ওয়া আলাইকুমুস-সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
জবাবঃ-
মাও, লুৎফুর রহমান ফরায়েজী দা বা লিখেন,
ইনজেকশনের শরয়ী হুকুম বুঝতে হলে প্রথমে দু’টি বিষয় বুঝতে হবে। যথা-
১-ইনজেকশনের পদ্ধতিটি কি রোযায় কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কি না?
২-কোন উদ্দেশ্যে ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে? মাকসাদের ভিন্নতার কারণে ইনজেকশনের হুকুমে কোন ভিন্নতা আসবে কি না?
ইনজেকশনের পদ্ধতি
বিজ্ঞ ডাক্তারদের বক্তব্য ও বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা একথাই প্রমাণিত যে, ইনজেকশন কয়েকভাবে দেয়া হয়। যেমন-
ক-গোস্তে ইনজেকশন দেয়া।
খ-চামড়া ও গোস্তের মাঝামাঝি ইনজেকশন দেয়া।
গ-সরাসরি পেটে।
ঘ-অধিকাংশ সময় রগের মাঝে দেয়া হয়।
এবার ভাবার বিষয় হল-এ চার ধরণের ইনজেকশনের হুকুম কি?
এর সহজ জবাব হল-ইনজেকশন চাই রগে দেয়া হোক, যেমন সাধারণত রোগীদের দেয়া হয়, বা চামড়া বা গোস্তে দেয়া হোক, বা পেটে দেয়া হোক যেমন কুকুর কামড়ালে পেটে ইনজেকশন দেয়া হয়, এ সকল সুরতে হুকুম হল এসব কারণে রোযা ভঙ্গ হবে না।
ইনজেকশনের ব্যাপারে জমহুর ওলামাদের রায় এটাই যে, এর দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয় না। যারা এ মতের উপর ফাতওয়া দিয়েছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা
১-ইমদাদুল ফাতওয়া-২/১৪৪-১৪৭
২-ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ-৬/৪০-৪০৯
৩-ফাতওয়া রহিমিয়া-৭/২৫৭
৪-আহসানুল ফাতওয়া-৪/৪২২
৫-কিফায়াতুল মুফতী-৪/২৫৩
৬-ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া-১৫/১৭৩-১৭৯
৭-ফাতওয়ায়ে হক্কানী-৪/১৬২-১৬৩
৮-আপকি মাসায়িল আওর উনকা হল্ল-৩/২১২
৯-জাদিদ ফিক্বহী মাসায়িল-১/১২২-১২৪
১০-ফাতওয়া মুফতী মাহমুদ-৩/৪৮৮-৪৮৯
১১-কিতাবুল ফাতওয়া-৩/৩৯১-৩৯২
১২-ফাতওয়া উসমানী-২/১৮১-১৮৬
১৩-ইমদাদুল ফাতওয়া-৩/১৩৩-১৩৪
১৪-খাইরুল ফাতওয়া-৪/৭৪
ইনজেকশন দ্বারা রোযা না ভাঙ্গার কারণ
খানা খাওয়ার দ্বারা মূলত রোযা ভেঙ্গে যায়। কারণ কুরআনে পাকে খানা খাওয়াকে রোযা ভঙ্গের কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ۚ [٢:١٨٧]
আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। {সূরা বাকারা-১৮৭}
এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রোযা ভেঙ্গে যাবে খাদ্য গ্রহণ করলে। আর খাদ্য নালী দিয়ে পাকস্থলীতে খানা প্রবিষ্ট করালেই উক্ত বস্তুকে খাদ্য বলে। খাদ্য নালী ছাড়া অন্য স্থান দিয়ে পেটে বা শরীরের কোন অংশে কোন কিছু প্রবিষ্ট করালে এটাকে কেউ খাদ্য বলে না।
এ কারণে ফুক্বাহায়ে কেরাম খাদ্য নালী ছাড়া কোন কিছু পেটে বা শরীরে প্রবিষ্ট হলে এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গবে না বলে ফাতওয়া দিয়েছেন।
শরীরে কোন কিছু ঢুকলেই যদি রোযা ভেঙ্গে যেত, তাহলে ভুলবশতঃ পেট ভরে খানা খেলেও কেন রোযা ভাঙ্গে না?
