উরফ মানে যাহা সমাজে প্রচলিত।
উরফ হলো সেই বিষয় যে বিষয়টি সমাজে প্রচলিত, জন কল্যাণের জন্য অধিকতর উপযোগী এবং যে বিষয় গুলি নতুন নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে।
যাহা শরীয়তের কোনো বিরোধী নয় এরকম ভাবে কোন রায় দেওয়া কে উরফ বলা হয়, মোট কথা সাধারন মানুষের কার্যাবলীর উপর বর্তমান পরিস্থিতির রায় দেওয়া কে উরফ বলা হয়।
উরফ ২ প্রকার
১ উরফে সহীহ যা নস বা কোরান হাদীসের পরিপন্থী নয় এবং ২ উরফে ফাসিদ যা নস এর পরিপন্থী।
الثابت بالعرف کالثابت بالنص۔ (رسم المفتي: ۲۵)
সারমর্মঃ
যেটি উরফ দ্বারা প্রমানীত, সেটি নস দ্বারা প্রমানীত এর মতোই।
فی شرح المجلۃ: العادۃ محکمۃ یعنی ان العادۃ عامۃ کانت او خاصۃ تجعل حکما لاثبات حکم شرعی… واعلم انہ یرجع فی مسائل کثیرۃالی العرف والعادۃ حتی جعلوا ذلک اصلا۔ (شرح المجلۃ ۱:۷۸،۷۹ المادۃ: ۳۶)
সারমর্মঃ
সমাজের রীতি মুহকাম তথা সমাজের রীতি নীতি চাই তাহা ব্যপক হোক বা নির্দিষ্ট হোক,সেটাকে হুকুম ধরা হবে শরীয়তের হুকুম প্রমান করার জন্য ।
وقال العلامۃ ابن نجیم: العادۃ محکمۃ… واعلم ان اعتبار العادۃ والعرف یرجع الیہ فی الفقہ فی مسائل کثیرۃ حتی جعلوا ذلک اصلا۔
(الاشباہ والنظائر مع شرحہ للحموی ۱:۲۹۵ القاعدۃ السادسۃ، العادۃ محکمۃ)
সারমর্মঃ
উরফের গ্রহনযোগ্যতা আছে,এটি ফিকহের ক্ষেত্রে অনেক মাস'য়ালার দিকে ফিরে।
এমনকি এটাকে আছল হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
★উরফে ছহীহ প্রমান হওয়ার ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামদের ইজমা আছে।
উরফ সংক্রান্ত ইসলামী স্কলারদের মত হলোঃ
والعرف نوعان: عرف صحيح، وعرف فاسد.
فالعرف الصحيح: هو ما تعارفه الناس، ولا يخالف دليلاً شرعيا ، ولا يُحِل محرماً ، ولا يبطل واجباً، كتعارف الناس على عقد الاستصناع، وتعارفهم على تقسيم المهر إلى مقدم ومؤخر.
وأما العرف الفاسد: فهو ما تعارفه الناس ، ولكنه يخالف الشرع ، أو يحل المحرم ، أو يبطل الواجب، مثل تعارف الناس كثيرا من المنكرات في الموالد والمآتم، وتعارفهم أكل الربا ، وعقود المقامرة.
فالعرف الصحيح يجب مراعاته في التشريع وفي القضاء، وعلى المجتهد مراعاته في اجتهاده ؛ وعلى القاضي مراعاته في قضائه؛ لأن ما تعارفه الناس ، وما ساروا عليه : صار من حاجاتهم، ومتفقا ومصالحهم، فما دام لا يخالف الشرع : وجبت مراعاته .
من القواعد الفقهية الكبرى التي اتفق العلماء عليها ، وتدخل في عامة أبواب الفقه ، ويتفرع عليها ما لا يحصى من المسائل ، قاعدة : "العادة محكمة" .
والعادة التي يشرع اتباعها ، أو تحكيمها ، هي ما توافر فيها شرطان :
الأول: ألا تخالف نصا شرعيا ثابتا .
الثاني: أن تكون العادة مطردة ، أما إذا اضطربت ، أو تفاوتت واختلفت : فلا تكون حجة واجبة الاتباع .
جاء في شرح التلويح على التوضيح (1 / 169): " واستعمال الناس : حجة ، يجب العمل بها "انتهى .
