بسم الله الرحمن الرحيم
জবাব,
পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে মহান আল্লাহ
তায়ালা বলেন-
وَمِنَ
النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ
عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
‘মানুষের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে, যারা খেলাধুলা-কৌতুকাবহ কথা ক্রয় করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে
ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এটা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবনামনাকর শাস্তি।’(সূরা:
লোকমানের, আয়াত: ৬) আলোচ্য আয়াতটি খেলাধুলা ও অনর্থক কাজের নিন্দায় সুস্পষ্ট
ও প্রকাশ্য। (রুহুল মাআনি: ৫৬৪৪)
বিংশ শতাব্দির প্রখ্যাত মুফতি মাওলানা
মুহাম্মদ শফী (র.) তার ‘আহকামুল ককোরআনে’ বর্ণিত আয়াতের হুকুম প্রসঙ্গে বলেন, পবিত্র ককোরআনের এ আয়াতে ঐসকল কথা, কাজ, বস্তু ও বিষয়কে হারাম
করা হয়েছে, যা মানুষকে আল্লাহ তায়ালার এবাদত ও
তাঁর স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়। তা গান-বাজনা হোক বা খেলাধুলা কিংবা ক্রিড়া-কৌতুক-সবই
এর অন্তর্ভুক্ত।
খেলাধুলায় জায়েজ না নাজাজের
শর্ত:
ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো খেলাধুলাকে জায়েজ
বা নাজায়েজ বলে নাই; বরং তিনটি শর্তের সঙ্গে
জায়েজ-নাজায়েজের সম্পর্ক। তা হলো, (১) শারীরিক উপকার সাধন
(২) ইসলামি শরিয়াতের কোনো বিধান লঙ্ঘন না হওয়া (৩) আর্থিক ক্ষতিসাধন না হওয়া। এ তিনটি
শর্ত যে খেলার মাঝে পাওয়া যাবে তা জায়েজ,
আর পাওয়া না গেলে জায়েজ
নয়।
যেসব শর্তে খেলাধুলা জায়েজ:
এর ওপর ভিত্তি করে ইসলামি ফকিহরা আরো
কিছু বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ফাতোয়া তুলে ধরেছেন। যেকোনো ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ
হওয়ার জন্য তাতে নিম্নোক্ত শর্তগুলো উপস্থিত থাকতে হবে-
(১) ধর্মীয় জরুরি কর্তব্য পালন থেকে উদাসীন না করা:
কোনো খেলা বৈধ হতে হলে তার মধ্যে এ
বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যে তার নেশার ঘোর যেন মহান আল্লাহর কোনো ফরজ বিধান পালনের কথা
দিব্যি ভুলিয়ে না দেয়। খেলার ছলে যেন ফরজ ছুটে না যায়। যেমন কোনো ফরজ নামাজের সময় খেলাধুলা
করা। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
আর মানুষের মধ্য থেকে
কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনর্থক কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’ (সূরা: লুকমান, আয়াত: ৬) এ আয়াত দ্বারা কেউ ব্যাখ্যা করেছেন যে, অতিরিক্ত খেলাধুলাও মানুষকে আল্লাহর পথ বা বিধান পালন থেকে বিরত
রাখে।
(২) শরিয়তের মহৎ লক্ষ্যের প্রতি খেয়াল রাখা:
মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীমাত্রেই
জানেন, পৃথিবীতে আমাদের আগমন অহেতুক নয়। পৃথিবীতে আমাদের জীবন লক্ষ্যহীন
নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলেন,
আরবি আয়াত:
وَمَا
خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’
(সূরা: আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫৬)
অতএব খেলার লক্ষ্য যেন উদ্দেশ্যহীন
খেলায়ই সীমাবদ্ধ না থাকে। খেলাটি হতে হবে হয়তো ইসলামের জন্য জীবনবাজি রেখে জিহাদের
প্রস্তুতি হিসেবে, যেটি ইসলামের শরীরচর্চার
সর্বোচ্চ লক্ষ্য অথবা শারীরিক সক্ষমতা অর্জন,
কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা
বৈধ চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে।
(৩) সতর আবৃত থাকা এবং যৌন সুড়সুড়িদায়ক না হওয়া:
অন্য সময়ের মতো খেলাধুলার সময়ও সতর
ঢাকা ওয়াজিব। অথচ অনেক খেলায় ফিতনা উসকে দেবার মতো সতর খোলা থাকে। যেমন ফুটবল খেলায়
পুরুষের উরুর অর্ধেক বা তারও বেশি অংশ খোলা থাকে। হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক
বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি নিজের উরুকে উম্মুক্ত করো না এবং কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির
উরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’ (আবূ দাউদ: ৪০১৭;
শায়খ আলবানী হাদীসটিকে
সহীহ বলেছেন, দেখুন সহীহুল জামে: ৭৪৪১)
(৪) জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া:
খেলাটি এমন হতে হবে যাতে জীবন নাশের
নিশ্চিত বা প্রবল সম্ভাবনা না থাকে। কেননা নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলা বা ধ্বংসের মুখে
ঠেলে দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই।মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন,
وَأَنفِقُواْ
فِي سَبِيلِ اللّهِ وَلاَ تُلْقُواْ بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ
وَأَحْسِنُوَاْ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
আর ব্যয় কর আল্লাহর পথে,
তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের
সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন।
(সূরা: আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫)
(৫) হারাম উপার্জনমুক্ত হওয়া:
খেলা বৈধ হবার আরেক মৌলিক শর্ত হলো, সেটি যেকোনো ধরনের জুয়া ও বাজিমুক্ত হওয়া। খেলাধুলার মাধ্যমে
প্রতিযোগিতামূলক বাজির অর্থ বৈধ উপার্জন নয়। আজকাল আন্তর্জাতিক খেলাধুলায় বাজি এবং
বাজিকে কেন্দ্র করে নানা অনভিপ্রেত ঘটনার উদ্ভব প্রায়ই ঘটতে যায়। ইসলাম এসব অবৈধ উপার্জন
ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বদাই বদ্ধপরিকর। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يَا
أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنصَابُ
وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ
تُفْلِحُونَ
إِنَّمَا
يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي
الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللّهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ
فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম।
সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর
(চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’
(সূরা: আল-মায়িদা, আয়াত: ৯০-৯১)
(৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া:
খেলাধুলাকে শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি
বানালে সে খেলাটি তার স্বাভাবিক বৈধতা হারায়। ভালো খেলার কারণে অতিভক্তি বা খারাপ খেলার
কারণে অতিভক্তি কোনোটাই ইসলামে কাম্য নয়। ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থক কিংবা
ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তানের সমর্থকদের মধ্যে নিজেদের সমর্থিত দল নিয়ে মারামারি, হানাহানি ও শত্রুতা তৈরির ঘটনা পত্র-পত্রিকা প্রায়ই চোখে পড়ে।
মানুষকে শয়তানের এসব দুরভিসন্ধিমূলক ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে তাই মহান আল্লাহ তায়ালা
পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন,
إِنَّمَا
يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي
الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللّهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ
فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
‘নিশ্চয় শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও
বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে তোমাদের বাধা দিতে।
অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’
(সূরা: আল-মায়িদা, আয়াত: ৯১)
এসব শর্তে খেলাধুলার বৈধতা দেওয়া হলেও
বর্তমানে প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন প্রায়ই পরিলক্ষিত হয় না। এসব
খেলার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি, নামাজেরর প্রতি অবহেলা, অন্য ধর্মের অনুসরণ,
সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজিধরা,
রঙখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান,
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কী আঁকা ইত্যাদির বাহুল্য থাকে। তাই এসব খেলাধুলা সম্পূর্ণ
নাজায়েজ ও হারাম।
কারণ, আধুনিক কালে খেলাধুলার নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটেছে। খেলার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনুষঙ্গিক বহু বিষয়। খেলার বৈধতা-অবৈধতার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচ্য।
যেমন এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব খেলার প্রাণ দর্শক-শ্রোতা। দর্শকরাই খেলাধুলার মাধ্যমে
আয়ের প্রধান উৎস। দর্শক না এলে বিশ্বফুটবলের নিয়ন্ত্রক ফিফা কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটের
নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি মাঠে মারা যাবে। এ দর্শকদের কারণেই খেলাধুলা নিয়ে মিডিয়া ও
পুঁজিপতিদের যত আগ্রহ।
সু-প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই/বোন!
উপরের আলোচিত শর্ত
সাপেক্ষে বর্তমান প্রচলিত অনেক খেলাধুলা নাজায়েয ও হারাম। বিশেষ করে এজাতীয় খেলা জুয়া
থেকে মুক্ত নয়। বিধায় প্রশ্নেল্লিখিত ছুরতে বিজয়ী ট্রফিতে যদি কোন মূর্তির প্রতিচ্ছবি
থাকে তাহলে তাতে চুম্বন করা বা সেটিকে নিয়ে সেলিব্রেইট করলে যদিও ইমান ভঙ্গ হবে না
কিন্তু তা নাজায়েয ও হারাম হওয়া থেকে মুক্ত নয়। তবে যদি মূর্তির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা
থেকে উক্ত কাজগুলি করে ফেলে তাহলে ইমান ভঙ্গ হবে।