উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
(০১) মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সাহেব সহ আমাদের দেশে বেরলভী মতবাদের কিছু আলেম উলামা এবং তাদের ভক্ত মুরিদান রয়েছেন।
যাদের আকীদা গুলোর মধ্যে অনেক আকীদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা বিরোধী।
তাদের কোনো বক্তব্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদার বিরোধী,এটা যেহেতু সাধারন মানুষ বুঝতে পারবেনা।
তাই তাদের থেকে ইলেম নেওয়া ঠিক হবেনা।
★★বেরলভী মতবাদে বিশ্বাসীদের কিছু ভিত্তিহীন আকীদা
১. গায়রুল্লাহর জন্য ইলমে গায়েবের আকীদা
আহলে হকের আকীদা হচ্ছে, আলিমুল গাইব অর্থাৎ অদৃশ্য জগতের বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞাত একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তাঁর জন্য অদৃশ্য বলতে কিছুই নেই। দৃশ্য-অদৃশ্যের পার্থক্য মাখলুকের জন্য। আল্লাহ সমানভাবে আলিমুল গাইব ও আলিমুশ শাহাদাহ। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবকিছুই তাঁর কাছে প্রকাশ্য। ইলমে যাতী ও ইলমে মুহীত তথা নিজস্ব ও সর্বব্যাপী ইলম একমাত্র আল্লাহ পাকেরই। আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেউ এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়। তবে নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে অদৃশ্য জগতের বহু জ্ঞান দান করেছেন। আর নবীগণের মধ্যে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, খাতামাতুন্নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাকাম এ বিষয়ে সকলের ঊর্ধ্বে। আল্লাহ পাক তাঁকে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন সমষ্টিগতভাবে অন্য কোনো রাসূলকেও তা দান করা হয়নি। কিন্তু এরপরও এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিমুল গাইব ছিলেন বা “ভবিষ্যতে যা হবে ও অতীতে যা হয়েছে সকল বিষয়ে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। তাঁর সামনে যা ঘটত তা যেমন তিনি জানতেন, দূরের-কাছের অন্য সবকিছুই জানতেন; যা ওহী আসত তা যেমন জানতেন, যা ওহী হত না তাও তেমনি জানতেন”!! কারণ, এ তো হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর বিশেষ সিফাতের মধ্যে শরীক করা এবং কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ। কেননা কুরআনে কারীম থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে,আলিমুল গাইব একমাত্র আল্লাহ পাকেরই গুণবাচক নাম। তেমনি অসংখ্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, অতীত ও ভবিষ্যতের অনেক কিছু আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানাননি। কারণ, ঐসব বিষয় তার নবুওত ও রেসালাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। যেমন কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো আয়াত বা সূরা তাঁর কাছে ওহীরূপে আসার পূর্বে তা তাঁর জানা ছিল না। উল্লেখিত সহীহ আকীদার উপর মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ. লিখিত ‘বাওয়ারিকুল গায়েব’গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে একটি দুটি নয়, চল্লিশটি আয়াতে কারীমা অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এবং ঐ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে উপরোক্ত সহীহ আকীদার পক্ষে একশ পঞ্চাশ খানা হাদীস অনুবাদ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এই বিষয়ে হযরত মাওলানা সরফরায খান সফদার রাহ.-এর কিতাব ‘ইযালাতুর রাইব আন ইলমিল গাইব’ তো আলেমদের হাতে আছেই।
উল্লেখিত ঈমানী আকীদার সম্পূর্ণ বিপরীত বেরলভীদের আকীদা হচ্ছে- দৃশ্য-অদৃশ্য সকল কিছুর ইলম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেয়া হয়েছে। একই সাথে অতীতে যা কিছু হয়েছে ও কিয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যতে যা কিছু হবে সব বিষয়ে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন! সৃষ্টির সূচনা থেকে জান্নাত জাহান্নামে প্রবেশ পর্যন্ত সামান্যতম বিষয়ও তার জ্ঞানের বহির্ভূত ছিল না। উক্ত বাতিল আকীদা প্রচারের জন্য স্বয়ং আহমদ রেযা খান একাধিক বই লিখেছে। যেমন ‘ইম্বাউল মুস্তফা’ ও ‘আদ দাওলাতুল মাক্কিয়াহ বিল মাদ্দাতিল গাইবিয়্যাহ’। আরো দেখা যায়, প্রসিদ্ধ বেরলভী আলেম মৌলভী নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী রচিত ‘আলকালিমাতুল উল্য়া’ পৃ. ৩, ৪৩, ও ৬৩। এবং কাজী ফযল আহমদ লুধিয়ানভী রচিত ‘আনওয়ারে আফতাবে সাদাকাত’ পৃ. ১৩৭
২. হাযির-নাযির শীর্ষক আকীদা