এর দ্বারা বুঝা যায়, শুধুমাত্র কোন কিছু শরীরে ঢুকালেই রোযা ভেঙ্গে যায় না, বরং আল্লাহ তাআলার নির্দিষ্ট নিষিদ্ধ পদ্ধতি লংঘন করলে তার দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়। নতুবা রোযা ভঙ্গ হবে না।
আর আমরা জানি ইনজেকশন দ্বারা যেসব ওষুধ প্রবিষ্ট করানো হয়, এটা খাদ্য নালী দিয়ে প্রবিষ্ট করানো হয় না, ভিতরে ঢুকার পর খাদ্য নালী দিয়ে তা পেটেও যায় না, যদি পেটে যায়ও, তবে সেটা খাদ্য নালী দিয়ে নয়, বরং অন্য রগ দিয়ে তা ঢুকে থাকে। তাই ইনজেকশন দ্বারা রোযা ভাঙ্গা বলাটা রোযা ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
শরীরে কোন কিছু ঢুকলেই রোযা ভেঙ্গে যায় একথাটি একটি ভুল কথা। এরকম অনেক উদাহরণ আছে, যাতে শরীরে বাহির থেকে কিছু প্রবেশ করানো হয়েছে, অথচ এ কারণে রোযা ভেঙ্গে গেছে বলে ফুক্বাহারা মত দেন নি। যেমন-
ফুক্বাহায়ে কেরাম চোখে সুরমা দেয়াকে রোযা অবস্থায় জায়েজ বলেছেন। সেই সাথে যদি সুরমার প্রতিক্রিয়া হলকে অনুভূত হয়, তবুও এটা রোযা ভঙ্গের কারণ নয় বলে ফুক্বাহায়ে কেরাম মত দিয়েছেন।
কারণ চোখ থেকে সুরমাটি হলকে খাদ্য নালি দিয়ে পৌঁছেনি।
যুক্তি ও জবাব
১-
কেউ কেউ এ যুক্তি পেশ করে থাকেন যে, ইনজেকশন দ্বারাতো শরীরের মাঝে ওষুধ ঢুকার কারণে শরীরের মাঝে রোযার কষ্ট লাঘব হয়ে যায়, তাই এর দ্বারা রোযা ভঙ্গ হওয়াই উচিত।
জবাব
একথাটিও ঠিক নয়। শরীর থেকে রোযার কষ্ট দূরিভূত হওয়া যদি রোযা ভঙ্গের কারণ হয়, তাহলেতো রোযাদার গোসল করলেও শরীর থেকে রোযার কষ্ট দূর হয়, অযু করলে প্রশান্তি আসে, শরীরে তেল মালিশ করলে কষ্ট লাঘব হয়, এসব কারণে কি রোযা ভাঙ্গে? এসব কারণেতো রোযা ভাঙ্গে না। {ফাতওয়ায়ে শামী-২/৩৯৬, আন রাহরুল ফায়েক-২/১৭, তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ-৫৪৩}
প্রচন্ড গরমের কারণে রোযা অবস্থায় কাপড় ভিজিয়ে গায়ে দিয়ে ঠান্ডা অনুভূত করাটা রাসূল সাঃ ও হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে প্রমাণিত। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৩৬৭}
অথচ গায়ে পানি দিলেতো এর সিক্ততা চামড়া ভিতর খানিক প্রবেশ করে থাকে, এর দ্বারা রোযা ভেঙ্গে গেলে রাসূল সাঃ করলেন কিভাবে?
