জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
শরীয়তের বিধান অনুযায়ী পোশাক বিষয়ক কিছু নীতিমালা আছে,এই নীতিমালা মেনে যেকোনো পোশাক পরিধান করা জায়েজ আছে।
সুতরাং অপ্রচলিত পোশাক যদি সেসব নীতিমালার আওতায় পরে,তাহলে তা জায়েজ আছে।
★★তাই প্রশ্নে উল্লেখিত "বর্তমানে বাজারে আফগানী জিলবাব নামে একটি পর্দার পোষাক পাওয়া যাচ্ছে যা এদেশে প্রচলিত না।
শরীয়তের নীতিমালার বিরোধী না হলে মহিলাদের জন্য এটা পরিধান করা জায়েজ হবে।
(যেমনটি প্রশ্নে উল্লেখ রয়েছে এটি এমন পোশাকঃ যাতে এক কাপড়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকে এবং চোখও দেখা যায় না। এটা যদি আঁটোসাটো না হয়)
তাহলে এটাকে কোনোভাবেই অনুত্তম বলা যাবেনা।
এটাও সুন্নাহভিত্তিক পোশাক বলেই সাব্যস্ত হবে।
★★ইসলামী শরীয়তে পোশাক বিষয়ক নীতিমালাঃ
পোশাক মানুষের মৌলিক চাহিদা। লজ্জাস্থান আবৃত রাখা এবং সুন্দর ও পরিপাটি থাকার চাহিদা মানুষের স্বভাবজাত। তদ্রূপ শীত-গ্রীষেমর প্রকোপ ও বাইরের ধুলোবালি থেকে শরীরকে রক্ষার জন্য তা একটি প্রয়োজনীয় আবরণ। তাই পোশাক আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يا بني آدم قد انزلنا عليكم لباسا يوارى سوآتكم وريشا ولباس التقوى ذلك خير ذلك من آيت الله لعلهم يذكرون.
হে আদমের সন্তান্তসন্ততি! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দুষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্য্যেরও উপকরণ। বস’ত তাকওয়ার যে পোষাক সেটাই সর্বোত্তম। এসব আল্লাহর নির্দেশনাবলির অন্যতম। যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে।-সূরা আরাফ : ২৬
স্বভাগতভাবেই মানুষের মাঝে সতর ঢেকে রাখার প্রেরণা রয়েছে। স্বভাব ও রুচির বিকৃতি না ঘটলে এর বিপরীত হয় না। এরপরও শরীয়ত ‘সতর’ ঢাকাকে রুচি ও স্বভাবের উপর ছেড়ে দেয়নি, দ্বীনের অপরিহার্য বিধান বানিয়ে দিয়েছে। কারণ মানুষের স্বাভাবিক রুচি ও শালীনতাবোধকে সংরক্ষণ করার জন্যও সুনির্দিষ্ট নীতি ও নির্দেশনার প্রয়োজন। অন্যথায় বিভিন্নভাবে তা বিনষ্ট হতে পারে। অর্থের লালসা, খ্যাতির মোহ, প্রদর্শন-প্রিয়তা ও নির্বিচার অনুকরণ মানুষের শালীনতাবোধকেও পরিবর্তন করে দেয়। বর্তমান সমাজ এর মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।
পোষাক শুধু বাইরের বিষয় নয়, তা মনের গতিবিধিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো পোষাক মানুষকে অহংকারী করে। কোনো পোষাক বিনয় দান করে। কোনটা উশৃঙ্খল হওয়ার উসকানী দেয় আর কোনটা করে শান্ত সমাহিত। হৃদয় ও আত্মার পবিত্রতা এবং বাহ্যিক আচার-আচরণেও পোষাকের প্রভাব অনস্বীকার্য। এজন্য ইসলামী শরীয়তে লেবাস-পোষাকের কিছু নীতি রয়েছে, যা অনুসরণ করে মানুষ পোষাকের কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং পোষাকের অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে পারে।
এ ধরনের কিছু মূলনীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল :
১. সতর আবৃত করা