পরিভাষায় হাযির-নাযির ঐ সত্তাকে বলে যার শক্তি ও জ্ঞান সর্বাবস্থায় সকল স্থানকে বেষ্টন করে আছে। কোনো কিছু তাঁর ইলম ও কুদরতের বাইরে নয়। তিনি সকল কিছু দেখেন। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না। এমন সত্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা । এটি অতি স্পষ্ট ও অকাট্য এবং কুরআন-হাদীসের অসংখ্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এ কারণে উল্লেখিত অর্থে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে হাযির-নাযির মনে করা সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও শিরকী আকীদা।
কিন্তু আফসোস, বেরলভীরা উল্লেখিত শিরকী আকীদার প্রবক্তা। তারা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই নয়, বুযুর্গানে দ্বীনকেও হাযির-নাযির মানে।
মশহুর বেরলভী আলেম আহমদ ইয়ার খান লিখেন,
عالم میں حاضر و ناظر کے شرعی معنی یہ ہے کہ قوت قدسیہ والا ایک ہی جگہ رہ کر تمام عالم کو اپنے کف دست کی طرح دیکھے اور دور و قریب کی آوازیں سنے یا ایک آن میں تمام عالم کو سیر کرے اور صدہا کوس پر حاجت مندوں کی حاجت روائی کرے، یہ رفتار خواہ صرف روحانی ہو یا جسم مثالی کے ساتھ ہو یا ایسی جسم سے ہو جو قبر میں مدفون ہو یا کسی جگہ موجود ہے ان سب معنے کا ثبوت بزرگان دین کے لۓ قرآن و احادیث اور اقوال علماء سے ہے. (جاء الحق ج১ ص১৩১ )
অর্থাৎ, জগতে হাযির-নাযির থাকার শরয়ী অর্থ হচ্ছে, পবিত্র শক্তির অধিকারী কোনো সত্তা একই স্থানে অবস্থান করে সমস্ত দুনিয়াকে নিজের হাতের তালুর মত দেখেন। দূরের ও কাছের সমস্ত আওয়ায শোনেন। আবার মুহূর্তের মাঝে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারেন। শত শত মাইল দূর থেকে প্রয়োজনগ্রস্তের প্রয়োজন পূরণ করেন। এ ভ্রমণ শুধু রুহানীভাবে হোক অথবা মিছালী দেহের সাথে, অথবা এমন দেহের সাথে যা কোনো কবরে সমাহিত বা কোনো স্থানে মওজুদ। হাযির-নাযিরের উল্লেখিত অর্থ কুরআন হাদীস ও উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন উক্তির মাধ্যমে বুযুর্গানে দ্বীনের জন্য প্রমাণিত। (জা-আল্ হক, আহমদ ইয়ার খান, খ. ১ পৃ. ১৩১ )
সম্মানিত পাঠক লক্ষ করুন, উল্লেখিত ভ্র্রান্ত আকীদাকে কীভাবে কুরআন হাদীস ও উলামায়ে কেরামের উক্তির উপর আরোপ করে দেওয়া হল,
سُبْحٰنَكَ هٰذَا بُهْتَانٌ عَظِیْمٌ.
৩. মোখতারে কুল শীর্ষক আকীদা
ইসলামের সুস্পষ্ট ও সর্বজন বিদিত একটি আকীদা, যার পক্ষে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণাদী ছাড়াও অনেক আয়াত ও হাদীসের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে, তা এই যে, সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর মালিক-মোখতার একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্তু বেরলভী জামাতের আকীদা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মোখতারে কুল মনে করে।
আহমদ রেযা খান লিখেছেন,
حضور ہر قسم کی حاجت روائی فرما سکتے ہیں، دنیا و آخرت کی مرادیں سب حضور کے اختیار میں ہیں. (برکات الإمداد لأهل الاستمداد ص (৮০
অর্থাৎ হুযুর সকল প্রকার প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম। দুনিয়া-আখিরাতের সকল মকসুদ ও উদ্দেশ্য তাঁরই ইখতিয়ারাধীন। -বারাকাতুল ইমদাদ লিআহলিল ইসতিমদাদ, আহমদ রেযা খান পৃ. ৮
আরো বলেছেন-
رب العزۃ جل جلالہ نے اپنے کرم کے خزانے اپنی نعمتوں کے خوان حضور کے قبضے ميں دۓ جس کو چاہیں دیں اور جس کو چاہیں نہ دیں ، کوئی حکم نافذ نہیں ہوتا مگر حضور کے دربار سے، کوئی نعمت کوئی دولت کسی کو کبھی نہیں ملتی مگر حضور کی سرکار سے صلے اللہ علیہ و سلم ( ملفوظات ج ৪ ص ৭০-৭১ )
অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী প্রভু আপন দানের ভা-ার নিআমতের খাযানা হুযুরের কব্জায় দিয়ে দিয়েছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দিবেন যাকে ইচ্ছা দিবেন না। সমস্ত ফায়সালা কার্যকর হয় একমাত্র হুযুরের দরবার থেকেই। আর যে কেউ যখনই কোনো নিআমত কোনো দৌলত পায় তা পায় হুযুরের রাজ-ফরমান থেকেই। -মালফুজাত, আহমদ রেযা খান খ. ৪ পৃ. ৭০-৭১
আহমদ রেযা খান সাহেবের উপরোক্ত বাক্যগুলো পড়–ন, এরপর কুরআনে কারীমের আয়াতসমূহের উপর চিন্তা করুন। দেখুন কুরআন কী বলে আর আহমদ রেযা খান সাহেব কী বলেন!
قُلْ اِنَّمَاۤ اَدْعُوْا رَبِّیْ وَ لَاۤ اُشْرِكُ بِهٖۤ اَحَدًا قُلْ اِنِّیْ لَاۤ اَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَّ لَا رَشَدًا قُلْ اِنِّیْ لَنْ یُّجِیْرَنِیْ مِنَ اللهِ اَحَدٌ وَّ لَنْ اَجِدَ مِنْ دُوْنِهٖ مُلْتَحَدًا اِلَّا بَلٰغًا مِّنَ اللهِ وَ رِسٰلٰتِهٖ ؕ وَ مَنْ یَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ فَاِنَّ لَهٗ نَارَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا.
