সমাধানঃ-
মানসুর আল–হাল্লাজ, পুরো নাম-
আরবি : "ﺃﺑﻮ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺣﺴﻴﻦ ﺑﻦ ﻣﻨﺼﻮﺭ ﺍﻟﺤﻼﺝ "
বাংলাঃ আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মানসুর আল-হাল্লাজ।
উইকিপেডিয়ার তথ্যমতে এ নশ্বর পৃথিবীতে তার অস্থানঃ
৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ – মার্চ ২৬, ৯২২ খ্রিস্টাব্দ মুতাবেক ২৪৪ হিজরী – ৩০৯ হিজরী পর্যন্ত।
তিনি ছিলেন একজন ইরানী মরমি সুফী, বৈপ্লবিক সাহিত্যিক এবং সুফিবাদ -এর একজন দিকদর্শি।
তিনি মুসলিম জগতে খ্যাত ছিলেন প্রধানতঃ তার চরম বিতর্কিত বক্তব্য "আনাল হাক্ক" ("আমিই পরম সত্য") এবং এর ফলশ্রুতিতে লম্বা বিচার-প্রক্রিয়ার পরে আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির এর আদেশে মৃত্যুদন্ড হওয়ার কারণে।
মনসুর হাল্লাজ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের থেকে দুই ধরণের মন্তব্য পাওয়া যায়,
(১) যারা বাহ্যিক দিক বিবেচনা করেছেন,তারা মনসুর হাল্লাজকে গোমরা বা পথভ্রষ্ট মনে করেন,যেমন ইবনে ক্বাসির উনার অমর গ্রন্থ "আল-বেদায়া ওয়াননেহায়া"তে মনসুর হাল্লাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে যেয়ে অত্যান্ত ঢৃড় কন্ঠে বলেন
ﻭﻛﺎﻥ ﻣﻦ ﺳﻌﻰ ﻓﻲ ﻗﺘﻠﻪ ﻭﻋﻘﺪ ﻟﻪ ﻣﺠﻠﺴﺎً ﻭﺣﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﻓﻴﻪ ﺑﻤﺎ ﻳﺴﺘﺤﻘﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﻘﺘﻞ ﻫﻮ ﺍﻟﻘﺎﺿﻲ ﺃﺑﻮ ﻋﻤﺮ ﻣﺤﻤﺪ ﺑﻦ ﻳﻮﺳﻒ ﺍﻟﻤﺎﻟﻜﻲ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ . ﻭﻗﺪ ﺍﻣﺘﺪﺣﻪ ﺍﺑﻦ ﻛﺜﻴﺮ ﻋﻠﻰ ﺫﻟﻚ ﻓﻘﺎﻝ : ﻭﻛﺎﻥ ﻣﻦ ﺃﻛﺒﺮ ﺻﻮﺍﺏ ﺃﺣﻜﺎﻣﻪ ﻭﺃﺻﻮﺑﻬﺎ ﻗَﺘْﻠَﻪُ ﺍﻟﺤﺴﻴﻦ ﺑﻦ ﻣﻨﺼﻮﺭ ﺍﻟﺤﻼﺝ ﺍﻫـ (
যে ব্যক্তি মনসুরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেছে,এবং তার জন্য বিচার মঞ্চ কায়েম করেছে,এবং তার প্রাপ্য সাজা মৃত্যুদন্ড তাকে প্রদান করেছে,তিনি হলেন ক্বাজী আবু উমর মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ মালিকী রাহ, ( এবং তিনি কাজী সাহেবের প্রশংসা করতে যেয়ে আরও বলেনঃ)এই কাজী সাহেবের রায় সর্বোচ্ছ ইনসাফ বিত্তিক ও সঠিক ছিল,যে তিনি হুসাইন ইবনে মনসুর হাল্লাজকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছিলেন।
(১১/১৩২-১৪৪)
ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহ এ সম্পর্কে বলেনঃ
