আইফতোয়াতে ওয়াসওয়াসা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না। ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

+4 votes
664 views
in পরিবার,বিবাহ,তালাক (Family Life,Marriage & Divorce) by (10 points)
edited by

بِسْمِ الّٰلهِ الرَّحْمٰنِ الرَحِيْمِ

আসসালামু'আলাইকুম শাইখ,

১) বিবাহে দেনমোহরের টাকার পরিমান কেমন হওয়া উচিৎ? দেনমোহর কি টাকা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে? 

২) শরীয়ত সম্মত অর্থাৎ রাসুল (সঃ) এর সুন্নাহ অনুযায়ী বিবাহ করতে চাইলে দেনমোহরের বিষয়টা বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে কেমন বা কি পরিমান হওয়া উচিৎ?

৩) দেনমোহর নির্ধারণ করবে কে? পাত্রীর বাবা মা নাকি পাত্রী নিজেই? নাকি পাত্র এবং পাত্রের পরিবার?

৪) উসুল কাকে বলে? বিয়ের সময় নাকি উসুল উল্লেখ করা লাগে? কত টাকা দিলাম আর কত বাকি রাখলাম এরকম কিছু? এটা কি শরীয়ত সম্মত?

৫) পাত্রীর পরিবার যদি বেশি পরিমাণ দেনমোহরের চাপ সৃষ্টি করে এতে করণীয় কি?

৬) অনেকে বলেন, দেনমোহর তো কাগজে কলমে থাকবে, বেশি লিখলে সমস্যা কি? আবার, এমনও বলা হয়, কাজীর চার্জ, সরকারের ট্যাক্স আছে, তাই বেশি দেনমোহর উল্লেখ করতে। এক্ষেত্রে ইসলাম কি বলে? 

৭) দেনমোহরের টাকা কখন দিতে হবে স্ত্রীকে?

৮) দেনমোহরের উদ্দেশ্য কি? অর্থাৎ, ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী কেন স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করে?

৯) আমাদের দেশে একটা ধারনা আছে যে, বেশী পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করলে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবেনা, আবার তালাক দিলেও স্ত্রী অনেক টাকা পেয়ে যাবে। কিন্তু, আমার কথা আল্লাহর হুকুম যেখানে বিয়ের দিনেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে তাহলে বেশি দেনমোহরের সাথে তালাকের সম্পর্ক কি? আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আজ এই অবস্থা কেন? "দেনমোহর নির্ধারণ" এর কষাঘাতে বিয়ে পর্যন্ত ভেঙ্গে যায়। এক্ষেত্রে আলেম সমাজ কেন এই বিষয়ে মুসলিমদের সচেতন করছে না। যেখানে আল্লাহ বিয়েকে সহজ করেছেন; আর আমরা করেছি কঠিন। শুধু বিয়ে না, অনেক ক্ষেত্রে আজ আমরা রাসুল (সঃ) এর সুন্নাহ থেকে বিমুখ হয়ে আছি। আল্লাহর হুকুম আমরা পরিপূর্ণ পালন করছি না। আমাদের এখন কি করণীয় ওস্তাদ? 

1 Answer

0 votes
by (880 points)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

উত্তর-

মুহতারাম ভাই, আপনি একসাথে অনেকগুলো বিষয় জানতে চেয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া হলো।

পবিত্র কুরআনুল কারীমে মোহর প্রদানের প্রতি গুরুত্বারোপ কের মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فما استمتعتم به منهن فاتوهن اجورهن فريضة ولا جناح عليكم فيما تراضيتم به من بعد الفريضة ان الله كان عليما حكيما

‘অতএব তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদেরকে প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা : ২৪)

واتوا النساء صدقاتهن نحلة فان طبن لكم عن شيئ منه نفسا فكلوا هنيئا مرئيا

‘এবং তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে ছেড়ে দেয় কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর।’ (সূরা নিসা : ৪)

১/ টাকার মাধ্যমে মোহর আদায় করা উত্তম। টাকা ছাড়াও দেনমোহর আদায় করা যায়। স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে যে গয়নাগাটি দেওয়া হয় মোহরের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক নেই। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে স্পষ্টভাবে বলে যে,আমি এই অলংকার মোহরস্বরূপ তোমাকে দিলাম এবং তুমি এর মালিক তাহলে সেই অলংকার মোহর হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ঐ অলংকারের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা স্ত্রীর নিকট থেকে ফেরত নেওয়া যাবে না।

