বিসমিহি তা'আলা
জবাবঃ-
উলামায়ে কেরামদের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে,চুল মুন্ডানো ছয় প্রকারের হতে পারে।
প্রথম প্রকার:-
কিছুক্ষেত্রে চুল মুন্ডানো আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হয়।অর্থাৎ যার কারণে মানুষ সওয়াবের অংশীদার হয়।
এটা চার ধরণের হতে পারে।(১)হজ্জ্ব (২)উমরাহ (সূরা ফাতাহ-২৭) (৩)সাতদিনের সময় নবশিশুর চুল মুন্ডানো। (তিরমিযি-১৪৩৯)(৪) কাফির মুসলমান হওয়ার সময় চুল মুন্ডানো।(সুনানে আবু-দাউদ-৩৫৬)
দ্বিতীয় প্রকারঃ-
কিছুক্ষেত্রে চুল মুন্ডানো শিরক।যেমন অাল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে চুল মুন্ডানো। এটা তখন সেজদার মতই হয়ে যাবে।ইবনুল কাইয়্যিম রাহ বলেন- মুরিদ তার শায়েখের জন্য চুল মুন্ডানো এ প্রকারের আওতাধীন,এগুলো শিরকের পর্যায়ভুক্ত।
তৃতীয় প্রকার
কিছুক্ষেত্রে চুল মুন্ডানো বিদআত এবং মাকরুহ।
প্রথম প্রকারে বর্ণিত ক্ষেত্র সমূহ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে ইবাদত এবং দ্বীন মনে করে চুল মুন্ডানো।এটা বিদআত ও মাকরুহ। যেমন চুল মুন্ডানো কে নেককারদের আ'লামত বা দুনিয়া বিমুখের আ'লামত মনে করা।কেননা খাওয়ারিজরাই এমনটা মনে করত।এজন্য রাসূলুল্লাহ খাওয়ারিজদের আ'লামত চুল মুন্ডানোকে বলে গেছেন(মিরকাত:৩৫৪৩)।(এ সম্পর্কে অবশ্য ভিন্ন ব্যখ্যাও রয়েছে)
(মাজমুউল ফাতাওয়া-১/২৩১,শরহুল উমদাহ-২৩১)
তাছাড়া চুল মুন্ডানো কে তাওবাহর শর্ত মনে করা,এটাও বিদআতের অন্তর্ভুক্ত ।কেননা সাহাবা রাযি, তাবেইন এবং ইমামগণের কেউ-ই এমনটা করেননি।(মাজমুউল ফাতাওয়া:২১/১১৮)
চতুর্থ প্রকারঃ-
কিছু ক্ষেত্রে চুল মুন্ডানো হারাম।
(১)কারো মূত্যুতে চুল মুন্ডানো। ইহা হারাম।সহীহ মুসলিম-১৪৯
(২)এমন কোনো কাফিরের সাদৃশ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে চুল মুন্ডানো যে কাফির চুল মুন্ডানোর সাথে পরিচিত।ইহাও হারাম।(সুনানে আবু-দাউদ-৪০৩১)
পঞ্চম প্রকারঃ-
কিছু ক্ষেত্রে চুল মুন্ডানো মুবাহ।
যেমন,কোনো প্রয়োজনে চুল মুন্ডানো।যথাঃ- চিকিৎসার স্বার্থে বা উকুন ইত্যাদি থেকে বাচতে চুল মুন্ডানো, এটা জায়েয।মাজমুউল ফাতাওয়া-১২/১১৭
ষষ্ট প্রকারঃ-
কোনো প্রকার প্রয়োজন ব্যতীত এমনিতেই চুল মুন্ডানো। এ সম্পর্কে উলামাদের মতানৈক্য রয়েছে-
ইমাম মালিক রাহ বিনা প্রয়োজনে চুল মোন্ডানোকে মাকরুহ আখ্যা দিয়ে থাকেন।উনার দলীল হলো,এটা বেদআতী তথা খাওয়ারিজদের নিদর্শন।
আর হাদীস শরীফে এসেছে যে যার সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অন্যদিকে জুমুহুর উলামায়ে কেরাম চুল মোন্ডানোকে মুবাহ মনে করেন।তাদের দলীল হল,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জা'ফর রাযি থেকে বর্ণিত