বলে দাও, আমি তো কেবল আমার প্রতিপালকের ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বলুন, আমি মালিক নই তোমাদের ক্ষতি সাধনের আর না সুপথে আনয়নের। বলে দাও, আল্লাহ থেকে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না আর আমিও তাকে ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল পাব না। অবশ্য (আমাকে যে জিনিসের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তা হল) আল্লাহর পক্ষ থেকে বার্তা পৌঁছানো ও তাঁর বাণী প্রচার। কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা করলে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। যেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। -সূরা জিন (৭২) : ২০-২৩
২. قُلْ لَّا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَائِنُ الله.ِ
বলুন, আমি তোমাদের বলি না যে, আমার কাছে রয়েছে আল্লাহর ভা-ারসমূহ। -সূরা আনআম (৬) : ৫০
৩. قُلْ لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَّبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُون.َ
বলুন, আমি আমার নিজের ভাল-মন্দের মালিক নই; কিন্তু আল্লাহ যা চান। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে প্রচুর ভাল-ভাল জিনিস নিয়ে নিতাম এবং কোনো কষ্ট আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো কেবল একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা- যারা আমার কথা মানে তাদের জন্য। -সূরা আরাফ (৭) : ১৮৮
৪. اِنَّكَ لَا تَهْدِیْ مَنْ اَحْبَبْتَ وَ لٰكِنَّ اللهَ یَهْدِیْ مَنْ یَّشَاء ُوَ هُوَ اَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِیْنَ.
তুমি যাকে ভালবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন এবং তিনিই ভাল জানেন সৎপথ অনুসারীগণকে। -সূরা কাসাস (২৮) : ৫৬
বেরলভী জামাত শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই নয়, অনেক বুযুর্গানে দ্বীনকেও মোখতারে কুল ও কুন ফায়াকুনের অধিকারী মনে করে। এ প্রসঙ্গে আহমদ রেযা খানের পুত্র মুস্তফা রেযা খান লেখেন-
اولیاء میں ایک مرتبہ ہے التکوین کا جو چیز جس وقت چاہتے ہیں فورا ہو جا تی ہے ، جسے کن کہا وہی ہو گیا (شرح استمداد ص ২৮ )
অর্থাৎ আউলিয়ায়ে কেরামের একটি মাকাম হচ্ছে আসহাবে ‘তাকভীন’গণের মাকাম। তারা যখন যা ইচ্ছা করেন তৎক্ষণাত তা হয়ে যায়। যে সম্পর্কেই ‘কুন’ ‘হও’ বলেন তা-ই হয়ে যায়। -শরহে ইসতিমদাদ পৃ. ২৮
বরং খোদ আহমদ রেযা খান শায়েখ আব্দুল কাদির জিলানী রাহ. সম্পর্কে লিখেছেন-
ذی تصرف بھی ، ماذون بھی، مختار بھی
کار عالم کا مدبر بھی عبد القادر
অর্থাৎ শায়েখ আব্দুল কাদের জিলানী সৃষ্টির উপর কর্তৃত্বের অধিকারী। অনুমতি প্রাপ্ত ও ইচ্ছা-ইখতিয়ারের অধিকারী এবং জগতের কার্যাবলীর পরিচালকও। -হাদায়েকে বখশিশ, আহমদ রেযা খান ১ : ২৭
বেরলভী জামাত যেহেতু গায়রুল্লাহকে মোখতারে কুল তথা সর্বক্ষমতার অধিকারী মনে করে তাই গায়রুল্লাহকে প্রয়োজন পূরণকারী ও বিপদ-আপদ বিদূরণকারী বলেও বিশ্বাস করে, তাই তারা উপায় উপকরণের ঊর্ধ্বের বিষয়েও মৃত ও জীবিত বুযুর্গদের কাছে প্রার্থনা ও ফরিয়াদ করাকে জায়েয মনে করে, যা “إياك نستعين”-এর মধ্যে ঘোষিত‘তাওহীদুল ইসতিআনাহ’-এর পরিপন্থী স্পষ্ট র্শিক। তাদের এই শিরকী আকীদার উল্লেখ আহমদ রেযা খানের ‘আল আমনু ওয়াল উলা’ (الأمن والعلى لناعتي المصطفى بدافع البلاء) এবং মুস্তফা রেযা খানের ‘শরহে ইসতিমদাদ’ ইত্যাদি বইপত্রে রয়েছে।
৪. নূর-বাশার শীর্ষক আকীদা
কুরআনে কারীমের ঘোষণা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা এই যে, আল্লাহর রাসূল বাশার তথা মানব ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন সাইয়েদুল বাশার মানবকুল শিরোমণি। আল্লাহ পাক তাঁকে হেদায়েতের নূর ও ‘সিরাজুম মুনীর’ রূপে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু বেরলভী জনসাধারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানবসত্তার অস্বীকারকারী। তাদের আকীদা- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তাকে নূর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, যা কুরআন-হাদীসের ঘোষণার সম্পূর্ণ বিরোধী।
