এসব মাদ্রাসার প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ইসলাম ধর্ম, ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও রীতিনীতি সম্পর্কে দক্ষ করে তোলা।
এর অর্থ গোষ্ঠী, গোত্র,জাতি, সম্প্রদায়, জনগণ। কওমি অর্থ হলো গোত্রীয়, জাতীয়, জনগণ সম্পর্কিত। শব্দ দু'টি এই অর্থে ফার্সি এবং উর্দু ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। মাদ্রাসাও আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো অধ্যয়নের স্থান , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল। একই অর্থে শব্দটি উর্দু ও ফার্সি ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। সুতরাং ‘কওমি মাদ্রাসা’ এর মানে হলো জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জাতীয় বিদ্যাপীঠ।
যেহেতু কওমি মাদ্রাসা সাধারণত সরকারি অনুদানের পরিবর্তে পুরোপুরি জনসাধারণের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাই হয়তো এ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কওমি মাদ্রাসা বলা হয়।
কওমী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত বেসরকারি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে "আল জামেয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম দেওবন্দ" নামে। কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণত সরকারি আর্থিক সহায়তার পরিবর্তে মুসলিম জনসাধারণের সহায়তায় পরিচালিত হয়।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা বহুল প্রচলিত। ভারত উপমহাদেশের পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে উপমহাদেশের বাইরে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণত দারুল উলুম বা "দেওবন্দি মাদ্রাসা" নামে পরিচিত।
১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার নতুন ধারা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৪ সালের পরবর্তীকালে।
সময়ের ব্যবধানে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
বহু বছর ‘দরসে নিজামী’ ছিল উভয়ধারার মাদরাসার অভিন্ন পাঠ্যক্রম। ফিকহ, আরবি সাহিত্য, মানতিক, হিকমত ও প্রাচীন দর্শন ছিল এ পাঠ্যক্রমের বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে সিহাহ সিত্তাহ বা ষষ্ঠ প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থ সংযোজিত হয়। এগুলো হলো বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসায়ি ও ইবনে মাজাহ। সময়ের ব্যবধানে সিলেবাসে পরিবর্তন এসেছে।
তাকমীল বা দাওরায়ে হাদিস স্তরে শিক্ষার্থীরা মূলত হাদিস সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়।
★★কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে যা আছে
কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার স্তর রয়েছে ছয়টি। এর প্রাক-প্রাথমিক স্তরকে বলা হয় মক্তব হিফজুল কোরান। এই স্তরে মূলত কোরান পড়তে শেখানো হয় এবং কোরান শরিফ মুখস্ত করানো হয়।
কওমি মাদ্রাসার দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে ইবতেদায়ি। এটি মূলত প্রাথমিক পর্যায় যেখানে শিক্ষার্থীদের আরবি, উর্দু ও ফার্সি পড়তে ও লিখতে শেখানো হয়। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কিছুমাত্রায় বাংলা, ইংরেজি ও গণিতও শেখানো হয়।
কওমিতে ১০ বছর পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক সমতুল্য মুতাওয়াসিত্তাহ পরীক্ষায় বসতে হয়। এর পরে রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের কোরান শরিফ ছাড়াও হাদিস, ইসলামি আইন, ইসলামি দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস পড়তে হয়।
কওমি মাদ্রাসার খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে যান।
এর আগে, কওমি মাদ্রাসা থেকে অর্জিত ডিগ্রির কোনও অনুমোদন বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। তবে বেশিরভাগ কওমি মাদ্রাসাকে বেসরকারিভাবে পরিচালিত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নিয়ে আসার পর সম্প্রতি সরকার কওমি ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির পরও কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ পর্যায় দাওরায়ে হাদিসে (স্নাতকোত্তর) মূলত ধর্মীয় শিক্ষাই দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে মূলত হাদিস বিষয়ে বিস্তারিত শেখানো হয় শিক্ষার্থীদের।
স্নাতকোত্তর সমমান দেওয়া দাওরায়ে হাদিস দুই বছরের কোর্স। এই কোর্সে ইমাম মোহাম্মদ আল বুখারির সংকলিত সহিহ বুখারি শরিফ, ইমাম মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ আল-নায়সাবুরি সংকলিত সহিহ মুসলিম শরিফসহ হাদিসের অন্যান্য গ্রন্থগুলো পড়ানো হয়।
কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি-বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের মতো বিষয়গুলো পড়ানো হলেও কোরান ও হাদিস ছাড়া বাকি সব বিষয়েই মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আবার রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাস পড়ানো হয় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেফাকুল মাদারাসিলি আরাবিয়ার প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞানের কোনও বিষয়। এসব ক্লাসের প্রায় সব বই-ই কোরান শরিফ ও আরবি ভাষার ওপর ভিত্তি করে রচিত। আরবি, বাংলা, গণিত ও ইংরেজি ছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয় উর্দু। ‘উর্দু কা কায়দা’ নামের ওই বই প্রকাশ করে পাকিস্তানের আঞ্জুমান-ই-হিমায়াত-ই-ইসলাম অব লাহোর। মূলত উর্দু বর্ণমালার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এই বইয়ের মাধ্যমে।