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ جَعْفَرٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمْهَلَ آلَ جَعْفَرٍ ثَلَاثًا أَنْ يَأْتِيَهُمْ، ثُمَّ أَتَاهُمْ، فَقَالَ: «لَا تَبْكُوا عَلَى أَخِي بَعْدَ الْيَوْمِ»، ثُمَّ قَالَ: «ادْعُوا لِي بَنِي أَخِي»، فَجِيءَ بِنَا كَأَنَّا أَفْرُخٌ، فَقَالَ: «ادْعُوا لِي الْحَلَّاقَ»، فَأَمَرَهُ فَحَلَقَ رُءُوسَنَا
মু'তার যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাঃ হযরত জা'ফর ইবনে আবু-আবু তালিবের বাড়ীর আত্মীয় স্বজনকে তিন দিন পর্যন্ত শোক পালনের অবকাশ দিয়েছিলেন।এবং এই তিনদিন তিনি তাদের বাড়ীতে আসেননি।অতঃপর তিনি তাদের বাড়ীতে আসলেন।এবং বললেন,তোমরা এরপর থেকে আর কাদবে না।অতঃপর বললেন,আমার ভাতিজাদেরকে ডাকো।আব্দুল্লাহ ইবনে জা'ফর রাযি বলেন, পাখির ছানার মত আমাদেরকে আদর করে নিয়ে আসা হলো।তারপর রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন,আমার কাছে নাপিতকে নিয়ে আসো।নাপিত আসলে তাকে আমাদের চুল মুন্ডানোর আদেশ দেন,অতঃপর নাপিত আমাদের চুলকে মুন্ডিয়ে দিলো।
সুনানে আবু-দাউদ-৪১৯২।
ﻋَﻦْ ﺍﺑْﻦِ ﻋُﻤَﺮَ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲَّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺭَﺃَﻯ ﺻَﺒِﻴًّﺎ ﺣَﻠَﻖَ ﺑَﻌْﺾَ ﺭَﺃْﺳِﻪِ ﻭَﺗَﺮَﻙَ ﺑَﻌْﻀًﺎ ﻓَﻨَﻬَﻰ ﻋَﻦْ ﺫَﻟِﻚَ ، ﻭَﻗَﺎﻝَ : ( ﺍﺣْﻠِﻘُﻮﻩُ ﻛُﻠَّﻪُ ﺃَﻭْ ﺍﺗْﺮُﻛُﻮﻩُ ﻛُﻠَّﻪُ )
তরজমাঃ-হযরত ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাঃ একবার একটি ছোট বালককে দেখলেন যে তার অর্ধেক মাথায় চুল মুন্ডিত এবং অর্ধেক মাথায় চুল অবশিষ্ট রয়েছে, তখন নবী কারীম সাঃএত্থেকে নিষেধ করে বললেনঃহয়তো তুমি সারা মাথা মুন্ডিয়ে ফেল নতুবা সমস্ত চুল রেখে দাও।
(ইমাম আলবানী রহ ইহাকে সহীহ বলেছেন)
সুনানে নাসায়ী, ৫০৪৮;সুনানে আবু-দাউদ,৪১৯৫;
মুহাদ্দিসিনে কেরামের একাংশ
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা বিনাপ্রয়োজনে চুল মুন্ডানোকে মুবাহ প্রমাণের উপর আপত্তি উত্তাপিত করে তারা বলেন,
(ক)
উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ে চুল মুন্ডানো প্রয়োজন বশত ছিলো।আর প্রয়োজনের সময় তো সবার মতেই মুবাহ।প্রয়োজন হল,বাচ্ছাদের চুলে উকুন ইত্যাদি হয়ে যায়,যেজন্য তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাঃ চুল মুন্ডানোর আদেশ দিয়েছেন।(যা'দুল মা'আদ-৪/১৫৯)
(খ)
বাচ্ছাদের চুল মুন্ডানো কে কেন্দ্র করে এ হাদীস সমূহ বর্ণিত রয়েছে।আমরা সবাই অবগত আছি যে,বাচ্ছাদের ব্যাপারে শরীয়তে এমন কিছু বিষয়ের রুখসত প্রমাণিত রয়েছে যা অন্যদের বেলায় হয় সাধারণত থাকে না।(মাজমুউল ফাতাওয়া-২১/১১৯,শরহুল উমদাহ-১/২৩০)
সু-প্রিয় পাঠকবর্গ!
