দিব না। কেননা ফাতেমা হচ্ছে আমার শরীরের অংশ। আমি ঐ জিনিস ঘৃণা করি যা সে ঘৃণা করে এবং তাহাকে যা আঘাত করে তাহা আমাকেও আঘাত করে।” সহি বুখারি, ৭ম খণ্ড, ১৫৭।
নিজের মেয়ের বিষয়েও তিনি দ্বীতিয় বিয়েকে অপছন্দ করেছেন এবং নিরুৎসাহিত করেছেন। বিয়েতে জোড়গলায় মহরে ফাতেমিকে সুন্নত মানলে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে ফাতেমি এই সুন্নত মানা জরুরী নয় কেন? প্রয়োজন পেক্ষাপটে জায়েজ এতে কারো কোন আপত্তি নেই। তবে ডালাওভাবে নয়।
রাসুলের পবিত্র স্ত্রীগন ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জন্য নির্নাচিত ও সম্মানীত। এই মর্যাদাবান উম্মাহাতুল মুমিনিন মধ্যেও সতিনদের সাথে ঝগড়া, মান অভিমান এর কথা হাদীসে এসেছে। স্ত্রীদের এসব আচরণে নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্ট পেয়ে দীর্ঘ দিন আম্মাজানদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এনিয়ে আল্লাহপাক কুরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানবের সীরাতের এসব ঘটনা উম্মতের জন্য কী শিক্ষা দেয়?
এছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। আরশের স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। [উয়ুনুল আছার – ২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব – ৩/২১৯]
বহুবিবাহকে এমনভাবে প্রচার করছে যেন এটা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ!মাসনা সুলাসা রুবায়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এরা ধর্মকে উপহাসের পাত্র বানিয়ে ফেলেছে। এটা ছাড়া যেন ইমান অপূর্ণ থেকে যায়!
চলুন দেখা যাক ইমামগণ এ ব্যাপারে কী বলেছেন,
#ইমাম আলাউদ্দিন আল মারদাওয়ি বলেন,
"মুস্তাহাব হলো একের অধিক বিয়ে না করা।"
#ইমাম ইবনে কাজি আল জাবাল তাঁর 'আল ফায়িক' কিতাবে লিখেছেন,
"একের অধিক বিয়ে করা উচিত নয়।"
#ইমাম আল নাজিম বলেন,
"একটি বিয়েই ন্যায়পরায়ণতার অধিক নিকটবর্তী।"
#ইমাম আলি ইবনে মুহাম্মাদ আল বালি তাঁর 'তাজরিদ আল ইনায়াহ' কিতাবে লেখেন,
"(একের অধিক বিয়ে করা উচিত নয়) এটাই প্রসিদ্ধতম মত।"
#ইমাম ইবনু খতিব বলেন,
"আমাদের অধিকাংশ ইমামগণ একের অধিক বিয়ে না করাকে পছন্দ করেছেন।"
(সূত্র: কিতাব আল ইনসাফ, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৬)
#ইমাম শাফেয়ি বলেন,
"আমি পছন্দ করি পুরুষ কেবল একটি বিয়েতেই সীমিত থাকবে, যদিও একাধিক করা তার জন্য বৈধ। কেননা আল্লাহ বলেছেন "যদি ভয় করো সমতা করতে পারবে না, তবে একটি অথবা তোমাদের অধীনস্ত দাসীদের। সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার এটাই সহজতম উপায়।" (সুরা আন নিসা, আয়াত: ৩)
#ইবনে দাউদ ইমাম শাফেয়ির এই কথায় আপত্তি তোলে এবং বলে "আপনি কেন বললেন কেবল একটি বিয়েতে সীমিত থাকতে, অথচ স্বয়ং নবি বহু স্ত্রীর সংসার করেছেন?"
উত্তর: নবি ব্যতিরেকে অন্যদের জন্য উত্তম হলো কেবল একটি‌‌ বিয়েতে সীমিত থাকা, কেননা সমতা বিধান না করার আশংকা রয়েছে। নবির ক্ষেত্রে যেহেতু এই আশংকা নেই, তাই তার বিষয় ভিন্ন।
আর হাদিসে যে বলা হয়েছে "বিয়ে করো, সংখ্যাবৃদ্ধি করো" এর ব্যাখ্যা হল এখানে বিয়ে করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, বিয়ের সংখ্যা বাড়াতে নয়।"
(মন্তব্য: অর্থাৎ হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে যুবকদের বিয়েতে উৎসাহিত করা এবং সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। একই পুরুষ একাধিক বিয়ে করবে এটা হাদিসের উদ্দেশ্য নয়)
(সূত্র: আল বায়ান ফি মাজহাবিল ইমাম আশ শাফেয়ি, খণ্ড:১১, পৃষ্ঠা: ১৮৯, ১৯০)
ইমাম আশ শিরবিনি লিখেছেন,
"সুন্নত হলো সুস্পষ্ট অনিবার্য কারণ ছাড়া একের অধিক বিয়ে না করা।"
(সূত্র: মুগনি আল মুহতাজ, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৭)
দেখেন বহুবিবাহ সম্পর্কে উপমহাদেশের হানাফী মুফতিদের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স-বই ফাতাওয়া আলমগীরী-তে কী বলা হয়েছে :
“যদি কারো একজন স্ত্রী থাকে এবং সে আরেকটি বিয়ে করতে চায়, তার যদি ভয় থাকে যে সে তাদের মধ্যে সমতা ও ন্যায় রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে তার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার সুযোগ নেই। যদি এ রকম কোনো ভয় না থাকে, তাহলে সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিয়ে থেকে বিরত থাকাই উত্তম এবং স্ত্রীকে দুঃখ দেওয়া থেকে বিরত থাকার কারণে সে সওয়াব পাবে।”
-ফাতাওয়া আলমগীরী ৭/ ৪৭৮
হানাফী ফকীহ সিরাজুদ্দীন ইবনে নুজাইম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যদি কেউ স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার উদ্দেশ্যে একাধিক বিয়ে না করে, তাহলে সে সওয়াব পাবে। স্ত্রীকে কষ্ট না দেওয়া ইবাদত ও সওয়াবের কাজ এবং উত্তম হলো এক বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকা।
-আন-নাহরুল ফায়েক শরহু কানযিদ-দাকায়েক
তাই আমভাবে, শর্তহীন কেবল নিজের নফসানিয়্যাত ও খায়েশাত পূরণের নিমিত্তে বহু বিবাহ করা কিংবা এর জন্য অন্যকে উৎসাহিত করা, কিংবা এটিকে মিশন বানিয়ে কাজ করার সুযোগ ইসলাম আপনাকে ঢালাওবাবে অনুমতি দেয় নি।
কারো প্রয়োজন হলে শর্ত সাপেক্ষ এটিকে জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। যেমন একইভাবে তালাককে নিরুৎসাহিত ও ঘৃণিত কাজ হিসাবে বিবেচনায় করেই প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষ জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। তালাক নিয়ে যেমন মার্কেটিং করার সুযোগ নেই তেমনি মাসনা নিয়েও উৎসাহিত করার সুযোগ ইসলামে দেয়া হয় নি।"