বিসমিহি তা'আলা
বিচারকের বিচারকার্য সম্পাদনা ফেকহী দৃষ্টিকোণে সর্বমোট পাঁচ প্রকারঃ-
যেমনঃফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াতে বর্ণিত রয়েছে........
وَالْقَضَاءُ عَلَى خَمْسَةِ أَوْجُهٍ.
وَاجِبٍ، وَهُوَ أَنْ يَتَعَيَّنَ لَهُ وَلَا يُوجَدَ مَنْ يَصْلُحُ غَيْرُهُ.
১/ওয়াজিব।
বিজ্ঞ বিচারকের জন্য বিচারকার্য সম্পাদন করা ঐ সময় ওয়াজিব হয়ে যায়,যখন বিচারক হিসেবে সেই এখানে একমাত্র যোগ্য থাকে এছাড়া আর অন্য কেউ নাথাকে।
وَمُسْتَحَبٍّ، وَهُوَ أَنْ يُوجَدَ مَنْ يَصْلُحُ لَكِنَّهُ هُوَ أَصْلَحُ وَأَقْوَمُ بِهِ.
২/মুস্তাহাব।
এবং ঐ সময় মুস্তাহাব হবে যখন যোগ্য অন্যরাও থাকবে কিন্তু সে অন্যান্যদের থেকে যোগ্যতায় অগ্রগামী থাকবে।।
وَمُخَيَّرٍ فِيهِ، وَهُوَ أَنْ يَسْتَوِيَ هُوَ وَغَيْرُهُ فِي الصَّلَاحِيَّةِ، وَالْقِيَامِ بِهِ، وَهُوَ مُخَيَّرٌ إنْ شَاءَ قَبِلَهُ، وَإِنْ شَاءَ لَا.
৩/মুবাহ(ইচ্ছাধীন)।
ঐ সময় মুবাহ হবে যখন সে এবং অন্যান্যরা যোগ্যতা বিবচনায় প্রায় সমান সমান থাকবে,তখন বিচারকার্য সম্পাদন করা তার ইচ্ছাস্বাধীন হবে, অর্থাৎ সে বিচার করতেও পারবে আবার না করতেও পারবে।
وَمَكْرُوهٍ، وَهُوَ أَنْ يَكُونَ صَالِحًا لِلْقَضَاءِ لَكِنَّ غَيْرَهُ أَصْلَحُ.
৪/মাকরুহ।
ঐ সময় মাকরুহ হবে যখন উক্ত ব্যক্তি যোগ্যতাসম্পন্ন হবে কিন্তু তার চেয়ে বেশী যোগ্যতাসম্পন্নন সেখানে বর্তমান থাকবে।
وَحَرَامٍ، وَهُوَ أَنْ يَعْلَمَ مِنْ نَفْسِهِ الْعَجْزَ عَنْهُ وَعَدَمَ الْإِنْصَافِ فِيهِ لِمَا يَعْلَمُ مِنْ بَاطِنِهِ مِنْ اتِّبَاعِ الْهَوَى مَا لَا يَعْرِفُونَهُ فَيَحْرُمُ عَلَيْهِ كَذَا فِي خِزَانَةِ الْمُفْتِين
৫/হারাম।
ঐ সময় হারাম হবে যখন উক্ত বিচারক নিজের অযোগ্যতা ও অপারগতা সম্পর্কে অবগত,সাথে সাথে নিজের পক্ষ্য থেকে অন্যায়-অবিচারের প্রবল সম্ভাবনা তার মধ্যে বিদ্যমান,কেননা সে যে প্রবৃত্তির গোলাম একথা তার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
এমতাবস্তায় বিচারকার্য পরিচালনা করা হারাম।কেননা বিচার বিভাগ প্রতিষ্টার মূল কারন-ই হল পৃথিবীতে ন্যায়কে বাস্তবায়িত করা,যুলুম-নির্যাতনকে বিদায় দেয়া।
মুফতী শফী রাহ. বলেনঃ-
হুকুমত বা সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ও কারণ হল নিম্নরূপ,
(ক)সমস্ত জনগণের মধ্যে ন্যায়বোধ ও সাম্যবোধ এবং ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে দেয়া ও তাদের মধ্যে এগুলো অর্জনের প্রতি আগ্রহেরর জন্ম দেয়া।
(খ)রাষ্ট্রকে ভিতর-বাহির সমস্ত চক্রান্ত থেকে হিফাজত করা।
(গ)মুসলমানের জন্য নামায প্রতিষ্টা ও যাকাত উসুলের ব্যবস্থা করা।
(ঘ)জনগণের অন্তরে ভালো ও সুন্দর পথ ও মতের আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং খারাপ ও অনৈতিকতা থেকে বধাপ্রদানের সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
যেমনঃ- আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
ﻟَﻘَﺪْ ﺃَﺭْﺳَﻠْﻨَﺎ ﺭُﺳُﻠَﻨَﺎ ﺑِﺎﻟْﺒَﻴِّﻨَﺎﺕِ ﻭَﺃَﻧﺰَﻟْﻨَﺎ ﻣَﻌَﻬُﻢُ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻭَﺍﻟْﻤِﻴﺰَﺍﻥَ ﻟِﻴَﻘُﻮﻡَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﺑِﺎﻟْﻘِﺴْﻂِ ٌ
আমি আমার রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে।(সূরা হাদীদ-২৫)
ﻭَﻗَﺘَﻞَ ﺩَﺍﻭُﺩُ ﺟَﺎﻟُﻮﺕَ ﻭَﺁﺗَﺎﻩُ ﺍﻟﻠّﻪُ ﺍﻟْﻤُﻠْﻚَ ﻭَﺍﻟْﺤِﻜْﻤَﺔ