২-৩/ শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নারীর আসল হক ‘মোহরে মিছল’। ঐ নারীর বংশে তার মতো অন্যান্য নারীদের সাধারণত যে মোহর নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার মোহরে মিছ্ল। যদি তার নিজের বংশে তার মতো আর কোনো নারী না থাকে,তাহলে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের নারীদের যে মোহর সাধারণত নির্ধারণ করা হয় সেটাই তার মোহরে মিছল। শরীয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী মূলত মোহরে মিছ্লের হকদার। তবে স্ত্রী নিজেই যদি সন্তুষ্টচিত্তে মোহরে মিছল হতে কম নিতে রাজি হয় অথবা স্বামী খুশি মনে মোহরে মিছল থেকে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করে তবে শরীয়তে এর অনুমতি আছে। অর্থাৎ উভয় পক্ষের সম্মতিতে মোহরে মিছল হতে কম-বেশি করেও মোহর নির্ধারণ করা যায়। এটি পাত্রপক্ষ-পাত্রিপক্ষ মিলে ঠিক করতে পারে, আবার উপযুক্ত বয়সের পাত্র-পাত্রি নিজেরাও ঠিক করতে পারে। এতে কোন শরয়ী বিধি-নিষেধ নেই। এক্ষেত্রে এমন কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই,যার বেশি মোহর ধার্য করা যায় না। তবে সর্বনিম্ন পরিমাণটি শরীয়তের নির্ধারিত। হানাফী মাযহাব মতে তা হচ্ছে দশ দিরহাম। দশ দিরহামের অর্থ,প্রায় দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রূপা। সর্বনিম্ন পরিমাণ মোহর নির্ধারিত থাকার অর্থ এই নয় যে,এত সামান্য পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তে প্রশংসনীয়;বরং উদ্দেশ্য হল,তার চেয়েও কম মোহরে স্ত্রী সম্মত হলেও শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ এর দ্বারা মোহরের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না।

৪/ উসুল মানে আদায়কৃত মোহরের পরিমাণ। আমাদের মধ্যে দুই ধরনের মোহরের প্রচলন রয়েছে। এক. মোহরে মুআজ্জাল বা নগদ মোহর। দুই. মোহরে মুয়াজ্জাল বা বাকি মোহর। শরীয়তের দৃষ্টিতে মোহরে মুআজ্জাল হল সেই মোহর,যা বিয়ে সম্পন্ন হওয়ামাত্র নগদ আদায় করা অপরিহার্য হয়ে যায়। হয়তো সে বিয়ের সময়ই তা পরিশোধ করে দিবে অথবা বিয়ের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর তা দাবি করার অধিকার আছে। মোহরে মুয়াজ্জাল বলা হয় সেই মোহরকে,যা পরিশোধের জন্য উভয় পক্ষ কোনো তারিখ নির্ধারণ করে। ঐ তারিখ আসার আগে মোহর আদায় করা স্বামীর জন্য আবশ্যকীয় নয়। স্ত্রীও সেই তারিখের আগে এই মোহর দাবি করতে পারবে না। যদি উপরোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রেখে মোহর আদায় করা হয় তাহলে তা শরীয়তসম্মত হবে।

৫/ পাত্রের সামর্থ্য বিবেচনায় মোহর নির্ধারিত হতে হবে। অধিক পরিমানে মোহর নির্ধারণ শরীয়তবিরোধী নয়। সামর্থ্যের বাইরে লোকদেখানো মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তসম্মত নয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-

হযরত ওমর রা. তাঁর খিলাফতের যুগে একবার ভাষণ দিলেন যে, কেউ যেন বিয়ে-শাদিতে বড় অংকের মোহর নির্ধারণ না করে। তখন এক মহিলা আপত্তি করে বললেন,কুরআন মজীদের এক জায়গায় তো এক কিনতার (সোনা-রূপার স্ত্তপ) মোহর দেওয়ার কথাও আছে (সূরা নিসা : ২০),যা প্রমাণ করে যে,সোনা-রূপার স্ত্তপও মোহর হতে পারে, তাহলে বড় অংকের মোহর নির্ধারণে বাধা দিচ্ছেন কেন? হযরত ওমর রা. তাঁর কথা শুনে বললেন,বাস্তবেই তাঁর দলীল সঠিক। অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা ঠিক নয়। এর অর্থ হল, যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্য না থাকে এবং মোহর আদায় করার ইচ্ছা ও সামর্থ্যও থাকে তবে অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা জায়েয। আর যদি কোনো একটি শর্তও অনুপস্থিত থাকে তবে সেক্ষেত্রে অত্যধিক মোহর নির্ধারণ করা জায়েয নয়।

