আসসালামু আলাইকুম। গীবতের গুনাহ থেকে ক্ষমা চাওয়া বিষয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে যে যার গীবত করা হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমি সম্ভবত মুফতি মনসুরুল হকের ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়া ২য় খন্ড থেকে জেনেছি যে, "যার গীবত করা হয়েছে সে যদি জানতে না পারে যে তার নামে গীবত করা হয়েছে তাহলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়াটা জরুরী নয়, শুধু আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চাইলেই হবে।"
প্রসঙ্গত বলতে চাই যে, এমন বিধানই কিন্তু আমার কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারণ, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, একবার এক ভাই আমার কাছে এসে মাফ চেয়ে বলল, আমি আপনার নামে গীবত করেছি। তার অনুনয়-বিনয়ের কারণে যদিও মুখে মাফ করে দিলাম বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু এই ঘটনা আমার বুকে শেলের মতো বিঁধেছে, মনে হয়েছে যে আমি হয়তবা তাকে মন থেকে মাফ করতে পারিনি। কারণ, আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল সে কাকে কী বলেছে আমার নামে। তো একই কথা মানুষের ক্ষেত্রেও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে আমি মনে করি। কেউ যদি কারো কথা প্রসঙ্গে গীবত করে তাহলে সাধারণত যার সামনে গীবত করা হয় সে আলাপ শেষে ভুলে যায়, যার নামে গীবত করা হয় তার কাছে বলে না, তাছাড়া যে মজমায় গীবত হয় সেই মজমায় যারা থাকে সবাই গীবত করে, কাজেই কেউ এসব মনে রাখে না। যেমন ধরুনঃ আমি আপনাকে বললাম, অমুক ভাই খুব খেতে পারে! এই কথা কিন্তু এখানেই শেষ। আপনি কোনোদিনই তার কাছে গিয়ে বলবেন না যে আমি তার ব্যাপারে এই কটুক্তি করেছি। কারণ এটা ম্যাচুরিটির ব্যাপার, এটা কথার মধ্যে বলা হয়ে যায়, কিন্তু কারো সামনে গিয়ে খাসভাবে উপস্থাপন করার মতো নয়। তাছাড়া যার নামে গীবত করছি তার সাথে যে আমার শত্রুতা আছে এমনটাও নয়, আপনার সাথে এবং তারসাথে উভয়ের সাথেই আমার সুসম্পর্ক আছে, হয়ত আমরা একসাথেই চাকরি করি-এরকম। এমনও হতে পারে যে একদিন তার সাথে আলাপ করতে গিয়ে আপনার নামেও একটা বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছি। অথচ আপনার সাথে দিব্যি সুসম্পর্ক রেখে চলেছি। অর্থাৎ, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি যে, আমরা নিজ বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-কলিগ-চেনাপরিচিত-সহপাঠী-শিক্ষক প্রভৃতির সাথে সুসম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই কমবেশি একে অপরের ব্যাপারে অন্যের কাছে কথা প্রসঙ্গে গীবত করে ফেলি, এই গীবতের পেছনে উক্ত ব্যক্তির ক্ষতি করারও উদ্দেশ্য থাকে না, সম্মানহানী করারও উদ্দেশ্য থাকে না, তার সাথে কারো শত্রুতা সৃষ্টি করারও উদ্দেশ্য থাকে না। এই কারণে যার সামনে গীবত করছি, মোটামুটি তার ব্যাপারে আস্থা থাকে যে সে এই কথা বৈঠক শেষ হলেই ভুলে যাবে, যার নামে গীবত করছি তাকে গিয়ে লাগিয়ে আসবে না। বাস্তবিকও তাই হয়, আমরা চলতে ফিরতে যত গীবত করি যদি যার নামে গীবত করা হয়েছে সে জানতে পারত তাহলে হয়ত কারো সাথেই চলাফেরা করতে পারতাম না।
এহেন পরিস্থিতিতে বিবেকের দাবি কী? কেন যার নামে গীবত করা হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়? তার কারণ, তার মনে কষ্ট দেওয়া হয়েছে, যা তার একটি হক নষ্ট করার শামিল। কিন্তু আমি যে ক্ষেত্র বর্ণনা করেছি সেখানে তো তাকে কোনো কষ্ট দেওয়া হয়নি, তার কোনো ক্ষতিও করা হয়নি, কাজেই তার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ারই বা প্রয়োজন কী? বরং তাকে গীবতের ব্যাপারটা জানিয়ে ক্ষমা চাইতে গেলেই সে কষ্ট পাবে। অর্থাৎ, ব্যাপারটা যেন এমন যে তাকে একটি তীর মেরেছিলাম, তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল, পরে সেই তীর হাতে করে নিয়ে গিয়ে বর্ষার মতো তার বুকে বিঁধিয়ে দিয়ে আসলাম। এসব চিন্তা করে মুফতি মনসুরুল হকের ফতোয়াটিই আমার কাছে সমাজে অধিক প্রচলিত ্মতটির চেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। তাছাড়া এভাবে গীবতের ক্ষমা চাইতে গেলে ক্ষমা চাওয়াও সহজ হয়, কারণ অনেক সময় মনেও থাকে না কার নামে কখন কী গীবত করেছি। সেক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমা পেয়ে গেলে জীবন বড় সহজ হয়, ইবাদতে মন বসে। যদিও এটা ঠিক যে, গীবত চিরতরে বর্জন করার ট্রিটমেন্ট হিসেবে সমাজে প্রচলিত মতটিই অধিক কার্যকর। অর্থাৎ, যার নামে গীবত করেছি তার কাছে ক্ষমা চাইলে গীবত বর্জন করা সহজ হবে। তবে এটা গীবতের রোগ থেকে মুক্তির ট্রিটমেন্ট হতে পারে, কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার শর্ত হতে পারে কি? মুফতি মনসুরুল হকের কথার প্রায় অনুরূপ একটি মাসলা ইন্টারনেটেও পেলামঃ
https://seekersguidance.org/answers/general-counsel/repent-gossiping-people/
যাই হোক, আপনার নিকট আমার প্রশ্ন হলো, মুফতি মনসুরুল হকের উক্ত ফাতওয়াটির উপর আমল করে অর্থাৎ, যার নামে গীবত করেছি যদি সে জানতে না পারে তাহলে তার কাছ থেকে ক্ষমা না চেয়ে শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে মাফ পাওয়া যাবে কিনা?