এবং দাউদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাউদকে দান করলেন রাজ্য ও অভিজ্ঞতা।
(সূরা বাক্বারা-২৫১)
তাফসীরে রুহুল মা'আনিতে বর্ণিত আছে
في هذا تنبيه علي فضيلة الملك و انه لولا ه ما استتب من العالم ،ولهذا قيل الدين والملك توأمان -ج:2-ص:174
তরজমাঃ-এই আয়াতে রাজত্ব ও হুকুমতের বিশেষত্ব বর্ণিত রয়েছে,যদি পৃথিবীতে রাজত্ব ও হুকুমত পদ্ধতি ধারাবাহিক না থাকত তবে পৃথিবীর শান্তি-শৃংখলা অনেক আগেই বিনষ্ট হয়ে যেত,এ জন্য বলা হয় যে দ্বীন এবং ধর্ম দুই জোড়াবাচ্ছা সমতুল্য ।
যেহেতু হুকুমত বা র্রাষ্ট ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে যুলুম-নির্যাতন ও ফিতনা-ফাসাদকে বন্ধ করা,এজন্য আল্লাহর তা'আলার আদত বা বিধিবদ্ধ নিয়ম হচ্ছে যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে পৃথিবীতে হুকুমত বা র্রাষ্টব্যবস্থা কুফুরীর সাথে একত্রিত হয়ে ঠিকে আছে কিন্তু কখনো যুলুম-নির্যাতনের সাথে র্রাষ্টব্যবস্থা ঠিকেনি।
এজন্য ফিরিস্তাগণ বলেছিল পৃথিবীতে মানুষগুলো খুন-খারাবী করবে,একথা বলেননি যে তারা কুফুরী করবে।কেননা র্রাষ্টব্যবস্থা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল খুন-খারাবী থেকে মানুষজনকে হেফাজত করা।
(জাওয়াহিরুল ফিকহ৫/১১)
বিচারকার্য কেমন হওয়া চাই??
ইসলামী র্রাষ্টে না কোনো কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী পাশ করা যাবে না,না বাকি রাখা যাবে, না বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া যাবে, বরং সমস্ত মুসলমানের জন্য ফরয উক্ত আইনকে বাতিল করা ও বাতিল করার জন্য আন্দোলন করা।
এ সম্পর্কে দু-একটি আয়াত লক্ষণীয়
যেমনঃ-
ﻭَﻣَﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﺤْﻜُﻢ ﺑِﻤَﺎ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻓَﺄُﻭْﻟَـﺌِﻚَ ﻫُﻢُ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮُﻭﻥ
যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।
৫সূরা মায়েদাঃআয়াতঃ৪৪
ﻭَﻣَﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﺤْﻜُﻢ ﺑِﻤَﺎ ﺃﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻓَﺄُﻭْﻟَـﺌِﻚَ ﻫُﻢُ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤُﻮﻥَ
যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।
৫সূরা মায়েদাঃআয়াতঃ৪৫
ﻭَﺃَﻥِ ﺍﺣْﻜُﻢ ﺑَﻴْﻨَﻬُﻢ ﺑِﻤَﺂ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻭَﻻَ ﺗَﺘَّﺒِﻊْ ﺃَﻫْﻮَﺍﺀﻫُﻢْ ﻭَﺍﺣْﺬَﺭْﻫُﻢْ ﺃَﻥ ﻳَﻔْﺘِﻨُﻮﻙَ ﻋَﻦ ﺑَﻌْﺾِ ﻣَﺎ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﺇِﻟَﻴْﻚَ
আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন-যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন।
৫সূরা মায়েদাঃআয়াতঃ৪৯
ﻭَﻣَﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﺤْﻜُﻢ ﺑِﻤَﺎ ﺃَﻧﺰَﻝَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻓَﺄُﻭْﻟَـﺌِﻚَ ﻫُﻢُ ﺍﻟْﻔَﺎﺳِﻘُﻮﻥَ
যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী।
৫সূরা মায়েদাঃআয়াতঃ৪৭
ﺃَﻓَﺤُﻜْﻢَ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴَّﺔِ ﻳَﺒْﻐُﻮﻥَ ﻭَﻣَﻦْ ﺃَﺣْﺴَﻦُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠّﻪِ ﺣُﻜْﻤًﺎ ﻟِّﻘَﻮْﻡٍ ﻳُﻮﻗِﻨُﻮﻥَ
তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?