ﻣَﻦْ ﺍﻋْﺘَﻘَﺪَ ﻣَﺎ ﻳَﻌْﺘَﻘِﺪُﻩُ ﺍﻟْﺤَﻼﺝُ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﻤَﻘَﺎﻻﺕِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻗُﺘِﻞَ ﺍﻟْﺤَﻼﺝُ ﻋَﻠَﻴْﻬَﺎ ﻓَﻬُﻮَ ﻛَﺎﻓِﺮٌ ﻣُﺮْﺗَﺪٌّ ﺑِﺎﺗِّﻔَﺎﻕِ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ ; ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ ﺇﻧَّﻤَﺎ ﻗَﺘَﻠُﻮﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﺤُﻠُﻮﻝِ ﻭَﺍﻻﺗِّﺤَﺎﺩِ ﻭَﻧَﺤْﻮِ ﺫَﻟِﻚَ ﻣِﻦْ ﻣَﻘَﺎﻻﺕِ ﺃَﻫْﻞِ ﺍﻟﺰَّﻧْﺪَﻗَﺔِ ﻭَﺍﻹِﻟْﺤَﺎﺩِ ﻛَﻘَﻮْﻟِﻪِ : ﺃَﻧَﺎ ﺍﻟﻠَّﻪُ . ﻭَﻗَﻮْﻟِﻪِ : ﺇﻟَﻪٌ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀِ ﻭَﺇِﻟَﻪٌ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽِ . . . ﻭَﺍﻟْﺤَﻼﺝُ ﻛَﺎﻧَﺖْ ﻟَﻪُ ﻣﺨﺎﺭﻳﻖ ﻭَﺃَﻧْﻮَﺍﻉٌ ﻣِﻦْ ﺍﻟﺴِّﺤْﺮِ ﻭَﻟَﻪُ ﻛُﺘُﺐٌ ﻣَﻨْﺴُﻮﺑَﺔٌ ﺇﻟَﻴْﻪِ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴِّﺤْﺮِ . ﻭَﺑِﺎﻟْﺠُﻤْﻠَﺔِ ﻓَﻼ ﺧِﻼﻑَ ﺑَﻴْﻦِ ﺍﻷُﻣَّﺔِ ﺃَﻥَّ ﻣَﻦْ ﻗَﺎﻝَ ﺑِﺤُﻠُﻮﻝِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺒَﺸَﺮِ ﻭَﺍﺗِّﺤَﺎﺩِﻩِ ﺑِﻪِ ﻭَﺃَﻥَّ ﺍﻟْﺒَﺸَﺮَ ﻳَﻜُﻮﻥُ ﺇﻟَﻬًﺎ ﻭَﻫَﺬَﺍ ﻣِﻦْ ﺍﻵﻟِﻬَﺔِ : ﻓَﻬُﻮَ ﻛَﺎﻓِﺮٌ ﻣُﺒَﺎﺡُ ﺍﻟﺪَّﻡِ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﻫَﺬَﺍ ﻗُﺘِﻞَ ﺍﻟْﺤَﻼﺝُ ) ﺍﻫـ ﻣﺠﻤﻮﻉ ﺍﻟﻔﺘﺎﻭﻯ ( 2/480 ) .
যে ব্যক্তি হাল্লাজের এ'তেক্বাদ-বিশ্বাসের মত এ'তেক্বাদ রাখবে,যে এ'তেক্বাদের দরুন হাল্লাজের ফাসি হয়েছিল,সে মুসলমানদের ঐক্যমতে কাফির,মুরতাদ,কেননা মুসলমানগণ তাকে খোদায়ী দাবী ও মানব শরীরে খোদা প্রবিষ্ট হওয়ার আক্বিদা-বিশ্বাস সহ আরোও নানাবিধ যিনদিকানা কথাবার্তা দরুন মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল,যেমনঃ- হাল্লাজের দাবীসমূহের মধ্যে একটি হল ﺃَﻧَﺎ ﺍﻟﻠَّﻪ(আমিই খোদা)এবং ﺇﻟَﻪٌ ﻓِﻲ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀِ ﻭَﺇِﻟَﻪٌ ﻓِﻲ ﺍﻷَﺭْﺽ(আকাশে এক খোদা ও জমিনে এক খোদা) জাদুর প্রভাবে অস্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা রাখত হাল্লাজ,জাদু বিদ্যায় তার লিখিত বই ও রয়েছে,
মোদ্দা কথাঃউলামাদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই যে যে, ব্যক্তি মানুষের মধ্যে খোদা প্রবিষ্ট হওয়ার ধারণা পোষণ করবে এবং মানুষকে খোদা মনে করবে,সে কাফির,মুরতাদ,তার রক্তর কোনো মূল্য থাকবে না,এবং এ প্রকারেই ছিল হাল্লাজের মৃত্যু।(মাজমু'উল ফাতাওয়া ২/৪৮০)
তিনি আরও বলেন,
