কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজে খাওয়া,এক ভাগ গরিব মিসকিন,আরেক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া মুস্তাহাব।
তবে তিনভাগ না করে পুরো গোশত বা অধিকাংশ গোশত নিজে খাওয়াও জায়েজ আছে।
কেননা তিন ভাগ করা এটি আবশ্যকীয় বিধান নয়।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، وَمُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ نُمَيْرٍ، وَمُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، - وَاللَّفْظُ لأَبِي بَكْرٍ وَابْنِ نُمَيْرٍ - قَالُوا حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ فُضَيْلٍ، عَنْ أَبِي سِنَانٍ، - وَهُوَ ضِرَارُ بْنُ مُرَّةَ - عَنْ مُحَارِبِ بْنِ دِثَارٍ، عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا وَنَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الأَضَاحِيِّ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَأَمْسِكُوا مَا بَدَا لَكُمْ وَنَهَيْتُكُمْ عَنِ النَّبِيذِ إِلاَّ فِي سِقَاءٍ فَاشْرَبُوا فِي الأَسْقِيَةِ كُلِّهَا وَلاَ تَشْرَبُوا مُسْكِرًا "
আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র ও মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না (রহঃ) [শব্দগুলোর আবূ বাকর ও ইবনু নুমায়র এর] ... ইবনু বুরায়দাহ (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বুরায়দাহ ইবনু হুসায়ব ইবনু আবদুল্লাহ (রাযিঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে কবর বিয়ারাত করতে নিষেধ করতাম। (এখন অনুমতি দিচ্ছি) তোমরা কবর যিয়ারাত করতে পার। আমি ইতোপূর্বে তিনদিনের বেশী কুরবানী গোশত রাখার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করতাম। এখন তোমাদের যতদিন ইচ্ছা রাখতে পার। এছাড়া আমি তোমাদেরকে পানির পাত্রে নবীয তৈরি করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা যে কোন পানির পাত্রে তা তৈরি করতে পার। তবে নেশার বস্তু (মাদকদ্রব্য) পান করো না।
(মুসলিম শরীফ ২১৫০.ইসলামী ফাউন্ডেশন ২১২৯, ইসলামীক সেন্টার ২১৩২)
ইমাম আহমাদ বলেন: আমাদের অভিমত হল আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রাঃ) এর হাদিস: "সে নিজে এক তৃতীয়াংশ খাবে, এক তৃতীয়াংশ খাওয়াবে (যে চায়); আর এক তৃতীয়াংশ মিসকীনদেরকে দান করবে।" হাদিসটি আবু মুসা আল-ইসফাহানি "আল-ওয়াযায়িফ" নামক গ্রন্থে বর্ণনা করার পর বলেন: এটি হাসান হাদিস এবং ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে উমর (রাঃ) এর অভিমত। সাহাবীদের মধ্যে অন্য কেউ এ দুইজনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন মর্মে জানা যায় না।[আল-মুগনী (৮/৬৩২)]
★সু-প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই,
কুরবানী দাতা এক ভাগ নিজের জন্য,এক ভাগ গরিব মিসকিন দের জন্য,আরেক ভাগ আত্মীয়স্বজনদেরকে দেয়ার জন্য গোশত তিন ভাগ করতে পারেন।
এটি মুস্তাহাব,তবে তাহা কোনোভাবেই ওয়াজিব,আবশ্যকীয় নয়।
এমনটি না করলে কোনো গুনাহ হবেনা।
★সুতরাং প্রশ্নে উল্লেখিত ছুরতে সমাজে ভাগ দেয়ার নামে যেটি চালু আছে,সেটি আবশ্যকীয় কিছু নয়।
এক্ষেত্রে কেউ কাউকে গোশত দেয়ার উপর চাপ দিতে পারবেনা।
কেউ স্ব-ইচ্ছায় দিতে চাইলে দিতে পারে,চাপ দেয়া হলে এটি নাজায়েজ হবে।
গরিবদের গোশত দেয়ার নিমিত্তে সমাজে গরিবদের এক অংশ দেয়া যায়। যাহা শুধু গরিবদের মাঝেই বন্টন করে দেয়া বাঞ্চনীয়।
কেননা এখানে অনেক সনয় মান্নতের পশুর গোশতও থাকে, যাহা ধনীর জন্য নেয়া জায়েজ নেই।
★সমাজে গোশত দেয়া ও নেয়ার যে প্রচলন রয়েছে,এতে অনেক সমস্যা রয়েছেঃ-
অনেক মানুষ নিজেদের বিবেচনামতো কুরবানীর গোশত নানাজনকে হাদিয়া কিংবা সদকা করতে চান। তদ্রূপ চামড়াও নিজের বিবেচনামত সদকা করতে চান। কিন্তু এই সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হন, নিজের স্বাধীন বিবেচনামতো করতে পারেন না। অথচ কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যের জন্য হালাল নয়। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘ কোনো মুসলমানের সম্পদ তার মনের সন্তুষ্টি ব্যতিত হালাল নয়। -মুসনাদে আহমাদ; শুআবুল ঈমান
অনেক মানুষ আছেন যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক বন্ধনের কারণে প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য, এ ধরনের বাধ্যবাধকতাহীন বিষয়াদিতে বাধ্যবাধ্যকতা আরোপ করা মোটেই দুরস্ত নয়।
এ ধরনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপের একটি ক্ষতি হল, সমাজের লোকজনের মধ্যে কাহারো সম্পদ সন্দেহজনক, কাহারো আয়-রোযগার হারাম, কিন্তু তার কুরবানীর গোশতও সবাইকে খেতে হচ্ছে।