লেবাস অবশ্যই সতর-আবৃতকারী হতে হবে। কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতের ‘যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে’ বাক্যাংশে এই মুলনীতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়,পোষাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সতর ঢাকা।
ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযে সতর ঢাকা ফরয়। পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর মুখমণ্ডল, টাখনু পর্যন্ত পা ও কব্জি পর্যন্ত হাত ছাড়া গোটা শরীর নামাযে আবৃত রাখা ফরয। তদ্রূপ গায়রে মাহরাম ও পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডলসহ গোটা শরীর আবৃত রাখাও জরুরি। অতএব পোষাকের মাধ্যমে যাতে এই প্রয়োজন পূরণ হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য।
এত সংক্ষিপ্ত পোষাক পরিধান করা যে, সতর বা সতরের কিছু অংশ খোলা থাকে বা এত পাতলা কাপড় ব্যবহার করা যে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়, পুরুষ মহিলা সবার জন্যই হারাম ও নিষিদ্ধ। তদ্রূপ এত আঁটসাঁট পোষাক, যার উপর দিয়ে শরীরের আবরণীয় অঙ্গসমূহ ফুটে ওঠে তাও বর্জনীয়। পুরুষের জন্য প্রচলিত জিন্সের প্যান্ট বা সাধারণ আঁট-সাট প্যান্ট পরিধান করা অনুচিত। উপরন’ তা পরা হয় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে, যা একটা হারাম কাজ।
পশ্চিমাদের অনুকরণে মুসলিম মহিলাদের মাঝেও যে পোষাকের প্রচলন ঘটছে তাতে প্রশ্ন জাগে যে,তাদের কাছে পোষাকের দর্শন আসলে কী? শরীর আবৃত করা, না কিছু অংশ আবৃত করে বাকি অংশ আরো প্রকাশিত করা। পোষাকের হাতা, আঁচল দিন দিন সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কাঁধ ও গলার পরিধি প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ যত দিন যাচ্ছে পোষাক অধিকার হারাচ্ছে শরীরের উপর থেকে। ভেবে দেখা উচিত,ডারউইনপন্থী পশ্চিমা সভ্যতা যদি তার আদি অবস্থায় ফিরে যেতে চায় আমরাও কি তা চাইতে পারি?
প্যান্ট-শার্ট-টাই কখনো এদেশীয় পোষাক ছিল না। এটা ইউরোপ থেকে আমদানি হয়েছে। শরীয়তের নীতিমালার বিচারেও তা উত্তীর্ণ নয়। সুতরাং একজন আত্মমর্যাদাবান মুসলিম হিসেবে এই বেশ পরিহার করা উচিত।
২. সৃষ্টি-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া
পুরুষের পোষাক পুরুষোচিত আর নারীর পোষাক নারীর উপযোগী হওয়া কাম্য। স্বভাবগতভাবেই পুরুষকে শক্তি ও দৃঢ়তা দেওয়া হয়েছে। কারণ তার কর্মক্ষেত্র হল বাইরের পৃথিবী। তাই কোমল ও বর্ণিল সাজসজ্জা পুরুষের প্রকৃতি ও দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পক্ষান্তরে নারীকে আল্লাহ তাআলা দান করেছেন কোমলতা ও কমনীয়তা। মাতৃত্বের মমতা ও নারীত্বের লাজ- নম্রতাই হচ্ছে নারীর স্বভাব-সৌন্দর্য। পোষাকের বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা নর-নারীর সৃষ্টি-প্রকৃতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইসলামে রেশমের পোষাক পুরুষের জন্য নিষেধ, কিন্তু নারীর জন্য অনুমোদিত। স্বর্ণের ব্যবহার নারীর জন্য জায়েয, কিন্তু পুরুষের জন্য হারাম। যেকোনো রংয়ের কাপড় নারীরা পরিধান করতে পারে, কিন্তুপুরুষের জন্য কিছু কিছু রং অপছন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে কিছু হাদীস উল্লেখ করা হল :
১.