ﻭﻗﺎﻝ ﺃﻳﻀﺎً : ( ﻭَﻣَﺎ ﻧَﻌْﻠَﻢُ ﺃَﺣَﺪًﺍ ﻣِﻦْ ﺃَﺋِﻤَّﺔِ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴﻦَ ﺫَﻛَﺮَ ﺍﻟْﺤَﻼﺝَ ﺑِﺨَﻴْﺮِ ﻻ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﻌُﻠَﻤَﺎﺀِ ﻭَﻻ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﻤَﺸَﺎﻳِﺦِ ; ﻭَﻟَﻜِﻦَّ ﺑَﻌْﺾَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻳَﻘِﻒُ ﻓِﻴﻪِ ; ﻷَﻧَّﻪُ ﻟَﻢْ ﻳَﻌْﺮِﻑْ ﺃَﻣْﺮَﻩُ ) . ﺍﻫـ ﻣﺠﻤﻮﻉ ﺍﻟﻔﺘﺎﻭﻯ ( 2/483 )
আমি কোনো ইমাম বা ইসলামি গভীর জ্ঞানের পন্ডিতকে দেখিনি হাল্লাজকে শ্রদ্ধা ও দু'আর সাথে স্বরুণ করতে,এবং দেখিনি কোনো আলেম বা মাশায়েখকে,বরং কিছু লোক তার সম্পর্কে বাস্তবতা না জানার দরুন নিরবতা পালন করতে দেখেছি।
(২)অপরদিকে যারা হাল্লাজের মন-মস্তিষ্ককে ভালভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন, তারা হাল্লাজকে গোমরা বা পথভ্রষ্ট মনে করেননি বরং তারা হাল্লাজকে মহান আল্লাহর প্রেমে পাগল এক দেওয়ানা ও সুফি ভাবতেন,এবং তারা মনে করেন হাল্লাজ মহান আল্লাহর মা'রেফাতের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া এক উদভ্রান্ত পথিক যিনি নিজেকে কখনো আল্লাহ মনে করতেন না বা তার এ ধারণা-বিশ্বাসও ছিলনা যে,আল্লাহ মানব শরীরে এসে প্রবিষ্ট হন বা তিনি নিজেই খোদা,বরং উনার আক্বিদা ঠিকই ছিল,যদিও কিছু শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়েছিল, কিন্তু এই শব্দাবলী দ্বারা তিনি অন্যকিছু উদ্দেশ্য নিয়েছিলেন,
যা তৎকালিন সময়ে প্রায় অনেক জনসাধারণ-ই বুঝতে পেরেছিলেন,কেননা তার মৃত্যুর পর মানুষদের মধ্যে মতবিরোধ চলছিল,তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া সঠিক ছিল কি না এ নিয়ে,এবং ইবনে ক্বাসিরের আলোচনা থেকে এ মতবিরোধের বিষয়টাই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হচ্ছে।
এ মতের পক্ষে ছিলেন,হাফিজ , আত্তার , সানাই , রুমি ও জুনাইদ বাগদাদী সহ আরোও কিছু সুফি দরবেশ।
হাল্লাজ সম্পর্কে প্রচলিত কিছু কবিতা শুনা যায়,
گفت منصور انا الحق گشت مست *
گفت فرعون انا الحق گشت پست
মনসুর হাল্লাজ আনাল হক্ব(আমিই খোদা)বলে (রহমতের সাগরে)নিমজ্জিত হয়েছিলেন*
এবং ফেরাউন আনাল হক্ব বলে অধঃপতনে গিয়েছিল।
ایی انارا رحمت اللہ در وفا*
آی انارا لعنت اللہ در قفا
মনসুর এর আনাল হক্বের মধ্যে আল্লাহর রহমত আছে*
আর ফেরাউনের আনাল হক্বের পেছনে আল্লাহর লা'নত রয়েছে।
(জজবায়ে মা'রিফত পৃঃ৯২)