৫. কবর পূজা ও অন্যান্য র্শিক
বেরলভী জনসাধারণের একটি বড় অংশ মাজার পূজারী। বেরলভী সম্প্রদায়ের আলেমরা তাদের জনসাধারণকে যখন এই সবক দিয়েছে যে, প্রত্যেক বুযুর্গই হাযির-নাযির । মোখতারে কুল। হাজত পূরণকারী ও বিপদাপদ বিদূরণকারী। তখন তারা মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য ও বালা মসিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বুযুর্গানে দ্বীনের কবরে তাওয়াফ ও সেজদা কবরওয়ালার কাছে প্রার্থনা ও ফরিয়াদ, তাদের নাম জপা, গায়রুল্লাহর নামে মান্নত মানা, এবং গায়রুল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য পশু কুরবানীর মতো প্রকাশ্য শিরকী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে।
ভ্রান্ত ধ্যানধারণা
উল্লেখিত ভিত্তিহীন আকীদাগুলো ছাড়াও যে সকল ভ্রান্ত ধারণার উপর বেরলভী চিন্তা-ঘরানার ভিত্তি তন্মধ্যে শুধু একটি মৌলিক ভ্রান্তি উল্লেখ করা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে বিদআতের সংজ্ঞার তাহরীফ ও বিকৃতি। এই বিকৃতি সাধনের কারণে বেরলভী জামাতের আলেমগণ বিদআত ও কুসংস্কারের পক্ষের দলে পরিণত হয়েছেন।
খায়রুল কুরুন তথা সাহাবায়ে কেরাম তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের সোনালী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিদআতের যে সংজ্ঞা ও পরিচয় প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে, শরঈ দলীল-প্রমাণ দ্বারা যে বিষয়টি দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রমাণিত নয় এমন কিছুকে দ্বীনের হুকুম মনে করে করার নামই বিদআত। বিষয়টি আকাইদ সংক্রান্ত হোক বা ইবাদত সংক্রান্ত, অথবা ইবাদতের সময় ও পদ্ধতি সংক্রান্ত হোক, কিংবা তা হোক দ্বীনের অন্য কোনো শাখার সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয়। (দ্র. আল ই‘তিসাম, শাতেবী; আল মাদখাল, ইবনুল হাজ্জ; মেরকাত, মোল্লা আলী কারী; রাহে সুন্নাত, সরফরায খান;মুতালাআয়ে বেরলভিয়্যাত, খালেদ মাহমুদ; ইখতেলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকীম, মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানবী)
কিন্তু আহমদ রেযা খান ও তার সহযোগী মৌলভীরা এই সংজ্ঞা এভাবে বিকৃত করেছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আকীদা, ইবাদাত অথবা ইবাদাতের বিশেষ কোনো পদ্ধতি নিষিদ্ধ হওয়ার উপর কোনো আয়াত বা হাদীস না থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এমন বিষয়কে দ্বীনের হুকুম সাব্যস্ত করতে অসুবিধা নেই। এবং এটাকে বিদআত বলারও অবকাশ নেই।
[আল আমনু ওয়াল উলা, আহমদ রেযা খান, পৃ. ১৫৭-১৫৮; জা-আল হক, মুফতী আহমাদ ইয়ার খান খ. ১ পৃ. ২৩০,২৫৩, ২৫৪; ইশতেহারে আতইয়াব, মুফতী নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী পৃ. ১৯ (মুতালাআয়ে বেরলভিয়্যাত খ. ৩ পৃ. ২১৫-৩৩৮-এর মাধ্যমে)]
অথচ যা কিছু নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আয়াত বা হাদীস থাকবে তা তো হারাম বা মাকরূহে তাহরিমী হবে। বিদআত তো নিষিদ্ধ এই জন্য যে শরঈ দলীল ছাড়া একে শরীয়তের অংশ সাব্যস্ত করা হয়েছে । বেরলভী সম্প্রদায় বিদআতের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা সরাসরি হাদীসের খেলাফ। হাদীসে বর্ণিত হচ্ছে-
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ.
অর্থাৎ যে কেউ দ্বীন নয় এমন কিছুকে আমাদের এই দ্বীনে অন্তর্ভুক্ত করলে তা পরিত্যাজ্য। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭১৮
বিদআত ও কুসংস্কারের পক্ষপাত
