উপরের এই আয়াত গুলো থেকে বুঝা যায়, মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থাকেন এবং রূহ বের করার জন্য কথা বলেন, যা ইঙ্গিত করে যে মানুষ তাঁদের দেখছে।
বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত মুসনাদে আহমদে এক দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যেখানে জান কবজ করার সময় ফেরেশাদের কাজ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই ঈমানদারের যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে পরকালের পথে যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে, তখন উজ্জ্বল শুভ্র চেহারার ফেরেশতারা তাঁর কাছে নেমে আসেন। তাঁদের চেহারাগুলো যেন একেকটি সূর্য। তাঁদের সঙ্গে থাকে জান্নাতি কাফন ও জান্নাতি সুগন্ধি।তাঁরা তাঁর কাছে বসে পড়েন। তারপর মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তাঁর মাথার পাশে বসে বলেন, হে পবিত্র আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তারপর পাত্রের মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া ফোঁটার মতো তাঁর আত্মা বেরিয়ে আসে। আজরাইল (আ.) সেই আত্মাকে বরণ করে নেন। আজরাইল (আ.) হাতে নেওয়ামাত্র চোখের পলকে অন্য ফেরেশতারা সেই আত্মা নিয়ে জান্নাতি কাফনে ও জান্নাতি সুগন্ধিতে রেখে দেন। তার থেকে মেশকের চেয়ে উত্তম সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে, যা (কখনো কখনো) জমিনেও অনুভূত হয়।
আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, এরপর তাঁরা সেই আত্মা নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করতে থাকেন। যখনই কোনো ফেরেশতা পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করেন, এটা কার পবিত্র আত্মা? তাঁরা তাঁর নাম উল্লেখ করে বলেন, অমুকের ছেলে অমুক।
এভাবে তাঁরা প্রথম আসমানে পৌঁছেন। আসমানের দরজা খুলতে আহ্বান করেন। তাঁদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হয়। এভাবে সব আসমানের ফেরেশতারা পরবর্তী আসমান পর্যন্ত তাঁর অনুসরণ করে বিদায় জানান। তারপর তিনি সপ্তম আসমানে পৌঁছে যান। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দার আমলনামা ইল্লিয়্যিনে রেখে দাও এবং তাকে দুনিয়ায় ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয়ই আমি তাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তাতেই ফিরিয়ে দেব এবং তার থেকে দ্বিতীয়বার বের করে আনব।’
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন কবরে তার আত্মা ফেরত দেয়া হয়। ওখানে দু’জন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার প্রতিপালক কে? তিনি উত্তরে বলেন, আমার প্রতিপালক হচ্ছেন আল্লাহ। আবার জিজ্ঞাসা করেন, দুনিয়াতে তোমার দীন কী ছিল? তিনি উত্তর দেন, আমার দীন হচ্ছে ইসলাম। পুনরায় তাকে প্রশ্ন করেন, তোমাদের কাছে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তিনি কে? জবাবে তিনি বলেন, তিনি হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তখন ফেরেশতা দু’জন তাকে বলেন, তুমি কিভাবে ইহা জানতে পারলে? তিনি তখন বলেন, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি। অতঃপর তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি এবং সেটাকে বিশ্বাস করেছি।
তখন আকাশ থেকে মহান আল্লাহ ঘোষণা করতে থাকেন, আমার বান্দা সত্য বলেছে। তার জন্যে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও। আর তার জন্য জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও, সে যেন জান্নাতের বাতাস ও সুঘ্রাণ পেতে পারে। তার কবরটি তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেয়া হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন একজন সুন্দর আকৃতি ও উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোক উত্তম পোষাক পরিধান করে এবং সুঘ্রাণে সুরভিত হয়ে তার কাছে আগমন করেন এবং বলেন, তুমি খুশি হয়ে যাও। তোমার সাথে যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা আজ পূর্ণ করা হবে। মুমিন ব্যক্তি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেন, কে তুমি? তোমার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কোনো না কোনো সুখবর নিয়ে এসেছো। তিনি বলেন, আমি তোমার সৎ আমল। তখন মুমিন ব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহ! তুমি এখনই কিয়ামত সংঘটিত করো। আমি আমার পরিবারের সাথে মিলিত হবো। তখন তাকে বলা হয় তুমি এখানে আরামে বসবাস করতে থাক। তোমার কোনো চিন্তা ও ভয় নেই।
