জবাব
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
★মুদারাবা (مضاربة) শব্দটি আরবী দারব (ضرب) শব্দমূল হতে উদ্ভূত। আরবি ভাষায় শব্দটি প্রহার করা, আঘাত করা, অন্বেষণ করা, দৃষ্টান্ত দেয়া, পরিভ্রমণ করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে শব্দটি পরিভ্রমণ করা অর্থে বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন ,
وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّه
অর্থ : অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করে। সূরা মুযযাম্মিল : ২০
,
ইসলামী শরীয়ার পরিভাষায়, মুদারাবা এমন একটি অংশীদারি কারবার যেখানে দু’টি পক্ষ থাকে। একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করেন এবং অপর পক্ষ মেধা ও শ্রম ব্যয় করে উক্ত মূলধন দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসায়ে লাভ হলে পূর্ব চুক্তি অনুসারে উভয়পক্ষের মাঝে বণ্টিত হয়। আর লোকসান হলে মূলধন সরবরাহকারী পক্ষকে তা বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে সবটুকু লোকসান পুঁজিদাতা বহন করলেও মুদারিব তার শ্রম ও তৎপরতার কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়াটাই তার লোকসান হিসেবে গণ্য হয়। তবে যদি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে লোকসান হয় তাহলে মুদারিবকে লোকসানের দায় বহন করতে হবে।
,
উল্লেখ্য, মুদারাবা ব্যবসায় স্বাভাবিক লোকসান হয়ে পুঁজি ক্ষতিগ্রস্থ হলে প্রথমত পূর্বতন লভ্যাংশ দ্বারা পুঁজির সমন্বয় করা হবে। লভ্যাংশ দ্বারা পুঁজির সমন্বয় না হলে অবশিষ্ট ক্ষতি পুঁজিদাতাই বহন করবে। এ ক্ষেত্রে মুদারিব বা উদ্যোক্তার উপর এর কোনো দায় আরোপিত হবে না। শারহুল মাজাল্লাহ ৪/৩৬৩
মূলধন সরবরাহকারী পক্ষকে বলা হয় ছাহিবুল মাল (صاحب المال) আর ব্যবসায় পরিচালনাকারী-পক্ষকে বলা হয় মুদারিব (مضارب)। আর বিনিয়োগকৃত অর্থকে বলা হয় রা’সুল-মাল (رأس المال) বা পুঁজি।
,
মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারিত্ব যেখানে একপক্ষ (সাহিবুল মাল/রাব্বুল মাল) তহবিল বা পুঁজি সরবরাহ করেন এবং অন্যপক্ষ তার দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়োজিত করেন। তাকে বলা হয় মুদারিব বা ব্যবস্থাপক। ব্যবসায়ের লাভ দু’পক্ষের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে ভাগ হয়। পুঁজির লোকসান হলে তা মূলধন সরবরাহকারী (সাহিবুল মাল) বহন করেন।
,
মুদারাবার শর্ত সমুহ সম্পর্কে জানুন
,
★মুশারাকাহ সংক্রান্ত মুফতী মুহাম্মাদ শোয়াইব সাহেব দাঃবাঃ লিখেছেন
বাইয়ে মুশারাকা একটি বহুল প্রচলিত ইসলামি বিনিয়োগ পদ্ধতি। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছেÑ অংশীদার হওয়া। শরিয়তের পরিভাষায় যে কারবারে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি লাভ-লোকসানের ঝুঁকি বহন করার শর্তে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কারবার পরিচালনা করেন তাকে বাইয়ে মুশারাকা বলা হয়। ২ থেকে সর্বোচ্চ ২০ জন দ্বারা এ কারবার পরিচালিত হতে পারে। একটি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এটি শুরু হবে এবং এতে লেখা থাকবে অংশীদারদের প্রদেয় মূলধনের পরিমাণ, দায়দায়িত্ব, প্রয়োজনে অধিক মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়া, লভ্যাংশ বণ্টনের হার ও প্রক্রিয়া, নতুন অংশীদার গ্রহণের শর্ত ইত্যাদি।
,
অংশীদারি কারবারে দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে সব অংশীদারের দায়িত্ব সমান থাকে। সব সদস্য সম্মিলিতভাবে অথবা সবার পক্ষ থেকে একজন কারবার পরিচালনা করেন।
,