বেরলভী উলামা মাশায়েখের প্রধান কীর্তি সম্ভবত এটাই যে, তারা দ্বীনের বিষয়ে এই নতুন নিয়ম উদ্ভাবনের মাধ্যমে (অর্থাৎ কোনো কিছু বিদআত বলার জন্য তার নিষিদ্ধতার উপর স্বতন্ত্র আয়াত বা হাদীস থাকা চাই), শরঈ প্রমাণাদীর তাহরীফ ও বিকৃতির মাধ্যমে, শরঈ উসূল ও মৌলনীতিকে পদদলিত করে এবং ভিত্তিহীন ও অবাস্তব কিছু বর্ণনার আশ্রয় নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিদআত রসম-রেওয়ায এবং মুনকার ও গর্হিত কর্মকাণ্ডের পক্ষে জোরদার ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং এগুলোকে ইলমী সনদ দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যে সমস্ত বিদআতকে তারা মুবাহ-মুসতাহসান বলে সমাজে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এখানে নিম্নে নমুনাস্বরূপ কিছু বিষয় তুলে ধরা হল।
১. ঈদে মিলাদুন্নবী নামে ইসলামে নতুন ঈদের আবিষ্কার।
২. রসমী মিলাদকেই দ্বীন মনে করা।
৩. উরস করা।
৪. মাজার পাকা করা ও তার উপর গম্বুজ নির্মাণ করা।
৫. কবরে বাতি জ্বালানো।
৬. কবরের উপর চাদর বিছানো ও ফুল ছড়ানো।
৭. মাযারে এক ধরনের মু‘তাকিফ বনে থাকা।
৮. জানাযার পরে দুআর রসম।
৯. কবরের উপরে আযান দেওয়ার রসম।
১০. আযান ও ইকামতে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলার সময় বৃদ্ধাঙ্গুল চুম্বন করে উভয় চোখে লাগানো।
১১. ঈসালে সাওয়াবের জন্য কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করে বিনিময় গ্রহণ করাকে বৈধ মনে করা।
১২. খাবার সামনে নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ফাতেহা পড়ার রসম।
১৩. আযানের পূর্বে দুরূদ ও সালামের রসম। ইত্যাদি
★তাই মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সাহেব সহ এসব বেরলভী মতবাদের কাহারো থেকে ইলেম নেওয়া সাধারণ মুসলমানদের জন্য ঠিক হবেনা।
,
(০২)
★ নবীজী সাঃ এর নাম শুনে আঙ্গুল চুম্বন বিদআত।
হাদীসের কোন গ্রহণযোগ্য কিতাবে আজানের সময় আঙ্গুল চুমু খাওয়া ও চোখে মোছা সম্পর্কিত কোন কথা বর্ণিত হয়নি।
আঙ্গুলে চুমু খাওয়া বন্ধুরা যেসব কিতাব থেকে উক্ত মাসআলাটির প্রমাণ পেশ করার চেষ্টা করে থাকেন, তা মূলত কয়েকটি। যথা-
১
কানযুল ইবাদ।
২
ফাতাওয়ায়ে সূফিয়া।
৩
কুহুস্তানী রহঃ এর লিখা জামেউর রূমূজ।
৪
কিতাবুল ফিরদাউস।
মূল উৎস এ ৪টি গ্রন্থ। যে ৪ কিতাবের রেফারেন্সে তা আনা হয়েছে, ফাতাওয়া শামী, তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ, তাফসীরে রূহুল বয়ান, আলবাহরুর রায়েক এবং জালালাইনের হাশিয়ায়।
তাহলে মূল উৎস কিন্তু ৪টিই থাকছে। পরবর্তী কিতাব তথা ফাতাওয়া শামী, মারাকিল ফালাহ ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লেখ হওয়া মানে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়। বরং মূল প্রমাণ্য উক্ত কয়েকটি কিতাবই থাকে। এবার আমরা দেখবো উপরোক্ত কিতাবগুলোতে বর্ণিত সব কথাই কি গ্রহণযোগ্য? নাকি তাহকীক করতে হবে?
কানযুল ইবাদ
كنز العباد، في شرح الأوراد
يعني: أوراد الشيخ، الأجل، محيي السنة: شهاب الدين السهروردي.
والشرح:لبعض المشايخ.في مجلد.منقول من: كتب الفتاوى، والواقعات.
وهو: شرح فارسي: بقوله.لعلي بن أحمد الغوري، الساكن بخطة: كره.
কানযুল ইবাদ ফী শরহিল আওরাদ অর্থাৎ আওরাদুশ শায়খুল আজল মুহিউস সুন্নাহ শিহাবুদ্দীন আসসাহরাওয়ার্দীর ওযীফা এবং মালফুজাত কোন বুযুর্গ ব্যক্তি লিখেছেন। যা ফাতাওয়ার কিতাব ও জীবনী গ্রন্থ থেকে নেয়া। এক খন্ডে প্রকাশিত। এটি ফার্সি ভাষায় আলী বিন আহমাদ আলগুরীর অনুবাদে প্রকাশিত। যিনি খাত্তা এলাকার বাসিন্দা। [কাশফুজ জুনুন-২/১৫১৭]
এই হল, কানযুল ইবাদ কিতাবের হালাত। কোন বুযুর্গ লিখেছেন? কোন উৎসমূল থেকে তা সংগ্রহ করেছেন? তার কিছুই জানা নেই। এমন একটি মাজহূল গ্রন্থে উদ্ধৃত বিষয় কি করে মুস্তাহাবের মত শরয়ী বিধানের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে?
ফাতাওয়া সূফিয়্যাহ
আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী রহঃ বলেনঃ
((الفتاوي الصوفيّة)) لفضل الله [بن] محمد بن أيوب، تلميذ ((جامع المضمرات)) كما نقله صاحب ((الكشف)) عن البِرْكِليّ أنّه قال: إنّها ليست من الكتب المعتبرة، فلا يجوزُ العمل بما فيها إلا إذا علمَ موافقتها للأصول.