৬/ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, এ ধরণের উদ্দেশ্যে অধিক মোহর নির্ধারণ করা শরীয়তসম্মত নয়।

৭/  বিয়ের সাথে সাথেই মোহর আদায় করে দেওয়া উচিত। তবে যদি অনিবার্য কারণে ঐ সময় তা আদায় করা সম্ভব না হয় তাহলে কখন আদায় করা হবে তার মেয়াদ নির্ধারিত করে নিতে হবে। কিন্তু এভাবে পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ না করে শুধু মৌখিকভাবে বা কাগজে-কলমে মোহর নির্ধারণ করে সারা জীবন আদায় না করা, বা স্ত্রীর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেওয়া, কিংবা আদায় না করে স্ত্রীর দেনা কাঁধে নিয়ে মৃত্যুবরণ করা শুধু যে ইসলামের বিধানে কঠিন অন্যায় তা-ই নয়; নিতান্ত হীন ও কাপুরুষোচিত কাজও বটে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাসম্ভব আকদের সময়ই মোহর পরিশোধ করার, অন্তত কিছু অংশ আদায় করার তাকীদ করেছেন। এক সাহাবী বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলে নবীজী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘মোহর আদায় করার জন্য তোমার কাছে কী আছে?’ তিনি কিছুই নেই জানালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যাও একটি লোহার আংটি হলেও যোগাড় কর! (সহীহ বুখারী ) এ থেকে মোহরের গুরুত্ব ও নগদ আদায়ের তাগিদ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

৮/ মোহর মূলত একটি সম্মানী যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে,যার মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে,তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে,নারী নিজেকে স্বামীর হাতে বিক্রি করে দিয়েছে। তেমনি এ শুধু কথার কথাও নয়, যা শুধু ধার্য করা হয়,পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে নয়;বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দিবে,যা তাকে সম্মানিত করে। এজন্য শরীয়তের মেজায হচ্ছে, মোহর এত অল্পও নির্ধারণ না করা,যাতে মর্যাদার কোনো ইঙ্গিত থাকে না। আবার এত অধিকও নির্ধারণ না করা,যা পরিশোধ করা স্বামীর পক্ষে সম্ভব হয় না।

৯/ এটা সম্পূর্ণ বৈবাহিক উদ্দেশ্য ও শরীয়তবিরোধী চিন্তা। এটা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। নিজে বেঁচে থাকতে হবে এবং পরিবার-পরিজনকে বুঝিয়ে তা থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে একজন হক্কানী আলেমের কাছে নিয়ে গিয়ে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

(সূত্র : আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৪০-১৪৬; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ১/৩৮৪-৩৯০; তাফসীরে উছমানী পৃ. ১০৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১০৫; সুনানে নাসায়ী ৬/১১৬,১১৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১০৭; সুনানে নাসায়ী ৬/১১৯)

উত্তর প্রদান-

মুফতী মুহাম্মাদ মাহবুবুল হাসান

ফাতওয়া বিভাগ, IOM

by (10 points)
অনেক কিছুই জানলাম ওস্তাদ। ﺟَﺰَﺍﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﻴﺮً

আই ফতোয়া  ওয়েবসাইট বাংলাদেশের অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য ফতোয়া বিষয়ক সাইট। যেটি IOM এর ইফতা বিভাগ দ্বারা পরিচালিত।  যেকোন প্রশ্ন করার আগে আপনার প্রশ্নটি সার্চ বক্সে লিখে সার্চ করে দেখুন। উত্তর না পেলে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ ৪ টি প্রশ্ন করতে পারবেন। এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আমাদের ফেসবুকেও শেয়ার করা হবে। তাই প্রশ্ন করার সময় সুন্দর ও সাবলীল ভাষা ব্যবহার করুন।

বি.দ্র: প্রশ্ন করা ও ইলম অর্জনের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো সরাসরি মুফতি সাহেবের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা যেখানে প্রশ্নকারীর প্রশ্ন বিস্তারিত জানার ও বোঝার সুযোগ থাকে। যাদের এই ধরণের সুযোগ কম তাদের জন্য এই সাইট। প্রশ্নকারীর প্রশ্নের অস্পষ্টতার কারনে ও কিছু বিষয়ে কোরআন ও হাদীসের একাধিক বর্ণনার কারনে অনেক সময় কিছু উত্তরে ভিন্নতা আসতে পারে। তাই কোনো বড় সিদ্ধান্ত এই সাইটের উপর ভিত্তি করে না নিয়ে বরং সরাসরি স্থানীয় মুফতি সাহেবদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

Related questions

...