তোমরা রেশমের কাপড় পরিধান করা না। কেননা , যে ব্যক্তি দুনিয়াতে রেশম পরিধান করবে সে আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৮৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৬৯/১১
২.
আমার উম্মতের পুরুষের জন্য রেশমের পোষাক ও স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে আর তা হালাল করা হয়েছে মহিলাদের জন্য।-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ১৭২০
৩.
তোমরা সাদা কাপড় পরিধান কর। কেননা তা তোমাদের উত্তম কাপড়ের অন্যতম আর তাতেই তোমাদের মৃতদেরকে কাফন দাও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৫৫
৩.
নারী-পুরুষ একে অন্যের সাদৃশ্য গ্রহণ নিষিদ্ধ
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে অত্যন্ত কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর বেশধারণকারী পুরুষের উপর আর পুরুষের বেশধারণকারিনী নারীর উপর লানত করেছেন।-বুখারী, হাদীস : ৩৮৮৫
বেশ ধারণ করার অন্যতম মাধ্যম হল পোষাক। অতএব নারীর জন্য পুরুষের পোষাক পরিধান করা আর পুরুষের জন্য নারীর পোষাক পরিধান করা হারাম ও কবীরা গুনাহ।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, নারীর পোষাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোষাক পরিধানকারী নারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন।-আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৯২
আজকাল অনেক নারীকে তো প্যান্ট ও টি-শার্টও পরতে দেখা যায়। এসব যে কেবল পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণের কারণেই হারাম তা নয়, নির্লজ্জতা, পর্দাহীনতা আর বিজাতির সামঞ্জস্যগ্রহণ ইত্যাদি বহু কারণেই তা হারাম ও কবীরা গুনাহ। কোনো কোনো সময় পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন মুসলিমদেশের নারীদের ছবি দেখা যায়, যাদের মাথায় ওড়না, কিন্তু শরীরে ইউরোপীয় সাজ। বলাবাহুল্য, এটা ইসলামী আদর্শের প্রতিনিধিত্ব নয়।
৪.ইসরাফ ও অপচয় থেকে বিরত থাকা উচিত
‘ইসরাফ’ বা অপচয় সর্বক্ষেত্রেই নিন্দনীয়। পোষাক-পরিচ্ছদের বিষয়েও তা প্রযোজ্য। বিলাসিতা বা ফুটানির জন্য কিংবা শুধু শখের বসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোষাক ক্রয় করা অথবা সীমাতিরিক্ত উচ্চমূল্যের পোষাক ক্রয় করা ইসলামে নিষেধ। বিশেষ বিশেষ সময়ে পরিধানের জন্য কিছুটা মূল্যবান পোষাক থাকা দুষণীয় নয়, তবে তা কখনো ইসরাফের আওতাভুক্ত না হওয়া চাই।
তদ্রূপ কৃপণতাও কাম্য নয়। আবুল আহওয়াস তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলাম। তখন আমার পরনে ছিল অতি নিম্নমানের পোষাক। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি সম্পদ আছে? আমি বললাম, জ্বি হ্যাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী সম্পদ আছে? আমি বললাম, সবধরনের সম্পদই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন্তউট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, গোলাম ইত্যাদি। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, ‘যখন আল্লাহ তাআলা তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন তখন তোমার উপর তাঁর নেয়ামতের ছাপ থাকা চাই।’-আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৫৭; নাসাঈ, হাদীস : ৫২৯৪
মোটকথা, অপচয় বা কৃপণতা কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়, প্রয়োজন ও সামর্থ্যের মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে লেবাস-পোষাক ব্যবহার করাই ইসলামের নির্দেশনা।