৫সূরা মায়েদাঃআয়াতঃ৫০
ﻓَﻼَ ﻭَﺭَﺑِّﻚَ ﻻَ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ ﺣَﺘَّﻰَ ﻳُﺤَﻜِّﻤُﻮﻙَ ﻓِﻴﻤَﺎ ﺷَﺠَﺮَ ﺑَﻴْﻨَﻬُﻢْ ﺛُﻢَّ ﻻَ ﻳَﺠِﺪُﻭﺍْ ﻓِﻲ ﺃَﻧﻔُﺴِﻬِﻢْ ﺣَﺮَﺟًﺎ ﻣِّﻤَّﺎ ﻗَﻀَﻴْﺖَ ﻭَﻳُﺴَﻠِّﻤُﻮﺍْ ﺗَﺴْﻠِﻴﻤًﺎ
অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হূষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।
(৪সূরা নিসা-৬৫)
উপরুক্ত আয়াত সমূহে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী ফয়সালা করবে সে অবশ্যই কাফির ও ফাসিক এবং যালিম হবে।লক্ষণীয় দিক হচ্ছে,অত্র আয়াতে এটা বলা হয়নি যে,আল্লাহ তা'আলা যে সমস্ত বিধি-বিধান অবতীর্ণ করেননি সে অনুযায়ী ফায়সালাকারী কাফির, ফাসিক, যালিম হবে।তাই সাধারণত বুঝা যায় এতে এ হেকমত নিহিত রয়েছে যে, যে হুকুম আল্লাহ পাক সরাসরি অবতীর্ণ করেননি বা নবী কারীম সাঃ এর মাধমে বাস্তবায়ন ও করাননি যাতে করে পরবর্তী মানুষদের জন্য আইন প্রনয়নের অবকাশ থাকে।অর্থাৎ যে বিষয় সমূহে আল্লাহ তা'আলা বা তাঁর রাসুল সাঃ কোনো হুকুম করেননি সে বিষয় সমূহে স্থান-কাল-পাত্র বেধে পরামর্শ বিত্তিক যা ইচ্ছা তা পরবর্তীগণ আইন করতে পারবেন,তবে শর্ত হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহের মূলনীতি বা লক্ষ্য বিরোধী হতে পারবেনা।
(জাওয়াহিরুল ফিকহ ৫/১৪-১৪-১৫;)
পাকিস্তান সরকারের গ্রান্ড মুফতী-
মুফতী শফী রহ সুরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর করতে যেয়ে বলেনঃঐ সমস্ত হুকুম যা কোরআন-সুন্নাহে বর্ণিত নেই তাতে দু-রকম বিধি-বিধান রয়েছে (এক)যার সম্পর্ক দ্বীন-ইসলামের সাথে তথা শরয়ী হুকুম-আহকামের সাথে।(দুই)যার সম্পর্ক সামাজিক নিয়ম শৃংখলার সাথে।
যেই সমস্ত বিধি-বিধানের সম্পর্ক সামাজিক নিয়ম-শৃংখলার সাথে তা বাস্তবায়ন করতে কোরঅান-সুন্নাহর আলোকে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বরং যার যেটা ভালো লাগবে সে সে অনুযায়ী আমল করতে পারবে বা ফায়সালা করতে পারবে।সুতরাং এক্ষেত্রে আইনপ্রনেতা ও বিচারকগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্থান-কাল বিবেচনা করে তারা যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন।
তাফসীরে মা'রিফুল কোরআন (উর্দু ভার্সন)-২/৪৫১
উত্তর লিখনে
মুফতী ইমদাদুল হক
ইফতা বিভাগ, IOM.
পরিচালক
ইসলামিক রিচার্স কাউন্সিল বাংলাদেশ