চুল মুন্ডানোর ষষ্ট প্রকার তথা বিনাপ্রয়োজনে এমনিতেই চুল মুন্ডানো সম্পর্কে শরীয়তের বিধান কি? এ সম্পর্কে উলামাদের মতবিরোধ বর্ণিত রয়েছে।এমনকি হানাফি মাযহাবের কিতাবাদিতেও মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়।
যেমন মুল্লা আলী কারী রাহ মিশকাত গ্রন্থের ব্যখ্যা মিরকাতে লিখেন,
(فَحَلَقَ رُءُوسَنَا) . وَإِنَّمَا حَلَقَ رُءُوسَهُمْ مَعَ أَنَّ إِبْقَاءَ الشَّعْرِ أَفْضَلُ إِلَّا بَعْدَ فَرَاغِ أَحَدِ النُّسُكَيْنِ عَلَى مَا هُوَ الْمُعْتَادُ عَلَى الْوَجْهِ الْأَكْمَلِ لِمَا رَأَى مِنِ اشْتِغَالِ أُمِّهِمْ أَسْمَاءَ بِنْتِ عُمَيْسٍ عَنْ تَرْجِيلِ شُعُورِهِمْ بِمَا أَصَابَهَا مِنْ قَتْلِ زَوْجِهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ، فَأَشْفَقَ عَلَيْهِمْ مِنَ الْوَسَخِ وَالْقَمْل
রাসূলুল্লাহ সাঃ জা'ফর রাযির সন্তানদের চুল মুন্ডিয়েছিলেন।অথচ হজ্ব বা উমরাহ ব্যতীত অন্যান্য সময়ে মুন্ডানোর চেয়ে চুলকে অবশিষ্ট রাখাই উত্তম ছিলো।কিন্তু এখানে জা'ফর রাযির স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস রাযি স্বামীর মৃত্যু শোকে ব্যস্ত থাকার ধরুণ সন্তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রতি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাঃ ভাতিজাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন।যাতে করে চুলে ময়লা আবর্জনা জমে উকুন ইত্যাদি না হয়ে যায়।
মিরকাতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মানাবীহ,৪৪৬৩নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য
আবু-দাউদের শরাহ আউনুল মা'বুদ গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে।
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻘﺎﺭﻱ ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ : ﺍﻷﻓﻀﻞ ﺃﻥ ﻻ ﻳﺤﻠﻖ ﺇﻻ ﻓﻲ ﺃﺣﺪ ﺍﻟﻨﺴﻜﻴﻦ ( ﻳﻌﻨﻲ : ﺍﻟﺤﺞ ﻭﺍﻟﻌﻤﺮﺓ ) ﻛﻤﺎ ﻛﺎﻥ ﻋﻠﻴﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺍﻟﺴﻼﻡ ﻣﻊ ﺃﺻﺤﺎﺑﻪ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻢ . ﺍﻫـ ﻣﻦ ﻋﻮﻥ ﺍﻟﻤﻌﺒﻮﺩ ( 11/248 )
উত্তম হল,হজ্ব উমরাহ ব্যতীত অন্যকোন সময় চুল না মুন্ডানো। যেমন রাসূলুল্লাহ সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরামের আ'মল ছিলো।(আউনুল মা'বুদ-১১/২৪৮)
কিন্তু মুল্লা অালী ক্বারী রাহ খাওয়ারিজদের আ'লামত বর্ণনায় চুল মুন্ডানো সম্ভলিত যে হাদীস বর্ণিত রয়েছে,সে হাদীসের ব্যখ্যায় এর উল্টো লিখেন,