কওমি মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভূগোল, সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক কিছু বিষয় পড়ানো হয়। তবে এই শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের মূলত পড়তে হয় দ্বিনিয়াত ও তাজবিদ এবং ইসলামিক ফিকাহ ও তাহজিব নিয়ে।
কওমি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণিতে অন্যান্য বিষয়ে সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ। এই শ্রেণির উর্দু বইও পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত। এছাড়া, পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে যুক্ত হয়েছে ফার্সি ভাষা শিক্ষা।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের ইতিহাস অনুপস্থিত। অন্যদিকে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ইতিহাস পড়ানো হয় না। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ানো হয় ৫০ নম্বরের ইতিহাস।
নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের সূচনায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ‘তারিখ উল ইসলাম’ নামে আড়াইশ পৃষ্ঠার একটি বই পড়ানো হয়। উর্দু ভাষায় লেখা এই বইয়ের বিষয়বস্তু ইসলামের ইতিহাস। এর লেখক শায়েখ মুহাম্মদ মিয়া। সপ্তম শ্রেণিতেও পড়ানো হয় উর্দু ভাষায় মুফতি মুহাম্মদ শাফির লেখা ‘সিরাত খাতিম উল আমবিয়া’ বইটি। আর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ানো হয় ভারতে ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাসভিত্তিক বই ‘তারিখ মিল্লাত প্রথম খণ্ড: খিলাফত-ই-রাশিদা’।
কওমি মাদ্রাসায় দুই বছরের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ানো হয়।
এই পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে উপমহাদেশের ইতিহাসও পড়ানো হয় না, তবে বনি উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস পড়ানো হয়। দশম শ্রেণির বইয়ে আছে উসমানি খিলাফত, ফাতিমি খিলাফত ও বনি উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১০০ নম্বরের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি কোর্স। আর স্নাতক পর্যায়ে দেওবন্দ আন্দোলনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও এর অবদান সম্পর্কে পড়ানো হয়ে থাকে।
★★যা শেখানো হয় আলিয়া মাদ্রাসায়
আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণ বিভাগে শিক্ষার্থীদের ইসলামি শিক্ষা, কলা ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়। তাদের পাঠ্যসূচিতে কোরান, আরবি, ইসলামের ইতিহাস ছাড়াও রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান ও আইসিটি পড়ানো হয়। অন্যদিকে, মুজাব্বিদ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অন্যান্য সাধারণ বিষয়ের সঙ্গে পড়ানো হয় তাজবিদ। বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে হয় কোরান, হাদিস, ইসলামি আইন ও আরবি।
আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে দাখিল (এসএসসি সমমান) ও আলিম (এইচএসসি সমমান) পর্যায়ে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে পড়ানো হয় না।
আলিয়া মাদ্রাসায় ইবতেদায়ি থেকে কামিল পর্যন্ত ১৬ বছরের পড়ালেখায় রয়েছে পাঁচটি ধাপ। ইতবেদায়ি বা প্রাথমিক পর্যায়ে কোরান শরিফ পড়া ও মুখস্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। এই পর্যায়ের অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামের মৌলিক বিষয়, আরবি, বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও সাধারণ বিজ্ঞান।
দাখিল (মাধ্যমিক) পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা বা তাফসির। এই পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের আরবি, ইসলামি দর্শন, ইসলামি আইন ও তত্ত্ব এবং এগুলোর ব্যবহার পড়ানো হয়।
আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যায়ে বিজ্ঞান বা কলা বিভাগকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে শিক্ষার্থীদের জন্য। উভয় বিভাগের শিক্ষার্থীদেরই কোরান ও হাদিস, ইসলামি আইন, শরিয়া আইন, উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামের ইতিহাস পড়তে হয়। অন্যদিকে, কলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের আরবি ও ফার্সি ভাষা এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয় পড়তে হয়।
স্নাতক পর্যায়ে ফাজিল কোর্সে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের বিষয়গুলো আলাদা আলাদা করে শেখানো হয়। অন্যদিকে, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কামিল কোর্সে শিক্ষার্থীদের কেবল ধর্ম বিষয়ে পড়ানো হয়। এই পর্যায়ে এসে তাদের হাদিস, তাফসির (কোরান শরিফের ব্যাখ্যা), ইসলামি আইন ও আরবি সাহিত্য বিশেষায়িতভাবে পড়ানো হয়।