রাসুল (সা.) এর যুগে আরবজুড়েই বাইয়ে মুশারাকা বিস্তৃত ছিল। হাদিসে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘দুই অংশীদারের মাঝে আমি তৃতীয় হই, যতক্ষণ তারা একে অন্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে। যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন আমি তাদের মধ্য থেকে সরে যাই।’
বাইয়ে মুশারাকায় উভয়পক্ষের মূলধন ও লাভ সমান সমান অথবা কম-বেশি হতে পারে। তবে প্রাপ্ত মুনাফা বণ্টন পদ্ধতি মূলধনভিত্তিক হতে পারবে না; বরং মুনাফাভিত্তিক হবে। চুক্তির সময়ই লাভের হার নির্ধারণ করে নেবে; কিন্তু মাসিক বা সাপ্তাহিক কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে না। যেমন মাসে বা সপ্তাহে ৫ হাজার বা ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করা যাবে না।
,
বাইয়ে মুশারাকার প্রকারভেদ
বাইয়ে মুশারাকা দুই ভাগে বিভক্ত। ১. শিরকাতুল মিলক বা মালিকানায় অংশীদারত্ব।
২. শিরকাতুল আকদ বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারত্ব।
শিরকাতুল মিলক বা মালিকানায় অংশীদারত্ব
কোনো বস্তুর ক্রয়সূত্রে বা মিরাস সূত্রে মালিকানায় অংশীদার হওয়াকে শিরকাতুল মিলক বলে। যেমনÑ কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা তার সমুদয় সম্পত্তির মালিক হয়। অথবা কোনো পূর্ব চুক্তি ছাড়াই দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো কিছু কিনে তার মালিকানায় অংশীদার হয়। মনে রাখতে হবে, যদি আগে থেকে মালিকানায় বা লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণ করার শর্তসাপেক্ষে কোনো জিনিসের মালিকানা হাসিল হয়, তাহলে তা শিরকাতুল মিলক থাকবে না; বরং শিরকাতুল আকদ হয়ে যাবে।
শিরকাতুল আকদ বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারত্ব চার প্রকার। যথা
১. শিরকাতুল মুফাওয়াদা;
২. শিরকাতুল ইনান;
৩. শিরকাতুস সানায়ে;
৪. শিরকাতুল উজুহ।
শিরকাতুল মুফাওয়াদা (সম-অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শরিকানা কারবার) : যে কারবারে সব পক্ষ সমান পুঁজি, দায়দায়িত্ব ও ঝুঁকি বহন করে তাকে শিরকাতুল মুফাওয়াদা বলা হয়। এ কারবারে চুক্তিপত্রে ব্যবসায়িক সবক্ষেত্রে সমদায়িত্ব ও অধিকারের কথাটি উল্লেখ থাকতে হবে।
,
এ কারবারটি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যথা
১. সব অংশীদারকে আজাদ সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন বালেগ ও মুসলমান হতে হবে।
২. মূলধন টাকাপয়সা স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি হতে হবে।
৩. চুক্তিপত্রে শিরকাতুল মুফাওয়াদা বা সম-অংশীদারত্ব কথাটি উল্লেখ থাকতে হবে।
৪. অংশীদাররা মাসিক বা বার্ষিক মুনাফা নির্ধারণ করতে পারবে না, বরং লভ্যাংশ অনুপাতে মুনাফা বণ্টন করতে হবে।
৩. চুক্তিপত্রে শিরকাতুল মুফাওয়াদা উল্লেখ থাকতে হবে।
৪. সব অংশীদারকে সমান হারে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি বহন করতে হবে।
৫. মূলধন সমান দেওয়ার পর কেউ যদি শ্রম বেশি দেয়, তাহলে তার জন্য আলাদা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতে হবে।
৬. নিজের পারিবারিক প্রয়োজনে কেউ কোনো জিনিস নিলে তার মূল্য পরিশোধ করে দিতে হবে।
৭. সব অংশীদার একে অন্যের প্রতিনিধি ও জামিনদার হিসেবে গণ্য হবে। বিনিয়োগকৃত অর্থের জন্য আমানতদার হিসেবে গণ্য হবে।
৮. ব্যবসায় লোকসান হলে প্রত্যেকে আপন মূলধন অনুপাতে লোকসান বহন করবে।
৯. কোনো অংশীদার একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না; যদি নেয় এবং তাতে ক্ষতি হয়, তাহলে অন্য অংশীদারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
১০. দুজনের যে-কোনো একজন মারা গেলে অংশীদারি কারবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কারবারে যদি দুইয়ের অধিক লোক থাকে, তাহলে কারবার বিলুপ্ত হবে না।