৫. অহংকার ও প্রদর্শনের মানসিকতা থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য
অহংকার ও লোকদেখানোর মানসিকতা সর্বাবস্থায় ও সকল কাজেই পরিত্যাজ্য। লেবাস-পোষাকের মাধ্যমেও যেন এই ব্যাধি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও হাদীস শরীফে সতর্ক করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না (রাগান্বিত থাকবেন)।-বুখারী, হাদীস : ৫৭৯১; মুসলিম, হাদীস : ২০৮৫/৪৪
জাহেলি যুগের অহংকারী লোকেরা মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলত। আমাদের সমাজেও অনেককে লুঙ্গি, প্যান্ট ইত্যাদি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরতে দেখা যায়। অহংকারবশত হয়ে থাকলে এটা মারাত্মক কবীরা গুনাহ আর শুধু অভ্যাস বা রেওয়াজের কারণে হলেও নাজায়েয। অতএব সর্বাবস্থায় তা পরিত্যাজ্য।
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, লুঙ্গির যে অংশ টাখনুর নিচে যাবে তা (অর্থাৎ টাখনুর নিচের সেই স্থান) জাহান্নামে জ্বলবে।-বুখারী, হা. : ৫৭৮৭
মানুষকে দেখানোর জন্য বা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুব জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক বা ব্যতিক্রমী পোষাক পরিধান করাও শরীয়তে নিষেধ। ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির (উদ্দেশ্যে) পোষাক পরিধান করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোষাক পরিধান করাবেন।-আবু দাউদ,হাদীস : ৪০২৩; ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৬০৩/৩৬০৭
৬. পারিপাট্যের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করা যাবে না
পরিষ্কার ও শালীন পোষাক পরিধান করা এবং চুল ও দাড়ি পরিপাটি রাখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত ও নির্দেশনা। হাদীস শরীফে আছে, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে বসা ছিলেন, ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল, যার চুল ও দাড়ি ছিল এলোমেলো। নবীজী তাকে হাতের ইশারায় পরিপাটি হয়ে আসতে বললেন। তিনি পরিপাটি হয়ে এলেন। নবীজী তখন ইরশাদ করলেন, কেউ মাথার চুল আউলিয়ে মূর্তিমান শয়তানের মতো উপসি’ত হওয়ার চেয়ে বর্তমান বেশটি কি উত্তম নয় ।’-মুয়াত্তা মালেক ২/২৬২
সৌন্দর্যপ্রিয়তা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে লিখতে গেলে দীর্ঘ গ্রন্থ রচনা করা যাবে এবং তার একটি অধ্যায় হবে সৌন্দর্য ও পরিপাটিতার বিষয়ে ইসলামের ভারসাম্য। তাই পোষাক-পরিচ্ছদ এবং সৌন্দর্য ও পরিপাটিতার বিষয়েও ভারসাম্য রক্ষা করা কর্তব্য। অন্যথায় অপচয়,অহংকার, ও প্রদর্শনপ্রিয়তার শিকার হওয়া অপরিহার্য। এখন ফ্যাশনের নামে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা দিয়ে সমাজের অনেক কল্যাণকার্যই সম্পাদন করা সম্ভব। কিন্তু শিল্প শব্দটি এমনই মোহনীয় যে,যেখানেই তা যোগ হয় তা-ই যেন সকল বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে যায়। সুতরাং ফ্যাশন যখন শিল্প তখন তাতে দোষের কী থাকতে পারে? ইসলাম মানুষকে শব্দের দ্বারা প্রতারিত না হয়ে বাস-বতার অনুগামী হওয়ার নির্দেশনা দেয় এবং প্রত্যেক বিষয়কে স্বস্থানে রাখার আদেশ করে।
৭. বিজাতির অন্ধ অনুকরণ থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য