অপর পক্ষে কাফের ব্যক্তির যখন দুনিয়া হতে বিদায় নেয়ার সময় হয় তখন কালো বর্ণের একদল ফেরেশতা এসে উপস্থিত হয়। তাদের সাথে থাকে দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়। চোখের দৃষ্টি যতদূর যায় তারা তথায় বসে থাকে। তারপর মালাকুল মাওত এসে তার মাথার পাশে বসেন। তাকে বলেন, ওহে অপবিত্র আত্মা! বেরিয়ে আয় আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির দিকে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কাফের, মুনাফেক ও পাপিষ্ঠ লোকের আত্মা তখন দেহের মাঝে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফেরেশতা তাকে এমনভাবে টেনে বের করে যেমনিভাবে লোহার পেরেককে ভেজা পশমের মধ্য থেকে টেনে বের করা হয়। তার রূহ্ বের হওয়ার সময় শরীরের রগসমূহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। রূহ বের করার পর ফেরেশতাগণ তাকে মালাকুল মাওতের হাতে চোখের পলক পরিমাণ সময়ও রাখেন না। তারা তাকে উক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়ে রাখেন। তা থেকে মরা-পঁচা মৃত দেহের দুর্গন্ধের ন্যায় দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। ফেরেশতাগণ তাকে আকাশের দিকে উঠাতে থাকে। যেখান দিয়েই গমণ করে সেখানকার ফেরেশতাগণ জিজ্ঞাসা করেন, এ অপবিত্র আত্মা কার? উত্তরে ফেরেশতাগণ অতি মন্দ নাম উচ্চারণ করে বলতে থাকেন, অমুকের পুত্র অমুকের। দুনিয়ার আকাশে পৌঁছে তার জন্য আকাশের দরজা খুলতে বলা হলে আকাশের দরজা খোলা হয় না। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করলেন,
﴿لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ﴾
‘‘তাদের জন্য আকাশের দরজাসমূহ খোলা হবেনা এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে’’। (সূরা আ’রাফ: ৪০)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার নাম সাত যমীনের নীচে সিজ্জীনে লিখে দাও। অতঃপর তার রূহ যমীনের যেখানে দাফন করা হয়েছে সেখানে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করলেন,
﴿وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنْ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো’’। (সূরা আল হজ্জ: ৩১)
অতঃপর তার রূহকে দেহে ফেরত দেয়া হয়। তখন দু’জন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোর প্রভু কে? সে উত্তর দেয়, আফসোস! আফসোস! আমি জানি না। আবার জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের কাছে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল তার সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? সে উত্তরে বলে, হায় আফসোস! হায় আফসোস! আমি তাও জানি না। তখন আকাশ থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করেন, এ লোক মিথ্যা বলছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তার জন্য জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দাও। যাতে তার কাছে জাহান্নামের গরম বাতাস ও তাপ পৌঁছতে পারে। তার কবর অতি সংকীর্ণ করে দেয়া হয়। মাটি তাকে এমনভাবে চেপে ধরে যাতে তার এক পার্শ্বের হাড্ডী অপর পার্শ্বে ঢুকে যায়।
অতঃপর কালো চেহারা বিশিষ্ট, কালো পোষাক পরিহিত ও দুর্গন্ধযুক্ত এক ভয়ানক আকারের লোক এসে বলতে থাকে, তুই দুঃখের সংবাদ গ্রহণ কর্। ধ্বংস হোক তোর! আজ তোর সেই দিন যার অঙ্গিকার তোর সাথে করা হয়েছিল। তখন কাফের বা মুনাফেক ব্যক্তি বলে, তোমার পরিচয় কী? তোমার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কোনো দুঃখের সংবাদ নিয়ে এসেছো। উত্তরে লোকটি বলে, আমি তোর্ সেই খারাপ আমল যা তুই দুনিয়াতে করেছিলে। তখন সে বলবে, হে আল্লাহ! কিয়ামত যেন না হয়। (মুসনাদে আহমদ: ১৮৫৫৭)