“জামেউল মুজমারাত” গ্রন্থ প্রণেতার ছাত্র ফযল বিন মুহাম্মদ বিন আইয়্যুব এর কিতাব “ফাতাওয়া সূফিয়্যাহ” সম্পর্কে “কাশফুজ জুনুন” প্রণেতা বিরকিলিই এর বরাতে উল্লেখ করেছেনঃ নিশ্চয় এটি [ফাতাওয়া সুফিয়্যাহ] কোন গ্রহণযোগ্য কিতাব নয়। তাই এর মাঝে থাকা যেসব বিষয় উসূলে শরীয়তের সাথে না মিলে, এমন কথার উপর আমল করা যাবে না। [মুকাদ্দিমায়ে উমদাতুর রিয়ায়াহ বিহাশিয়াতি শরহিল বিকায়া-১/৫১, কাশফুজ জুনুন-২/১২২৫]
কুহুস্তানী
والقُهُسْتَانِيُّ كجارفِ سيل، وحاطب ليل خصوصاً واستناده إلى كتب الزاهديّ المعتزليّ. انتهى
আল্লামা শামী রহঃ বলেনঃ কুহুস্তানী হল, স্রোতে ভেসে যাওয়া এবং অন্ধকারে লাকড়ি সংগ্রহকারী। বিশেষ করে তিনি যখনি যাহেদ মু’তাজিলীর কিতাব থেকে কোন কথা গ্রহণ করে। [তানকীহুল ফাতাওয়াল হামিদিয়্যাহ-২/৩২৪, মুকাদ্দিমায়ে উমদাতুর রিয়ায়াহ বিহাশিয়াতি শরহিল বিকায়া-১/৪৮]
মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ কুহুস্তানী সম্পর্কে বলেনঃ
وقال على القاري المكيّ في رسالتِه: ((شم العوارض في ذم الروافض)): لقد صدقَ عصامُ الدين في حقّ القُهُسْتَانِيّ أنّه لم يكن من تلاميذ شيخ الإسلام الهَرَوي، لا من أعاليهم، ولا من أدانيهم، وإنّما كان دلاّل الكتب في زمانه، ولا كان يُعرف بالفقه وغيره بين أقرانه، ويؤيّدُه أنّه يجمعَ في ((شرحِه)) هذا بين الغث والسمين، والصحيح والضعيف من غير تحقيق وتدقيق، فهو كحاطب الليل، الجامعِ بين الرطب واليابس في الليل. انتهى.
মোল্লা আলী কারী আলমক্কী তার রিসালা “শাম্মুল আওয়ারিজ ফী জাম্মির রাওয়াফিজ” নামক গ্রন্থে লিখেনঃ ইসামুদ্দীন সাহেব কুহুস্তানীর বিষয়ে হক কথা বলেছেনঃ যে, তিনি আসলে শাইখুল ইসলাম আলহারওয়ী এর বড় ছোট কোন ছাত্রের মাঝেই অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। বরং তিনি তার সময়কালে [ফিরাক্বে বাতিলার] কিতাবের দালাল ছিলেন। তিনি তার সময়কালে ফিক্বহ বা অন্য কোন বিষয়ে প্রসিদ্ধ ছিলেন না। [ইমামুদ্দীন সাহেবের কথাটি] এ বিষয়টি আরো শক্তিশালী করে তার এই শরহে মুখতাসারুল বিকায়া [অর্থাৎ জামিউর রূমূজ] কিতাবে তাহকীক ছাড়াই গলত, সহীহ, সঠিক বেঠিক সব ধরণের কথা একত্রিত করা দেখে। তিনি যেন রাত্রের ঐ লাকড়ি একত্রকারীর মত, যে রাতের অন্ধকারে ভিজা শুকনা সব ধরণের লাকড়ি সংগ্রহ করে যায়। [মুকাদ্দিমায়ে উমদাতুর রিয়ায়াহ বিহাশিয়াতি শরহিল বিকায়া-১/৪৮]
এসব কথা জানার পরও কুহুস্তানী কিতাবের রেফারেন্স কিভাবে উপস্থাপন করে তারা?
ফাতাওয়া শামী লেখকের মন্তব্যঃ
ইবনে আবেদীন শামী রহঃ আঙ্গুল চুমু খাওয়া সংক্রান্ত দলীল কানযুল ইবাদ, ফাতাওয়া সুফিয়া, কুহুস্তানী এবং বাহরুর রায়েকের উদ্ধৃতিতে নকল করার পর উল্লেখ করেনঃ
وَذَكَرَ ذَلِكَ الْجِرَاحِيُّ وَأَطَالَ، ثُمَّ قَالَ: وَلَمْ يَصِحَّ فِي الْمَرْفُوعِ مِنْ كُلِّ هَذَا شَيْءٌ.
এসব জিরাহী ও উল্লেখ করেছেন ও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, তারপর লিখেনঃ এসবের [আঙ্গুল চুমু খেয়ে চোখে লাগানো] কোন দলীলই মারফূ নয়। [ফাতাওয়ায়ে শামী-১/৩৭০]
আঙ্গুল চুমু খেয়ে চোখে মোছার কথাগুলো যেমন ইবনে আবেদীন রহঃ উল্লেখ করছেন, তেমনি শেষে এসবের কোনটিই যে বিশুদ্ধ নয়, তাও উল্লেখ করে দিয়ে তিনি তার অবস্থান পরিস্কার করে দিয়েছেন। তারপরও ইমাম শামী রহঃ উক্ত কাজের প্রবক্তা বলা কতটা খিয়ানত তা ভাবা যায়?
জালালাইনের হাশিয়ার মন্তব্য
ويكره تقبيل الظفرين ووضعهما على العينين لانه لم يرد فيه والذى ورد فيه ليس بصحيح (تعليقات جديدة حاشية جلالين-357
আঙ্গুলের নখ চুমু দেয়া এবং চোখে লাগানো মাকরূহ। কেননা, এর কোন প্রমাণ নেই। আর যেসব বর্ণনা এর স্বপক্ষে পেশ করা হয়, এর কোন কোনটিই সঠিক নয়। [জালালাইনের হাশিয়া-৩৫৭]
কিতাবুল ফিরদাউস এবং আলমাকাসিদুল হাসানাহ!
