সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোনো পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে জুলুম বলে। তবে জুলুমের সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা হলো, কোনো কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোনো স্থানে প্রয়োগ করা বা রাখা। এই সংজ্ঞাটি ব্যাপক অর্থবহ। সব ধরনের জুলুম এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
★জুলুম কাকে বলে? ما معنى الظلم
والظلم هو وضع الشيء في غير محله باتفاق أئمة اللغة
ভাষা বিদদের ঐক্যমতে কোন বস্তুকে তার আসল স্থানে না রেখে অন্য স্থানে রাখার নাম হচ্ছে জুলুম।
★জুলুমের প্রকারভেদঃ أنواع الظلم
জুলুম প্রথমত তিন প্রকার।
১) আল্লাহর এবাদতের ক্ষেত্রে জুলুমঃ الظلم في العبادة
মানুষের উপর আবশ্যক হল তারা তাদের সকল এবাদকে সঠিক স্থানে রাখবে তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করবে। কিন্তু অনেক মানুষ তা না করে তাঁর এবাদতে এমন এমন বস্তুকে শরীক করে থাকে, যা এবাদত পাওয়ার কোন অধিকারই রাখে না। যেমন মূর্তি, গাছ, পাথর, অলী-আওলীয়া ইত্যাদিকে মানুষ আল্লাহর সাথে শরীক নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের বাংলাদেশসহ আরও অনেক মুসলিম দেশের মাজারগুলোতে যে ধরণের শির্কের বাজার জমে উঠেছে, তা সুস্পস্ট ও বিরাট একটি জুলুম। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
নিশ্চয়ই শিরক একটি বিরাট জুলুম। (সূরা লুকমানঃ ১৩)
২) বান্দা কর্তৃক তার নফসের উপর জুলুমঃ ظلم الإنسان لنفسه
মানুষ তার কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে নানা অপরাধ ও পাপকাজে লিপ্ত হয় এবং তাঁর প্রভুর নির্ধারিত সীমা লংঘন করে থাকে। সেই সাথে তারা ওয়াজিব ও ফরজ এবাদতগুলো পালনে অলসতা করে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا ظَلَمَهُمُ اللّهُ وَلـكِن كَانُواْ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
আর আল্লাহ তাদের উপর জুলুম করেন নি। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করতো। (সূরা নাহলঃ ৩৩)
৩) আল্লাহর সৃষ্ট ও তাঁর বান্দাদের উপর মানুষের জুলুমঃ ظلم الإنسان لغيره من عباد الله ومخلوقاته
এই প্রকারের জুলুম হয়ে থাকে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা, মারপিট, গালিগালাজ ইত্যাদির মাধ্যমে। সাধারণত সমাজের দুর্বল ও অসহায়দের উপরই এ প্রকারের জুলুম বেশী হয়ে থাকে।
বান্দার পারস্পরিক জুলুমের কিছু নমুনাঃ صور من ظلم الإنسان لغيره من عباد الله ومخلوقاته
ক) কারও যমিন অন্যভাবে জবর দখল করাঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مَنْ ظَلَمَ قِيدَ شِبْرٍ مِنَ الْأَرْضِ طُوِّقَهُ مِنْ سَبْعِ أَرَضِينَ
“যে ব্যক্তি কারো অর্ধহাত জমিন জবরদখল করবে কিয়ামত দিবসে তার গলায় সাতটি যমিন ঝুলিয়ে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
খ) অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করাঃ
,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, সে ঘাড়ে একটি চিৎকাররত ছাগল কিংবা ঘোড়া বহন করছে। সে আমাকে ডেকে বলছেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন!! তখন আমি বলবঃ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবোনা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তোমাদের কেউ যেন কিয়ামতের দিন গলায় এমন একটি উট ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে যে উটটি আওয়াজ করতে থাকবে। সে বলবেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!! আমি তখন বলবঃ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবনা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তোমাদের কেউ যেন কিয়ামতের দিন গলায় স্বর্ণ-রৌপ্য ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে। সে বলবেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!! তখন আমি বলবঃ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবোনা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তোমাদের কেউ যেন কিয়ামতের দিন গলায় কাপড়ের বোঝা ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে। সে বলবেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন!! তখন আমি বলবঃ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবনা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছি”। (বুখারী)
গ) বিনা কারণে কোন প্রাণীকে কষ্ট দেয়াঃ বিনা প্রয়োজনে কোন প্রাণী হত্যা করাও জুলুম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
عُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ فَرَأَيْتُ فِيهَا امْرَأَةً مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ تُعَذَّبُ فِي هِرَّةٍ لَهَا رَبَطَتْهَا فَلَمْ تُطْعِمْهَا وَلَمْ تَدَعْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ
“আমার কাছে জাহান্নামকে পেশ করা হল। তাতে দেখলাম বনী ইসরাঈলের একটি মহিলাকে একটি বিড়াল হত্যা করার অপরাধে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। উক্ত মহিলা বিড়ালটিকে বেধে রাখত। সে নিজেও বিড়ালকে কোন কিছু খেতে দেয়নি এবং যমিন থেকে পোকা-মাকড় ধরে খাওয়ার জন্য ছেড়েও দেয়নি। এভাবে ক্ষুধার তাড়নায় বিড়ালটি মৃত্যু বরণ করল।
ঘ) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করাঃ মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا
“যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করে নিশ্চয় তারা স্বীয় উদরে অগ্নি ব্যতীত কিছুই ভক্ষণ করে না এবং সত্বরই তারা প্রজ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করবে”। (সূরা নিসাঃ ১০)
ঙ) বিনা কারণে কাউকে হত্যা তরা, সুদ খাওয়া, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদিঃ যারা বিনা কারণে এবং আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
اجْتَنِبُوْاالسَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ
“তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় হতে বিরত থাকবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন সেগুলো কি কি? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তা হলো (১) আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করা (২) যাদু করা (৩) আল্লাহ তা’আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা (৬) যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা (৭) সতী-সাধ্বী মু’মিন মহিলার প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া”।
এমনিভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মানুষকে কষ্ট দেয়া, চুরি করা, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, শ্রমিকের অধিকার নষ্ট করা, আমানতের খেয়ানত করা, মানুষের গিবত করা, মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করা, ওয়াদা-অঙ্গিকার ভঙ্গ করাসহ আরও অসংখ্য জুলুম রয়েছে, যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
★রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলুমঃ ظلم الحكومات
বর্তমান কালে যে জুলুমটি দিবালোকের মত সুষ্পষ্ট ও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে জুলুম। এ ক্ষেত্রে আমরা মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান বা সরকারের পক্ষ হতে জন সাধারণের উপর যে জুলুম হচ্ছে তার কিছু উদাহরণ পেশ করার চেষ্টা করবো।
যুগে যুগে অনেক জালেম সরকার বা রাষ্ট্র নায়ক পৃথিবীর বুকে আগমণ করেছে। তাদের প্রত্যেকেই করুণ ও ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ফেরাউন ভেবেছিল সে দুর্বলের উপর জুলুম করে চিরস্থায়ী হতে পারবে। কিন্তু সে আল্লাহর পাকড়াও হতে রেহাই পায় নি। কুরআন বলছে, সকাল-বিকাল ফেরাউন সম্প্রদায়ের সামনে জাহান্নামের আযাব পেশ করা হয়। কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে।
নমরুদ তাই ভেবেছিল। সেও একই ভাবে পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছে। এমনি আরও অনেক সৈরাচার পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে আল্লাহর বান্দাদেরকে কষ্ট দিয়ে শেষ রক্ষা পায়নি।
★★দৈনন্দিন যেসব সূক্ষ সূক্ষ কথা- কাজেও জুলুম পাওয়া যায় যেগুলো জুলুম মনে করা হয় না অথচ জুলুম,সেগুলোঃ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মানুষকে কষ্ট দেয়া, চুরি করা, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, শ্রমিকের অধিকার নষ্ট করা, আমানতের খেয়ানত করা, মানুষের গিবত করা, মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করা, ওয়াদা-অঙ্গিকার ভঙ্গ করা। বিনা কারণে কোন প্রাণীকে কষ্ট দেয়া,
জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এটি। অন্যের ওপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। আপদ-বিপদ ও দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জুলুম।
তাই আল্লাহ তাআলা সবাইকে তা থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন।
হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩৭)
আল্লাহ তাআলা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)