শিরকাতুল ইনান (অসম অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শরিকানা কারবার) : যে কারবারে সব অংশীদারের মূলধন এক নয়; তবে সবার শ্রমদান সমান, সে কারবারকে শিরকাতুল ইনান বলে। লভ্যাংশ বণ্টিত হয় মূলধন অনুপাতে অথবা ব্যবসায়িক দক্ষতা বিবেচনায় আলোপ-আলোচনার মাধ্যমে।
শিরকাতুস সানায়ে (পেশাজীবীদের শরিকানা কারবার) : যে কারবারে একাধিক পেশাদার এ মর্মে একত্রিত হয় যে, সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যা উপার্জন হবে, তা সংশ্লিষ্ট কাজের ব্যয় নির্বাহের পর নিজেদের মাঝে সমহারে বা পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে ভাগ করে নেবে। এ ধরনের পেশাসংক্রান্ত কারবারকে শিরকাতুস সানায়ে বলে।
,
শিরকাতুল উজুহ (ব্যবসায়ী সুনামের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শরিকানা কারবার) : সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি থাকেন, যাদের মূলধন থাকে না। কিন্তু ব্যবসায়িক এড়ড়ফ রিষষ বা ব্যবসায়ী সমাজে তার এমন সুনাম ও বিশ্বস্ততা আছে যে, সে পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে বাকিতে এনে নগদ বিক্রি করতে পারে। এ ধরনের একাধিক ব্যক্তি যদি এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তারা পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে বাকিতে পণ্য এনে নগদ বিক্রি করার পর এ সংক্রান্ত ব্যয় বাদে যা থাকবে, তা তাদের মাঝে পূর্বনির্ধারিত হারে বণ্টন করে নেবে, তাহলে তাকে শিরকাতুল উজুহ বলে।
,
উল্লেখ্য, এ অংশীদারত্বের ব্যবস্থা যেহেতু বর্তমান পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত কোথাও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে এর অনুসরণ পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয়নি, তাই এর বরকতও মানুষের সম্মুখে আসছে না। সাম্প্রতিক মুসলমানদের বিভিন্ন অঞ্চলে এ পদ্ধতিটি চালু করার চেষ্টা চালানো হয়েছে যে, এমন কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে, যেটি ‘ইন্টারেস্ট’ পদ্ধতির পরিবর্তে ইসলামি আইন অনুযায়ী মুদারাবা-মুশারাকাভিত্তিক পরিচালিত হবে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০টি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোর দাবি হলোÑ আমরা ইসলামি নিয়মনীতি অনুসারে কারবার পরিচালনা করছি এবং সুদমুক্ত ব্যবসা করছি। তাদের এ দাবি শতভাগ সঠিক না মানলেও এবং তাতে কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এ কথাটি সত্য, বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১০০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক সুদবিহীন ব্যবস্থার ওপর কাজ করছে। এ ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো অংশীদারত্ব পদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে। আর যেখানেই অংশীদারত্বের পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানেই ভালো সুফল পাওয়া গেছে।
,
,
★★প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই বোন,মুদারাবাহ মুশারাকাহ এর ক্ষেত্রে শরীয়তের উসুল হলো যাহা লাভ হবে,তাহা শতকরা হারে উভয়ের মাঝে বন্টন করার চুক্তি করতে হবে।
কোনো নির্দিষ্ট টাকার চুক্তি করা যাবেনা,লোকসান হলে আগে লাভের টাকা থেকে সেটা পূরন করা হবে,অতঃপর মূলধন থেকে পূরন করা হবে।
,
হাদীস শরীফে এসেছেঃ
بَاب الشَّرِكَةِ وَالْمُضَارَبَةِ
حَدَّثَنَا أَبُو السَّائِبِ، سَلْمُ بْنُ جُنَادَةَ حَدَّثَنَا أَبُو دَاوُدَ الْحَفَرِيُّ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ اشْتَرَكْتُ أَنَا وَسَعْدٌ، وَعَمَّارٌ، يَوْمَ بَدْرٍ فِيمَا نُصِيبُ فَلَمْ أَجِئْ أَنَا وَلاَ عَمَّارٌ بِشَىْءٍ وَجَاءَ سَعْدٌ بِرَجُلَيْنِ .