وجاء في القواعد الفقهية وتطبيقاتها في المذاهب الأربعة للدكتور محمد الزحيلي(1 / 323): " إنما تعتبر العادة إذا اطردت، فإذا اضطربت فلا"
সারমর্মঃ
উরফ ২ প্রকার।
এক উরফে ছহীহ, যাহা সমাজে প্রচলিত, তবে শরীয়তের দলিলের খেলাফ নয়।
হারাম কে হালাল বানিয়ে দেয়না,ওয়াজিবকে বাতিল করে দেয়না।
দুই, উরফে ফাসেদ। যাহা সমাজে প্রচলিত, তবে শরীয়তের দলিলের খেলাফ।
হারাম কে হালাল বানিয়ে দেয়,ওয়াজিবকে বাতিল করে দেয়।
,
★শরীয়তে উরফ-প্রচলন সংক্রান্ত মাওলানা মুহিউদ্দিন কাসেমী হাফিঃ লিখেছেনঃ
সামাজিক প্রচলন, রেওয়াজ, মানুষের রীতিনীতির আরবী প্রতিশব্দ হল ‘উরফ’ এবং আদত।
একটি সমাজ বা জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন রেওয়াজ ও নিয়মকানুনের নামই উরফ। কথাবার্তা, উঠাবসা, লেনদেন, কেনাবেচা ইত্যাকার বিষয়ে মানুষজনের বিভিন্ন রীতিনীতি থাকে। এ রীতিনীতির অনুসরণ করেই তারা নিত্যকার কাজকর্ম সম্পাদন করে। সুনির্দিষ্ট প্রচলন ও রেওয়াজ না থাকলে পরস্পরে বিবাদ অনিবার্য।
প্রায়শই ঝগড়া লেগে থাকবে। প্রত্যেকেই নিজের ইচ্ছেমাফিক ও নিজস্ব নীতিতে লেনদেন করতে চাইবে; অথচ অপরজন এ নীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। তখন এ লেনদেনে সে সম্মত হবে না। এভাবে বিবাদ ছড়িয়ে পড়বে। তদ্রƒপ একজনের কথা ও বাক্য অপরজন সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারবে না। যে কারণে পৃথিবীর প্রত্যেক জনগোষ্ঠী ও সমাজের মাঝেই সাধারণ কিংবা বিশেষ কিছু প্রচলন ও প্রথা রয়েছে। এসব প্রথা মেনেই তারা সমাজবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করছে। এই প্রচলন ও প্রথাই আইনের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ও ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর তাবৎ আইনেই সামাজিক প্রচলনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী আইন বা ফিকহেও এর প্রভাব ও বাস্তবতা অনস্বীকার্য। ইসলামী আইনজ্ঞ তথা ফকীহগণ এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন।
উরফের সংজ্ঞা
শাব্দিকভাবে উরফের কয়েকটি অর্থ রয়েছে। যেমন : জানাশুনা, পরিচয় লাভ করা, পছন্দনীয় কথা ও কাজ, উঁচু ও দৃষ্টিনন্দন স্থান ইত্যাদি। عَرَف يَعْرف عِرْفانا ومَعْرفة এর অর্থ, জানা ও অবগতি লাভ করা। এ শব্দ থেকেই ‘মারেফত’ শব্দ এসেছে। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী রহ. (মৃ. ৫৯৩ হি.) বলেন : عرف : المعرفة والعرفان إدراك الشيء بتفكر وتدبر لأثره
অর্থ : উরফ, মারেফত ও ইরফান বলা হয়, কোনো বস্তুর প্রভাবের কারণে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা ব্যতীত তা মেনে নেওয়া। [আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন : পৃ.]
উরফের পারিভাষিক সংজ্ঞা :
مَا اسْتَقَرَّتِ النُّفُوسُ عَلَيْهِ بِشَهَادَةِ الْعُقُول ، وَتَلَقَّتْهُ الطَّبَائِعُ بِالْقَبُول
অর্থ : যৌক্তিকতার বিচারে যে বিষয়টির মানুষের মাঝে প্রচলন ঘটে এবং মানুষের প্রকৃতিও সেটাকে গ্রহণ করে নেয়। [আত-তারীফাত লিল-জুরজানী]
অর্থাৎ পুরো মনুষ্যসমাজ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত কোনো প্রচলন। শব্দ বা বাক্যের মর্ম কিংবা অন্য যে-কোনো বিষয়েই প্রচলন থাকতে পারে।
উরফ ও আদত : শব্দ দুটি ভিন্ন হলেও মর্ম অভিন্ন। যদিও কোনো কোনো ফকীহ শব্দ দুটির মাঝে পার্থক্য রয়েছে বলে মত দিয়েছেন; কিন্তু অধিকাংশ ফকীহ ও ফকীহদের ব্যবহারে শব্দ দুটি সমার্থক। পার্থক্য থাকলেও তা অতি সামান্য; যা গুনায় আসে না।
উরফের_প্রকারভেদ