জীবনযাত্রার সকল ক্ষেত্রেই স্বকীয়তা বজায় রাখা উচিত। কোনো আত্মমর্যাদাশীল জাতি নির্বিচার পরানুকরণের শিকার হতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাতে মোবারাকা এবং সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র জীবনী অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তাঁরা যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত কিছু বিষয় অন্যদের নিকট থেকেও গ্রহণ করেছেন। যেমন পরিখা খননের কৌশল ও পাথর নিক্ষেপকারী যন্ত্র মিনজানীক-এর ব্যবহার অন্য জাতি থেকে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু এগুলো ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত বিষয়, যাতে শরীয়ত মানুুষকে স্বাধীনতা প্রদান করেছে, তাই তা নিন্দিত অনুকরণের আওতাভুক্ত নয়। কিন্তু যেসব বিষয় তাদের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রতীক বা যেসব বিষয়ে সাদৃশ্য গ্রহণ শরীয়তের কোনো বিধান বা মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
আল্লামা ইবনে নুজাইম রাহ. বলেন, ‘আহলে কিতাবের সাথে সকল বিষয়ে সামঞ্জস্য নিন্দনীয় নয়। কেননা, আমরাও পানাহার করি ওরাও পানাহার করে। হারাম তো তা-ই, যা নিন্দিত বিষয়ে হয় এবং যাতে সামঞ্জস্যই উদ্দেশ্য থাকে।’-আলবাহরুর রায়েক
আজকাল পাশ্চাত্যের যে বেশভূষা মুসলিমসমাজে চালু হয়ে গেছে তাকে তো পোষাক বলাই মুশকিল। শুধু ইসলামী মূলনীতিই নয়, সাধারণ শালীনতাবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও এ জাতীয় পোষাক গ্রহণ করা একটি মুসীবতের বিষয়ই বটে। সামান্য চিন্তা করলেই দেখা যাবে, এমন বেশভূষা ইসলামের এক বা একাধিক নীতির সাথে বিরোধপূর্ণ।
৮. অগোছালোভাবে পোষাক পরিধান করা উচিত নয়
হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশতিমালুস সাম্মা থেকে নিষেধ করেছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৮১৯
ইশতিমালুস সামমা বলা হয় চাদরজাতীয় কোনো পোষাক পুরো শরীরে এমনভাবে পেঁচিয়ে নেওয়া যে,সহজভাবে চলাফেরা করা যায় না এবং প্রয়োজনের সময় তাড়াতাড়ি হাত বের করা যায় না। যেমন গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, শীতকালে মায়েরা শিশুদের গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘাড়ের কাছে গিঁট মেরে দেন। এভাবে কাপড় পড়া অনুচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক চাদরে ইহতিবা করতেও নিষেধ করেছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৮১৯, ৫৮২২
এখানে ইহতিবা অর্থ হল, মাটিতে দুই হাঁটু খাড়া করে বসে এক চাদরে পুরো শরীর ও দুই পা আবৃত করা। এতে উপর দিয়ে সতর দৃষ্টিগোচর হতে পারে।
তদ্রূপ লুঙ্গি পরে বিছানায় বা মাটিতে শুয়ে হাঁটুর উপর পা তুলে দিতেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। -জামউল ওসাইল শরহু শামায়িলিত তিরমিযী ১/১৭৯
কেননা, এতেও সতর খুলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
মোটকথা, এমন অগোছালো ভঙ্গিতে পোষাক পরিধান করা অনুচিত, যা আরামদায়ক নয় অথবা যাতে সতর খুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের সমাজের মজদুর শ্রেণীর অনেককে মালকোচা মারতে এবং অনেক শিক্ষিত যুবককে হাঁটুর উপরে প্যান্ট পরতে দেখা যায়, এটা যে শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয তা তো বলাই বাহুল্য।
৯. পোষাক পরিষ্কার ও পরিপাটি হওয়া চাই