পাশাপাশি এখানে আরো একটি সমস্যা হল কোন কিছু কাউকে হাদিয়া দেওয়ার পর সেটা ফেরত নেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই নিন্দনীয়।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْعَائِدُ فِي هِبَتِهِ كَالْكَلْبِ يَعُودُ فِي قَيْئِهِ لَيْسَ لَنَا مَثَلُ السوء» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দান করে ফেরত নেয়, সে কুকুরের সদৃশ; সে স্বীয় বমি পুনরায় খায়। আমাদের মাঝে এই নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত কাম্য নয়।
বুখারী ২৬২২, নাসায়ী ৩৬৯৯, তিরমিযী ১২৯৮, আহমাদ ১৮৭২, সহীহ আল জামি‘ ৫৪২৬।
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: حَمَلْتُ عَلَى فَرَسٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَأَضَاعَهُ الَّذِي كَانَ عِنْدَهُ فَأَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِيَهُ وَظَنَنْتُ أَنَّهُ يَبِيعُهُ بِرُخْصٍ فَسَأَلْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «لَا تَشْتَرِهِ وَلَا تَعُدْ فِي صَدَقَتِكَ وَإِنْ أَعْطَاكَهُ بِدِرْهَمٍ فَإِنَّ الْعَائِدَ فِي صَدَقَتِهِ كَالْكَلْبِ يَعُودُ فِي قَيْئِهِ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «لَا تَعُدْ فِي صَدَقَتِكَ فَإِنَّ الْعَائِدَ فِي صَدَقَتِهِ كالعائد فِي قيئه»
’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে আল্লাহর পথে সওয়ার হবার জন্য ঘোড়া দান করলাম। সে এ ঘোড়াটি নষ্ট করে ফেলল। (তখন) আমি ঘোড়াটিকে কিনে নেবার ইচ্ছা করলাম। আমার ধারণা ছিল, সে কম দামে ঘোড়াটি বিক্রি করবে। এ সম্পর্কে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তুমি ওটা কিনো না। আর দান করা জিনিস ফেরতও নিও না যদি তা তোমাকে এক দিরহামের বিনিময়েও দেয়। কারণ সদাক্বাহ্ (সাদাকা) দিয়ে ফেরত নেয়া ব্যক্তি ঐ কুকুরের সমতুল্য, যে নিজের বমি নিজে চেটে খায়। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ দান করা সদাক্বাহ্ (সাদাকা) ফেরত নেয়া ব্যক্তি তারই মতো, যে বমি করে এবং তা চেটে খায়।
বুখারী ১৪৯০, মুসলিম ১৬২০।
★সু-প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই/বোন,
শরীয়তের মাসআলা জানা না থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোশত বণ্টনের প্রশ্নোক্ত যে পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে, তা পরিহারযোগ্য।
নিম্নে সংক্ষেপে প্রশ্নোক্ত প্রথাটির কিছু ক্ষতির দিক উল্লেখ করা হল—
১. অনেক কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য-সংখ্যা বেশি হওয়ায় অথবা অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে নিজ পরিবারের জন্য বেশি গোশত রাখার প্রয়োজন হয়; ফলে সে পরিবারের জন্য বেশি গোশত রাখতে চায়। আবার অনেকে তার কোনো দরিদ্র আত্মীয়কে কুরবানীর গোশত দিতে চায়। কিন্তু সামাজিক এই বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কুরবানীর এক তৃতীয়াংশ গোশত সমাজে দিতে বাধ্য হয়। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
إِنَّهُ لَا يَحِلُّ مَالُ امْرِئٍ إِلَّا بِطِيبِ نَفْسٍ مِنْهُ.
কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল নয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৬৯৫)
২. প্রশ্নোক্ত প্রথায় গোশতদাতা তার দানের অংশটি কাকে দেবে সে স্বাধীনতা হারায়। হয়তো সে তার নিকটাত্মীয় অথবা পরিচিত কাউকে একটু বেশি পরিমাণে দিত, কিন্তু এক্ষেত্রে তার জন্য এমনটি করার সুযোগ থাকে না।
৩. অনেক মানুষ এমন আছেন, যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক এই রীতির কারণে গোশত গ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য এ ধরনের ঐচ্ছিক বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেই উচিত নয়।
৪. এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের আরেকটি ক্ষতির দিক হল, সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে, যাদের আয় রোজগার হারাম পন্থায় হয়। সেক্ষেত্রে জেনে বুঝে তাদের কুরবানীর গোশত সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। অথচ হারাম উপার্জনের মাধ্যমে কুরবানীকৃত পশুর গোশত খাওয়া জায়েয নয়।
মোটকথা, শরীয়তের শিক্ষা মোতাবেক প্রত্যেককে তার কুরবানীর অংশ দান করার বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে বা অন্য কোনোভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। কুরবানীদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনা মতো যাকে যে পরিমাণ হাদিয়া করতে চায় করবে এবং গরীব-মিসকীনকে যে পরিমাণ সদকা করতে চায় করবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শত শত বছর যাবৎ এ পদ্ধতিই চলমান আছে।
এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা জরুরি। শরীয়ত যা চালু করতে বলেনি এমন কোনো প্রথা চালু করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
(কিছু তথ্য সংগৃহিত।)