২-
ডাক্তারগণের মতামত এবং কতিপয় রোগীদের অভিজ্ঞতা হল রোযা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে শরীরের খাবারের চাহিদা পূর্ণ হয়ে যায়, তাই ইনজেকশনকে খানার স্থলাভিষিক্ত করে রোযা ভঙ্গের কারণ বলতে হবে।
জবাব
যদি তাই হয়, তাহলে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ খানার উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য উপকারী। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৭৫৭৯, মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদীস নং-২০৮২১, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৪০৪}
এর বাস্তবতাও অনেকের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহ বললে খানার চাহিদা পূর্ণ হয়, এ বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী ইনজেশনের তুলনায়, যেহেতু এটা রাসূল সাঃ এর কথা। তাই বলে কি এটা বলা হবে যে, রোযা অবস্থায় আল হামদুলিল্লাহ বা সুবহানাল্লাহ বললে রোযা ভেঙ্গে যাবে?
গীবত করাকে কুরআনে কারীম মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া সাব্যস্ত করেছে {সূরা হুজুরাত-১১}। এখন কি এটা বলা যাবে যে, গীবত করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, যেহেতু এর দ্বারা মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া হয়?
এখানে যেমন বলা হয়, এটা মৌলিকভাবে খানা খাওয়া নয়, তাই এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না, তেমনি ইনজেকশন দ্বারা খাদ্যনালী দিয়ে খাদ্য গ্রহণ হয় না, তাই এর দ্বারাও রোযা ভাঙ্গা বলাটা বোকামীসূলভ বক্তব্য।
৩-
রোযা ভঙ্গ হওয়ার মূল কারণতো হল- আল্লাহর নির্দেশ ছিল ক্ষুধার্ত থেকে মোজাহাদা করা। অথচ ইনজেকশন দ্বারা সে উদ্দেশ্য থেকে সড়ে এসে ইনজেশন নিয়ে খাদ্য গ্রহণের ফায়দা হাসিল হয়ে যায়, তাই এর দ্বারা রোযা ভঙ্গ হওয়াটাই যুক্তি সঙ্গত।
জবাব
এ যুক্তিটিও কম বুঝের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। মূল মাকসাদ অর্জিত হয়ে গেলেই আসল হুকুম সাব্যস্ত হয় না সর্বদা। যেমন-
রোযা অবস্থায় যদি কেউ স্বপ্নের মাঝে সহবাস করে তাহলে সহবাসের কাজ অর্জিত হয়ে বির্যপাত হলেও রোযা ভঙ্গ হয় না, অথচ মূল কাজতো হয়ে গেল।
কোন মহিলাকে দেখার কারণে বির্যপাত হয়ে গেলে রোযা ভঙ্গ হয় না {ফাতওয়ায়ে শামী-২/৩৯৭, আন নাহরুল ফায়েক-২/২৩}। অথচ উদ্দেশ্য হল আনন্দ করে বির্যপাত করা, সেটাতো হয়ে গেল, অথচ রোযা ভঙ্গ হয় না কেন?
কষ্টের কারণে ৮৮ কিলোমিটারের সফরের সময় ফরয নামাযকে ৪ রাকাতের স্থানে ২ রাকাত পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন যদি কোন ব্যক্তি বিমানের মাধ্যমে খুব আরামের সাথে সফর করে, যার কোন কষ্ট না হয়, তাহলে কি লোকটি কসর নামায পড়বে না? অবশ্যই পড়বে, অথচ কসরের সুযোগ দেয়া হয়েছিল কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য, সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে গেলেওতো বিধান পরিবর্তিত হচ্ছে না।
তাহলে খানার মাকসাদ আংশিক পূর্ণ হয়ে গেলেই এর দ্বারা রোযা ভঙ্গের ক্ষেত্রে কেন এত চাপাচাপি?
মৌলিক কথা হল-আল্লাহ তাআলার দেয়া বিধানাবলী যে চৌহদ্দীতে সীমাবদ্ধ করেছেন, সেটাকে সেভাবেই আমল করতে হবে, যেটার সুযোগ দিয়েছেন, সেটাকে নিজের পক্ষ থেকে যুক্তি তর্ক দিয়ে না জায়েজ বলার কোন অধিকার কারো নেই।