শারীকাত (অংশিদারী) ও মুদারাবা ব্যবসা
আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন সাদ (রাঃ) , আম্মার (রাঃ) ও আমি গানীমাতের মালের ব্যাপারে অংশীদার হই (এই মর্মে যে, আমরা যা পাবো তা তিনজনে ভাগ করে নিবো)। আম্মার ও আমি কিছুই আনতে পারিনি। অবশ্য সাদ (রাঃ) দু’জন যুদ্ধবন্দী নিয়ে আসেন।
(নাসায়ী ৪৬৯৭, আবূ দাউদ ৩৩৮৮, বায়হাকী ফিস সুনান ৪/১৯৪, ইরওয়া ১৪৭৪।)
বিস্তারিত জানুনঃ
★মুরাবাহা ইসলামী ফিকাহর একটি বিশেষ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির নাম। এর দুইটি রূপ আছে। যথাÑ প্রাচীন মুরাবাহা ও আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহা। এখানে সংক্ষেপে দুইটির পরিচিতি ও তাৎপর্য পেশ করা হলোঃ
(লিখেছেনঃ মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম সাহেব দাঃবাঃ )
,
প্রাচীন মুরাবাহার পরিচিতি : ‘মুরাবাহা’ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ পরস্পরে লাভবান হওয়া। মুরাবাহার মূল কথা হলো, চুক্তিমূলে পণ্য ক্রয় বা সংগ্রহ বাবদ মূল খরচ ও মুনাফা আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে।
উদাহরণ ২০০ টকা দিয়ে ‘ক’ এক জোড়া জুতা ক্রয় করল। এরপর সে তা মুরাবাহা ভিত্তিতে ‘খ’ এর কাছে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করতে আগ্রহী। তাহলে সে ওই পণ্য বাবদ তার খরচ ২০০ টাকা উল্লেখ করে এর ওপর ১০ টাকা মুনাফা নেয়ার কথা চুক্তিতেই ঘোষণা করতে হবে। এতে ‘খ’ রাজি হয়ে বিক্রির প্রস্তাব গ্রহণ করলে তা মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
,
মুরাবাহার বৈশিষ্ট্য : অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির চেয়ে মুরাবাহার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলো মুরাবাহায় পণ্য ক্রয় বাবদ মূল্য ও খরচ (যদি থাকে) চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করতে হয়, মুরাবাহা চুক্তিতে মুনাফার হার বা সুনির্দিষ্ট অঙ্ক আলাদা করে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করত হবে, মুরাবাহা চুক্তি আমানত ও বিশ্বস্ততানির্ভর বিক্রয় চুক্তি।
.
প্রাচীন মুরাবাহার সঙ্গে অন্যান্য ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির পার্থক্য : অন্যান্য সাধারণ বিক্রয় চুক্তির চেয়ে মুরাবাহার একমাত্র মৌলিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হলো, মুরাবাহায় বিক্রেতা স্পষ্টভাবে ক্রেতাকে বলবে, ‘পণ্যটির ক্রয়মূল্য এত বা পণ্য বাবদ আমার খরচ হয়েছে এত। এরপর এর ওপর এত মুনাফা ধার্য করে তা বিক্রি করতে আগ্রহী।’ সুতরাং চুক্তিতে পণ্য বাবদ খরচ ও মুনাফা পৃথকভাবে উল্লেখ না করা হলে সেটা মুরাবাহা হবে না। যদিও বাস্তবে মূল খরচের ওপর মুনাফা ধার্য করা হয়।
,
ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহা : বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং মুরাবাহা প্র্যাক্টিস হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ বিনিয়োগ পদ্ধতি মুরাবাহার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত হবে বা মুরাবাহাভিত্তিক ফাইন্যান্স গ্রহণ করবে, তাদের জন্য ব্যাংকিং মুরাবাহার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া একান্ত জরুরি।
,
ব্যাংকিং মুরাবাহার প্রাথমিক ধারণা : ব্যাংকিং মুরাবাহা মূলত সুদি বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মূল কথা হলো, কারও কোনো পণ্য ক্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এখন লোকটি যদি সুদি ব্যাংকে অর্থের জন্য গমন করে, তাহলে ব্যাংক তাকে সুদভিত্তিক লোন প্রদান করবে। এরপর লোকটি সেই লোন দিয়ে ওই পণ্য ক্রয় করে তার প্রয়োজন নির্বাহ করবে। অপরদিকে সুদমুক্ত ইসলামী কোনো ব্যাংকে যদি লোকটি যায় এবং নিজের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করে, তাহলে ইসলামী ব্যাংক তাকে সরাসরি ফান্ড সরবরাহের