উরফ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ফুকাহায়ে কেরাম উরফকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করেছেন। সামনে আমরা এ বিষয়ে আলোকপাত করব, ইনশাল্লাহ। ফলে আলোচ্যবিষয়টি আরও স্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে আশা করি। মানুষের বক্তব্য ও কথার উদ্দিষ্ট মর্ম নির্ধারণ কিংবা মানুষের কাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করে উরফকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় :
ক. শব্দগত উরফ (الْعُرْفُ القوليُّ) কোনো শব্দ/বাক্য বা কথা বলার পর মানুষ যে অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করে এটাই শব্দগত উরফ। যেমন আমাদের দেশে কেউ ‘টাকা’ শব্দ উচ্চারণ করলে সাধারণ আমাদের বাংলাদেশীয় মুদ্রা বোঝাবে; ডলার, রিয়াল বা অন্য কোনো দেশের মুদ্রা বোঝাবে না। আরেকটি উদাহরণ, কেউ বলল : আমি অমুকের ঘরে পা রাখব না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তার ঘরে প্রবেশ করবে না। এভাবে প্রত্যেক মানুষ তার অঞ্চলের প্রচলন ও রেওয়াজ অনুযায়ীই কথা বলে। নইলে কেউ তার কথা বুঝবে না। আরেকটি উদাহরণ নেওয়া যাক, উর্দু ও হিন্দিতে অজিফা (الوظيفة) শব্দের অর্থ হল বেতন-ভাতা। কিন্তু একই শব্দ আরবি ভাষায় পদপদবির অর্থে ব্যবহৃত হয়। [আল-ফুরূক : খ.১, পৃ. ১৭১; তাহজীবুল ফুরূক বিহামিশিল ফুরূক : খ.১, পৃ. ১৮৭; শারহুত তানকীহ লিলকারাফী : পৃ. ৪৪]
খ. কর্মগত উরফ (الْعُرْفُ الْعَمَليُّ) : মানুষের লেনদেন ও কেনাবেচায় পরিচিত কোনো নিয়ম-পদ্ধতি। যেমন : ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে কোনোরূপ কথাবার্তা ব্যতীত কেবল আদান-প্রদানের মাধ্যমে বেচাকেনা করা। অগ্রিম অর্ডার দেওয়া-নেওয়া। আল্লামা শামী এ প্রকার উরফের উদাহরণ উল্লেখ করেন, কেউ বলল : আমার জন্য খাবার নিয়ে আসো। তাহলে সে অঞ্চলে প্রচলিত খাবার বুঝাবে। উদাহরণত আমাদের দেশে কেউ খাবারের কথা বললে ভাত বা রুটি বুঝাবে। জুস বা বার্গার বুঝাবে না। তদ্রƒপ কেউ গোশতের কথা বললে গরু, মুরগি বা খাশির গোশত বুঝাবে। হরিন বা দুম্বা কিংবা উটের গোশত উদ্দেশ্য হবে না। কারণ, আমাদের দেশে সাধারণত হরিন, দুম্বা ও উটের গোশত খাওয়ার প্রচলন নেই। [মাজমুআ রাসায়েলে ইবনে আবিদীন : খ.২, পৃ. ১১২]
উরফের ব্যাপকতা ও ব্যাপ্তি হিসেবে তা দু প্রকার :
ক. ব্যাপক ও সাধারণ উরফ (الْعُرْفُ الْعَام) :
পৃথিবীর সকল মানুষ কিংবা কোনো দেশের অধিকাংশ মানুষের মাঝে প্রচলিত কোনো রেওয়াজ। যথা : স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়তে বলল, তুমি আমার ওপর হারাম। এর দ্বারা তালাক হয়ে যাবে। কারণ, প্রায় সব মুসলমান এখানে ‘হারাম’ শব্দ দ্বারা তালাক মর্ম উদ্দেশ্য করে থাকেন। অর্থাৎ এ শব্দ দ্বারা স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে এ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আরেকটি উদাহরণ, পাবলিক টয়লেটে গমন করা। অথচ এখানে ভাড়া নির্ধারিত হলেও অবস্থানের সময় এবং ব্যবহৃত পানির পরিমাণ উল্লেখ থাকে না। তবুও এভাবে টয়লেটে যাওয়া এবং টয়লেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করা জায়েয। কারণ, অবস্থানের সময় ও পানি ব্যবহারের সীমা উরফ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
খ. নির্দিষ্ট ও সীমিত পরিমণ্ডলের উরফ (الْعُرْفُ الْخَاص) : বিশেষ কোনো শহর, জাতি, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের লোকজনের মাঝে প্রচলিত প্রচলন। যেমন : الصحيح (সহীহ) শব্দটি নাহু, সরফ ও উলুমুল হাদীস প্রত্যেক শাস্ত্রেই ভিন্ন ভিন্ন মর্ম প্রদান করছে। আরেকটি উদাহরণ নেওয়া যাক, আমাদের দেশে মাথা উপরে-নিচে করে ইঙ্গিত করলে সম্মতি বোঝায়; আর মাথা ডানে-বামে করা অসম্মতির লক্ষণ। কিন্তু ভারতের তামিলনাডু অঞ্চলে মাথা ডানে-বামে নাড়ালে সম্মতি বোঝায় না, অসম্মতি বোঝায়।