আঙ্গুলে চুমু খাওয়া বন্ধুরা সবচে’ বেশি দলীল দিতে দেখা যায় আল্লামা সাখাবী রহঃ এর কিতাব “আলমাকাসিদুল হাসানাহ ফী বায়ানি কাছিরিম মিনাল আহাদীসিল মুশতাহারাহ আলাল আলছিনাহ” নামক গ্রন্থ থেকে। অথচ উক্ত কিতাবে যদিও অনেক বর্ণনা এ প্রসঙ্গে আনা হয়েছে। কিন্তু কোনটিই সংকলক ইমাম সাখাবী সহীহ বলেননি। বরং প্রতিটি বর্ণনাকেই অগ্রহণযোগ্য বলেছেন।
১
ذَكَرَهُ الدَّيْلَمِيُّ فِي الْفِرْدَوْسِ مِنْ حَدِيثِ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ أَنَّهُ لَمَّا سَمِعَ قول المؤذن أشهد أن محمد رَسُولُ اللَّه قَالَ هَذَا، وَقَبَّلَ بَاطِنَ الأُنْمُلَتَيْنِ السَّبَّابَتَيْنِ وَمَسَحَ عَيْنَيْهِ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ فَعَلَ مِثْلَ مَا فَعَلَ خَلِيلِي فَقَدْ حَلَّتْ عَلَيْهِ شَفَاعَتِي، ولا يصح
দায়লামী ফিরদাউস নামক কিতাবে লিখেছেন যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাঃ মুআজ্জিনের মুখ থেকে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” শুনে হুবহু তা বললেন। তারপর শাহাদত আঙ্গুলের ভিতরের অংশে চুমু খেলেন এবং উভয় চোখ মাসাহ করলেন। এ কর্ম দেখে রাসূল সাঃ বললেন, যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর অনূরূপ কাজ করবে তার জন্য সুপারিশ করা আমার উপর অপরিহার্য।
আল্লামা সাখাবী বলেনঃ এ বর্ণনা সহীহ নয়। [মাকাসিদুল হাসানাহ-৪৪০-৪৪১, বর্ণনা নং-১০১৯]
বর্ণনা আনার পর পরই আল্লামা সাখাবী রহঃ এর “বর্ণনাটি সহীহ নয়” বলে দেয়ার মাধ্যমে পরিস্কার এটি জাল। জাল বলার পরও উক্ত বর্ণনা দলীল হিসেবে কিভাবে পেশ করা হয়?
২
وكذا ما أورده أبو العباس أحمد ابن أبي بكر الرداد اليماني المتصوف في كتابه “موجبات الرحمة وعزائم المغفرة” بسند فيه مجاهيل مع انقطاعه، عن الخضر عليه السلام أنه: من قال حين يسمع المؤذن يقول أشهد أن محمد رسول اللَّه: مرحبا بحبيبي وقرة عيني محمد بن عبد اللَّه صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثم يقبل إبهاميه ويجعلهما على عينيه لم يرمد أبدا،
প্রথম বর্ণনার মত এটিও বিশুদ্ধ নয় যে, যা সূফী আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আবী বকর ইয়ামানী স্বীয় কিতাব “মুজিবাতুর রহমাহ ওয়া আজায়িমুল মাগফিরাহ” এ এমন সনদের সাথে উল্লেখ করেছেন, যাতে রয়েছে অপরিচিত লোক এবং হযরত খিজির আঃ থেকে সূত্র বিচ্ছিন্নতাও বিদ্যমান। বর্ণনাটি হল, হযরত খিজির আঃ থেকে বর্ণিত। যে ব্যক্তি মুআজ্জিনকে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলতে শুনে বলবে “মারহাবান বিহাবীবী ওয়া কুররাতা আইনী মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর তার উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলিকে চুমু খাবে, এবং তা রাখবে দুই চোখে, সে ব্যক্তির চোখ কখনো পীড়িত হবে না।
[মাকাসিদুল হাসানাহ-৪৪১, বর্ণনা নং-১০১৯]
আশা করি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আল্লামা সাখাবী যেখানে মানুষের মুখে প্রচলিত হাদীসের আলোচনায় এমন একটি বর্ণনা এনে, তা বিশুদ্ধ নয়, এতে প্রচুর অপরিচিত ব্যক্তি আছে এবং তাতে রয়েছে সূত্রবিচ্ছিন্নতা।
এরপর আল্লামা সাখাবী রহঃ আরো ৬/৭টি বর্ণনা তার আলমাকাসিদুল হাসানাহ গ্রন্থে এনেছেন। আনার পর পরিশেষে তিনি এসব বর্ণনা বিষয়ে মন্তব্য করেনঃ
ولا يصح في المرفوع من كل هذا شيء.
এখানের কোন বর্ণনাই হাদীসে মারফূ দ্বারা প্রমাণিত নয়। [আলমাকাসিদুল হাসানাহ-৪৪১, প্রকাশনী দারুল কুতুব, বাইরুত]
“হাদীসে মারফূ” দ্বারা প্রমাণিত নয় মানে কী?