পরিবর্তে গ্রাহক যে পণ্য ক্রয়ের জন্য ফান্ড চেয়েছে, সেটা প্রথমে ব্যাংক নিজে ক্রয় করবে। এরপর তা মুরাবাহা ভিত্তিতে বাকিতে অধিক মূল্যে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দেবে। যেহেতু এখানে গ্রাহক ব্যাংকে এসে পণ্য খরিদের জন্য ব্যাংককে প্রস্তাব করেছে, এরপর তার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ব্যাংক পণ্য খরিদ করে মুরাবাহা বিনিয়োগ করেছে, তাই তাকে আধুনিক আরবি ভাষায় ‘মুরাবাহা লিল-আমির বিশ-শিরা’ (ক্রয়ের আদেশদাতা ক্রেতার স্বার্থে মুরাবাহা চুক্তি করা) বলে।
,
ব্যাংকিং মুরাবাহা বাস্তবায়নের স্তরবিন্যাস : মোট তিনটি স্তরে ব্যাংকিং মুরাবাহা সম্পন্ন হয়ে থাকে। যথাÑ ১. গ্রাহক, যে ব্যাংককে পণ্য ক্রয়ের আদেশ করেছে এবং ব্যাংক থেকে ক্রয়কৃত পণ্যটি কিনে নেবে বলে ওয়াদাও প্রদান করেছে। ২. ইসলামী ব্যাংক, যে গ্রাহকের আবেদন মঞ্জুর করে পণ্যটি নিজে বা গ্রাহককে প্রতিনিধি করে সরবরাহকারী থেকে ক্রয় করবে। ৩. সবশেষে গ্রাহক ইসলামী ব্যাংক থেকে ক্রেতা হিসেবে পূর্ব ওয়াদা অনুযায়ী পণ্য ক্রয় করে নেবে।
,
ওই তিনটি স্তর মূলত তিনটি আকদ বা চুক্তিকে অনিবার্য করে। প্রথম স্তরে গ্রাহক, ব্যাংকের সঙ্গে একটি ওয়াদা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ওই ওয়াদা রক্ষা করা আবশ্যক। দ্বিতীয় স্তরে ইসলামী ব্যাংক, যে পণ্যটি হয় নিজে বা গ্রাহককে প্রতিনিধি করে সরবরাহকারী থেকে ক্রয় করবে। গ্রাহককে প্রতিনিধি করা হলে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের আকদুল ওয়াকালা বা ওয়াকালা চুক্তি কার্যকর হবে। তৃতীয় ও চূড়ান্ত স্তরে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি কার্যকর হয়। শরিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে ওই তিনটি স্তরে সংগঠিত আকদ বা চুক্তিগুলো সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক হওয়া জরুরি। বিশেষ করে ওয়াকালাহ চুক্তি ও মুরাবাহা চুক্তি একই বৈঠকে হওয়া নিষিদ্ধ।
,
ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহার তাৎপর্য : ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে মুরাবাহা মৌলিক কোনো ফাইন্যান্স পদ্ধতি নয়। সুদ থেকে বেঁচে থাকার স্রেফ একটি কৌশলী বিনিয়োগ পদ্ধতি। সুদি লোনের বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শুরু অবস্থায় সাময়িকভাবে এর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।
,
বিশ্বের অন্যতম ইসলামিক ব্যাংকিং স্কলার শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী লিখেছেন ‘এ কথাটি কখনোই ভুলা যাবে না যে, মৌলিকভাবে মুরাবাহা কোনো ধরনের বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। এটি শুধু সুদ থেকে বাঁচার একটি কৌশল। এটি আদর্শিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়, যা দ্বারা ইসলামের অর্থনীতির মূল রূপ বাস্তবায়ন হবে। তাই ইসলামী অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার সূচনাকালে সাময়িকভাবে এর ব্যবহার সীমিত করা উচিত এবং যেখানে মুশারাকা ও মুদারাবা সম্ভব হবে না, শুধু সেক্ষেত্রেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা উচিত।’ (এন ইন্ট্রুডাকশন টু ইসলামিক ফাইন্যান্স, পৃ. ৭২)।
,
মোট কথা, মুরাবাহা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আদর্শিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বিকল্প হিসেবে ভিন্ন কোনো কর্মকৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু মুরাবাহার চর্চা হবে, সেটা সঠিকভাবে করতে হবে।
,
মনে রাখতে হবে, শুধু কাগজে-কলমে মুরাবাহা হওয়াই মুনাফা বৈধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে যারা মুরাবাহা বিনিয়োগ গ্রহণ করবেন, তাদের উচিত এর আগে ফিকহুল মুয়ামালা বিষয়ে পারদর্শী কোনো মুফতির কাছ থেকে মুরাবাহার সঠিক পদ্ধতি জেনে নেয়া। এরপর বিনিয়োগ গ্রহণ করা।
,