وَهُوَ لَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ الْحَلْقَ مَذْمُومٌ فَإِنَّ الشِّيَمَ وَالْحُلَى الْمَحْمُودَةَ قَدْ يَتَزَيَّا بِهَا الْخَبِيثُ تَرْوِيجًا لِخُبْثِهِ وَإِفْسَادِهِ عَلَى النَّاسِ وَهُوَ كَوَصْفِهِمْ بِالصَّلَاةِ وَالْقِيَامِ، وَثَانِيهِمَا أَنْ يُرَادَ بِهِ تَحْلِيقُ الْقَوْمِ وَإِجْلَاسُهُمْ حِلَقًا حِلَقًا
খাওয়ারিজদের আ'লামত হল চুল মুন্ডানো। তবে এ অা'লামত বর্ণনা দ্বারা চুল মুন্ডানো কখনো নিন্দনীয় হবে না।কেননা উত্তম স্বভাব এবং প্রশংসিত আচরণ দ্বারা কখনো কখনো মন্দ লোকও সু-সজ্জিত থাকে, যাতেকরে তাদের মন্দ আকিদা-বিশ্বাসকে সহজেই গ্রহণযোগ্য করে তুলা যায়।এটা এমন যেন তাদের বিশেষণ নামায,এবং গভীর রাত্রের নফল নামায পড়া।দ্বিতীয়ত উক্ত হাদীসে তাহলীক্ব দ্বারা তাদের গোল করে হালকাবন্দী হয়ে বসা উদ্দেশ্য। সে হিসেবে উক্ত হাদীস চুল মুন্ডানোকে নিন্দনীয় করবে না।
মিরকাত,৩৫৪৩ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য
এবং ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়ায় উল্লেখ করা হয়-
وَفِي رَوْضِهِ الزندويستي أَنَّ السُّنَّةَ فِي شَعْرِ الرَّأْسِ إمَّا الْفَرْقُ وَإِمَّا الْحَلْقُ وَذَكَرَ الطَّحْطَاوِيُّ الْحَلْقُ سُنَّةٌ وَنُسِبَ ذَلِكَ إلَى الْعُلَمَاءِ الثَّلَاثَةِ كَذَا فِي التَّتَارْخَانِيَّة.
يُسْتَحَبُّ حَلْقُ الرَّأْسِ فِي كُلِّ جُمُعَةٍ كَذَا فِي الْغَرَائِبِ.
মাথার চুলে সুন্নাত ত্বরিকা হচ্ছে,চুল রেখে মধ্যখানে ফিতা বের করা অথবা চুল মুন্ডানো। ইমাম তাহতাবী রাহ বলেন,চুল মুন্ডানো সুন্নত।এমনটা আমাদের তিন ইমাম- ইমাম আবু-হানিফা,ইমাম আবু-ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ রাহ এর দিকে সম্বন্ধ করা হয়।প্রত্যেক জুমুআহ বারে চুল মুন্ডানো মুস্তাহাব।
ফাতওয়ায়ে রশিদিয়ায় উল্লেখ করা হয়,
বাবড়ি চুল রাখা সুন্নাত এবং চুল মুন্ডন করাও হানাফি মাযহাব মতে সুন্নাত,অর্থাৎ উভয়টিই সুন্নাত।
সু-প্রিয় পাঠকবর্গ!
চুলের বিধি-বিধান সম্ভলিত উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে,বিনা প্রয়োজনে চুল মুন্ডানো উত্তম না চুলকে অবশিষ্ট রাখা উত্তম।তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে-
মুল্লা আলী কারী রাহ এর দুই বক্তব্যর একটি হল,বিনা প্রয়োজনে এমনিতেও চুল রাখার চেয়ে চুল মুন্ডানো উত্তম।আমাদের সালাফদেরকে সময়ে সময় চুল মুন্ডাতে দেখেছি।তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সর্বদাই চুল কে মুন্ডাতেন।
তাই আমাদের সিদ্ধান্ত হলো বাবড়ি চুল রাখার মত চুল মুন্ডানোও সুন্নত।
অাল্লাহ-ই ভালো জানেন।
উত্তর লিখনে
মুফতী ইমদাদুল হক
ইফতা বিভাগ, Iom.
পরিচালক
ইসলামিক রিচার্স কাউন্সিল বাংলাদেশ