তারা ইমাম সাখাবী রহঃ এর মন্তব্য “হাদীসে মারফূ দ্বারা প্রমাণিত নয়” দ্বারা সাধারণ লোকদের একটি ধোঁকা দিয়ে থাকেন। সেটি হল এই যে, তারা বলেন “ইমাম সাখাবীর মত হল, এসব বিষয় মারফূ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়, কিন্তু মাকতূ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এটি একটি জলজ্যান্ত প্রতারণা। মূলত ইমাম সাখাবী রহঃ এর উক্ত কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, উক্ত বিষয় মূলত কোন প্রকার হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত নয়। পুরোটাই বানোয়াট।
যা পরিস্কার হয়ে যায় “আলমাকাসিদুল হাসানাহ” গ্রন্থের উক্ত কথাটির টিকা দেখলেই। টিকায় মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দীক আলআজহারী আলগুমারী লিখেনঃ
وحكى الخطاب في شرح مختصره خليل حكاية أخرى غير ما هنا، وتوسع في ذلك، ولا يصح شيء من هذا في المرفوع كما قال المؤلف، بل كله مختلق موضوع. [ط الخانجي
খাত্তাব শরহে মুখতাছারাহ খলীল নামক গ্রন্থে এখানে উদ্ধৃত হয়নি এমন আরেকটি ঘটনা নকল করেছেন। আর তিনি এ বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন। অথচ এর মাঝের কোনটিই হাদীসে মারফূ দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং সব ক’টিই হল মনগড়া ও বানোয়াট। [তা’লীকে আলমাকাসিদুল হাসানাহ-৪৪১-৪৪২, মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দীক আলগুমারী]
মোল্লা আলী কারী রহঃ এর মন্তব্যঃ
মোল্লা আলী কারী রহঃ দায়লামীর “আলফিরদাউস” কিতাবের বরাতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর দিকে নিসবত করা আঙ্গুলে চুমু খাওয়া সংক্রান্ত ঘটনাটি উদ্ধৃত করার পর আল্লামা সাখাবী রহঃ এর মন্তব্য উল্লেখ করেনঃ
وقال السخاوى: لا يصح، وأورده الشيخ احمد الرداد فى كتابه موجبات الرحمة” بسند فيه مجاهيل مع انقطاعه عن الخضر عليه السلام، وكل ما يروى فى هذا فلا يصح رفعه البتة
قلت: واذا ثبت رفعه على الصديق فيكفى العمل به
সাখাবী বলেন, এটি বিশুদ্ধ নয়। আর শায়খ আহমাদ আররদাদ স্বীয় কিতাব “মুজিবাতুর রহমাহ” এ এমন সনদের সাথে উল্লেখ করেছেন, যাতে রয়েছে অপরিচিত লোক এবং হযরত খিজির আঃ পর্যন্ত সূত্র বিচ্ছিন্নতাও বিদ্যমান। এ বিষয়ে যা কিছু বর্ণিত এর কোনটিই রাসূল সাঃ এর ফরমান হওয়া প্রমাণিত নয়।
আমি বলি, যদি আবু বকর সিদ্দীক রাঃ পর্যন্ত এর সনদ সহীহ হতো, তাহলে এর উপর আমল করা সঠিক হতো। [আলমওজুআতুল কুবরা, মোল্লা আলী কারী-২১০, বর্ণনা নং-৮২৯]
কিন্তু আফসোস! এ সংক্রান্ত কোন বর্ণনাকেই মুহাদ্দিসগণ বিশুদ্ধ বলে রায় দেননি। তাই এ আমলটি একটি মনগড়া ও বানোয়াট আমলই প্রমাণিত হয়।
জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ এর বক্তব্য
الحديث اللتى رويت فى تقبيل الاناميل وجعلها على العينين عنه سماع اسمه صلى الله عليه وسلم عن المؤذن فى كلمة الشهادة كلها موضوعات (تيسير المقال للسيوطى-123)
মুআজ্জিনের মুখে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙ্গুল চুমু খাওয়া এবং তা চোখের উপর রাখা সংক্রান্ত যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সবই জাল-বানোয়াট। {তাইসীরুল মাক্বাল লিস সুয়ূতী-১২৩}
আব্দুল হাই লাক্ষ্ণেৌবী রহঃ এর মন্তব্যঃ
والحق ان تقبيل الظفرين عند سماع الاسم النبوى فى الاقامة وغيرها كلما ذكر اسمه عليه الصلاة والسلام مما لم يرد فيه خبر ولا اثر ومن قال به فهو المفترى الاكبر فهو بدعة شنيعة سيئة لا اصل لها فى كتب الشريعة ومن ادعى فعليه البيان (السعاية-1/46)
সত্য কথা হল, রাসূল সাঃ এর নাম একামত বা অন্য কোন স্থানে শুনার পর আঙ্গুল চুমু খাওয়ার ব্যাপারে না কোন হাদীসে নববী [বিশুদ্ধ সূত্র অনুপাতে] আছে, না কোন সাহাবীর আমল বা বক্তব্য [বিশুদ্ধ সূত্রে] বর্ণিত আছে। তাই যে ব্যক্তি এ আমলের প্রবক্তা, সে ব্যক্তি অনেক বড় অপবাদ আরোপকারী। তাই একাজ ঘৃণ্য ধরণের বিদআত। শরয়ী গ্রন্থাবলীতে যার কোন ভিত্তি নেই। যে এসব কথা বলে, তার উচিত [সহীহ] প্রমাণ পেশ করা। [আসসিয়ায়া-১/৪৬]
শেষ কথা
উপরের দীর্ঘ আলোচনা ও তথ্য প্রমাণ দ্বারা আশা করি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, আজানের সময় বা অন্য সময় রাসূল সাঃ এর নাম শুনে আঙ্গুলে চুমু খেয়ে চোখে মোছা সম্পর্কিত কোন বর্ণনাই সহীহ নয়। সবই মনগড়া ও বানোয়াট।
তাই এ কাজকে সুন্নত বা মুস্তাহাব মনে করা সুষ্পষ্ট বিদআত।