এটিও নবীজীর নির্দেশ। জাবির রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এলেন এবং এক ব্যক্তির মাথার চুল এলোমেলো দেখলেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন, ‘এই লোকের কি এমন কিছু নেই, যা দিয়ে সে তার মাথা পরিপাটি করবে?’ অপর এক ব্যক্তিকে ময়লা কাপড় পরিহিত দেখে বললেন, ‘এর কাছে কি এমন কিছু নেই যা দিয়ে তার কাপড় ধৌত করবে।’-আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৫৬
হযরত সাহ্ল ইবনে হানজালিয়া রা. তিনি বলেন, (কোনো এক সফর থেকে ফেরার পথে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে লক্ষ করে ইরশাদ করলেন, তোমরা তোমাদের ভাইদের কাছে আগমন করছ। সুতরাং তোমাদের হাওদাগুলো গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোষাক পরিপাটি কর। যাতে তোমাদেরকে (সাক্ষাৎ করতে আসা) মানুষের ভিড়ে তিলকের মতো (সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন) মনে হয়। (জেনে রেখো) আল্লাহ তাআলা স্বভাবগত নোংরামি বা ইচ্ছাকৃতভাবে নোংরা থাকা,কোনোটাই পছন্দ করেন না।-আবু দাউদ, হাদীস : ৭০৮৩
রাস্তাঘাটে ও মাজার-দরগায় একশ্রেণীর মানুষ দেখা যায়, যারা অত্যন্ত নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন থাকে,আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক সুবেশী ভদ্রলোককে এদের পেছনে ঘুরতে দেখা যায়। বলা বাহুল্য, এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তদ্রূপ কোনো কোনো মানুষ অপরিচ্ছন্ন থাকাকে দ্বীনদারী মনে করে থাকে। নাউযুবিল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী রাহ. বলেন, যেসব লোক (ইসলামের) প্রশংসিত পূর্বপুরুষদেরকে বদনাম করতে বসেছে তাদেরকে সাহস করে একথাটাকে জানিয়ে দিবে যে,এলোমেলো দাড়ি, বিক্ষিপ্ত কেশ আর বেঢংগা লেবাস পোষাককে যে তারা ধর্মীয় সূরত সাব্যস্তকরছেন, ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে তা ছিল বেদ্বীনীর আলামত।-ইসলামী মাআশিয়াত ২৩
১০. পোষাক পরিধান করে আল্লাহর শোকরগোযারী করা চাই
পোষাক যেহেতু আল্লাহ তাআলার নেয়ামত তাই তা পরিধান করে শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো নতুন কাপড় পরিধান করতেন তখন বলতেন্ত
اللهم لك الحمد، أنت كسوتني هذا، نسألك خيره وخير ما صنع له وأعوذبك من شره وشر ما صنع له
ইয়া আল্লাহ! তোমারই প্রশংসা। তুমিই আমাকে এই পোষাক পরিয়েছ। আমরা তোমার নিকট এই কাপড়ের কল্যান (যথা, টেকসই হওয়া, প্রয়োজনে কাজে আসা) ও উপকারিতা প্রার্থনা করি এবং এর অকল্যাণ ও অপকারিতা থেকে পানাহ চাই।-তিরমিযী, হাদীস : ১৭৬৭
পোষাকের উপকারিতা হল, এর দ্বারা পোষাকের প্রয়োজন পূরণ হওয়া, আত্মিক ও মানসিক উন্নতি সাধিত হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও আনুগত্যের পক্ষে সহায়ক হওয়া। পক্ষান্তরে এর অপকারিতা হল, পোষাকের প্রয়োজন পূরণ না হওয়া, আত্মিক ও মানসিক অবনতি ঘটা এবং আল্লাহর নৈকট্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া।
লেবাস-পোষাকের বিষয়ে ইসলমী দর্শন ও নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুধাবন করার পর যে কোনো মুমিনই এই দুআর গভীরতা উপলব্ধি করবেন।
পোষাক শুধু বাইরের খোলস নয়, রুচি ও মানসিকতারও বার্তাবাহক। উপরন্তু আত্মিক উন্নতি বা অবনতির মাধ্যম। তাই এ বিষয়ে অবহেলা নয়, নয় গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো। সচেতনভাবে সেই লেবাসই গ্রহণ করা উচিত যা মুত্তাকী ও আল্লাহভীরু হতে সাহায্য করে। নিঃসন্দেহে সেটিই উত্তম লেবাস।