রোযার কারণে যে রোগ বৃদ্ধি পায় বা রোগ-ভোগ দীর্ঘ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে সে রোগে রোযা ভাঙ্গার অবকাশ আছে। উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে।-আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২২
রোগের কারণে ডাক্তার যদি বলে, এ রোজার কারণে রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বা সুস্থতা বিলম্বিত হতে পারে, তাহলে রোজা ভাঙা যায়। কিন্তু সামান্য অসুখ, যেমন—মাথাব্যথা, সর্দি, কাশি অনুরূপ কোনো সাধারণ রোগ-বালাইয়ের কারণে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ নয়। মনে রাখতে হবে, রোগের কারণে যেসব রোজা ভঙ্গ হয়, সেগুলো পরে একটির বদলে একটি করে কাজা করে নিতে হবে।
রোজা পালনে রোগ বৃদ্ধি পেলে পরহেজগারি মনে করে রোজা পালন করা অনুচিত। এ অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
অতিশয় বৃদ্ধের জন্য রোজা পালন জরুরি নয়। তবে ওই ব্যক্তি অন্য কাউকে দিয়ে কাজা আদায় করাবে বা ফিদিয়া দেবে। প্রতিটি রোজার জন্য একজন মিসকিনকে এক বেলা খাবার খাওয়াবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শক্তিহীনদের কর্তব্য হচ্ছে ফিদিয়া দেওয়া, এটা একজন মিসকিনকে অন্নদান করা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৪)
মৃত্যুমুখী বৃদ্ধলোক অথবা এমন রোগে আক্রান্ত হলে, যা থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এমন অক্ষম ব্যক্তি প্রতিটি রোজার পরিবর্তে পৌনে দুই সের গম (ফিতরার পরিমাণ) অথবা তৎপরিমাণ মূল্য আদায় করবে। ইসলামের পরিভাষায় এটাকে ফিদিয়া বলা হয়। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ : খ. ১, পৃ. ২৯)
ইমাম কুরতুবী রহঃ বলেন (২/২৭৬):
"রোগীর অবস্থা দুটো: ১। মোটেই রোযা রাখার সক্ষমতা না থাকা; তার জন্য রোযা না-রাখা ওয়াজিব। ২। কিছু শারীরিক ক্ষতি ও কষ্টের সাথে রোযা রাখতে সক্ষম হওয়া। এ ব্যক্তির জন্য রোযা না-রাখা মুস্তাহাব। এমতাবস্থায় কেবল অজ্ঞ লোকই রোযা রাখে।"
বার্ধক্যজনিত কারণে রোযা রাখতে সক্ষম না হলে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে একজন গরীবকে দুবেলা খাবার খাওয়াবে অথবা পৌনে দু কেজি গমের মূল্য সদকা করবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ
আর যাদের রোযা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদয়া-একজন মিসকীনকে খাবার প্রদান করবে।-সূরা বাকারা : ১৮৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭
যে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই এমন ব্যক্তি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া প্রদান করবে।-সূরা বাকারা : ১৮৪
,
ছাবেত বুনানী রাহ. বলেন, আনাস ইবনে মালেক রা. যখন বার্ধক্যের কারণে রোযা রাখতে সক্ষম ছিলেন না তখন তিনি রোযা না রেখে (ফিদয়া) খাবার দান করতেন।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযযাক, হাদীস : ৭৫৭০
,
ইকরিমা রাহ. বলেন, ‘‘আমার মা প্রচন্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোযা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘প্রতি দিনের পরিবর্তে মিসকীনকে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম প্রদান করবে’।’’-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৮১
এক রোযার পরিবর্তে এক ফিদয়া ফরয হয়। এক ফিদয়া হল, কোনো মিসকীনকে দু বেলা পেট ভরে খানা খাওয়ানো অথবা এর মূল্য প্রদান করা।
হযরত সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব রাহ. বলেন-
وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ
এই আয়াত রোযা রাখতে অক্ষম বৃদ্ধের জন্য প্রযোজ্য।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৮৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৬
,
★প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই বোন,
প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যাক্তির অবস্থা যদি এমন হয় যে অভিজ্ঞ ডাক্তার তার সম্পর্কে বলে যে এই অবস্থায় রোযা তার শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
রোগ বৃদ্ধি পাবে বা রোগ-ভোগ দীর্ঘ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা আছে,তাহল সে ব্যাক্তি রোযা না রাখতে পারবে।
পরবর্তীতে এর কাজা আদায় করবে,যদি সে আর সুস্থ না হয়,তাহলে সে প্রত্যেক রোযার জন্য ফিদিয়া আদায় করবে ।
,
(০২)
হাদীস শরীফে এসেছেঃ
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ، عَنْ مَالِكٍ، عَنْ أَبِي الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " الصِّيَامُ جُنَّةٌ، فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَجْهَلْ، وَإِنِ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ. مَرَّتَيْنِ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ تَعَالَى مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ، يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي، الصِّيَامُ لِي، وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا ".
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মুর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তাঁর সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাঁকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুই বার বলে, আমি সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সাওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। সিয়াম আমারই জন্য। তাই এর পুরষ্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুন।
(বুখারী ১৭৭৩)
حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ مَخْلَدٍ، حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلاَلٍ، قَالَ حَدَّثَنِي أَبُو حَازِمٍ، عَنْ سَهْلٍ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ، فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ "
খালিদ ইবনু মাখলাদ (রহঃ) ... সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জান্নাতে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাঁদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তাঁরা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।
(বুখারী শরীফ ১৭৭৫)
حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا هِشَامٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ".
মুসলিম ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করা হবে। আর যে ব্যাক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানে সিয়াম পালন করবে, তাঁরও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে।
(বুখারী শরীফ ১৭৮০)
সালমানরাদিয়াল্লাহুআনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিস ইবনে খুযাইমা তাঁর “সহীহ”নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।তিনি বলেন: “রমজান মাসের ফযিলতশীর্ষকপরিচ্ছেদ;যদি এ হাদিসটিসহীহ সাব্যস্ত হয়”।
এরপর তিনি বলেন: আমাদের নিকট আলীইবনেহুজরআল-সাদী হাদিস বর্ণনা করেছেন;তিনি বলেন: আমাদের নিকটইউসুফ ইবনেযিয়াদ হাদিস বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন: আমাদের নিকট হুমামইবনেইয়াহইয়া হাদিস বর্ণনা করেছেন আলী বিন যায়িদ বিন জাদআন হতে; তিনিসাঈদইবনে আল-মুসাইয়্যিব হতে, তিনি সালমান (রাঃ) হতে;তিনি বলেন:
একবার শাবান মাসের শেষ দিনরাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামআমাদের উদ্দেশ্যে খোতবা (ভাষণ) দিলেন। খোতবা দিতে গিয়ে তিনি বলেন: “হে লোকেরা! আপনাদের নিকট এক মহান মাসহাজির হয়েছে। এক বরকতময় মাস এসেছে। এ মাসে এমন এক রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এমাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ ফরজ (আবশ্যকীয়) করেছেন এবং এ মাসের রাতে কিয়াম (নামায আদায়) করানফল (ফজিলতপূর্ণ) করেছেন। এ মাসে যে কোন একটি (নফল)ভালো কাজ করা অন্য মাসে একটি ফরজ কাজ করার সমান। আর এ মাসে কোন একটি ফরজআমল করা অন্য মাসে সত্তরটি ফরজআমল করার সমান। এটি হল- ধৈর্য্যের মাস; ধৈর্য্যের প্রতিদান হচ্ছে- জান্নাত। এটি হল- সহানুভূতির মাস। এটি এমন এক মাস যাতে একজন মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি পায়। এ মাসে যে ব্যক্তিকোন একজন রোজাদারকে ইফতার করাবেতার সমূহ গুনাহ মাফ করেদেয়া হবে,সে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে এবং তাকে সেই রোজাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে;কিন্তু রোজাদারের সওয়াবে কোন কমতি করা হবে না।তাঁরা বললেন- আমাদের মধ্যে সবার তো একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মত সামর্থ্য নেই।তিনি বললেন: কোন ব্যক্তিযদি একজন রোজাদারকে একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি অথবা এক চুমুক দুধ দিয়েও ইফতার করায়আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দিবেন। এটি এমন মাস এর প্রথম ভাগে রহমত, দ্বিতীয় ভাগে মাগফিরাত এবং শেষ ভাগে রয়েছেজাহান্নামহতেনাজাত। আর যে ব্যক্তি তার কৃতদাসের দায়িত্ব সহজ করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দিবেন। সুতরাং এ মাসে আপনারা চারটি কাজ বেশি করে করুন। দুটি হল যা দিয়ে আপনারা আপনাদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবেন। আর দুটি কাজ এমন যা আপনাদের না করলেই নয়।যে দুটি কাজ দ্বারা আপনারা আপনাদের রব্বকে সন্তুষ্ট করবেন: (১) এ বলে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং (২) তাঁর কাছে ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আর যে দুটো কাজ আপনাদের না করলেই নয় (৩) আপনারা আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবেন এবং (৪) জাহান্নামের আগুন থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। আর এইমাসে যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাওয়াবে আল্লাহ তাঁকে আমার হাউজ থেকে এক ঢোক পানি পান করাবেন যার ফলে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না।”
,